নজরুলকে আবার দেখা
মনি হায়দার
কাজী নজরুল ইসলামকে নানা ভাবে দেখা যায়, এবং দেখা সম্ভব। তরুণ গবেষক সুব্রত কুমার দাস তাঁর বই নজরুল বিষয়ক দশটি প্রবন্ধ-এ নজরুলকে ভাবালুমুক্তভাবে মূল্যায়ন করেছেন।
বইটিতে অন্যতম প্রধান ও দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রবন্ধ হচ্ছে, ‘নজরুল সংযোগে সৈয়দ আবদুর রব এবং মোয়াজ্জিন’। তবে ‘সংযোগে’ শব্দটি এখানে অনুপযুক্ত মনে হচ্ছে। প্রবন্ধটি প্রবন্ধকারের গবেষণা ও পরিশ্রমের ফসল। সৈয়দ আবদুর রব-এই নামটিও বাঙালী মুসলমানেরা ভুলে যাচ্ছিল। সুব্রত সেই হারিয়ে যাওয়া স্রোতের বাঁক থেকে তুলে এনেছেন তাঁকে। নজরুলের সঙ্গে তাঁর আন্তরিক, গভীর এবং আত্মিক সম্পর্ক ছিল, ছিল দুই পরম ব্যক্তিত্বের মধ্যে বাঙালী মুসলমানের বিকাশের জন্য প্রণোদনা।
সৈয়দ আবদুর রব একজন সমাজসেবকও ছিলেন যা মুসলমানদের মধ্যে বিরল। মুসলমানরা পর্দায় নারীকে বন্ধী করে এবং অতীত রোমন্থন করে যেখানে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেন, সেই বিপন্ন সমাজে সৈয়দ আবদুর রব এবং তাঁর সমাজ কল্যাণ প্রচেষ্টা ছিল মনে রাখার মতো ঘটনা। তিনি মোয়াজ্জিন নামে একটি বিখ্যাত পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। দীর্ঘ সময় ধরে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল বাঙালী মুসলমানদের ঘুম ভাঙানোর বাসনা নিয়ে। নজরুল এই পত্রিকায় নিয়মিত অনেক গান, কবিতা, আলোচনা লিখেছেন। সুব্রত কুমার দাস তারিখ সন মিলিয়ে মোয়াজ্জিন পত্রিকায় কবি কবে কি লিখেছিলেন তার নির্ঘন্ট তুলে ধরেছেন প্রবন্ধটিতে। মোটকথা এই আলোচনায় নজরুলের এবং সৈয়দ আবদুর রবে’র একটি অনালোচিত প্রসঙ্গ নতুন বিন্যাসে পাঠকদের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে।
নজরুলের সাহিত্যচিন্তা এবং ক্রমপ্রকাশমান ‘সুন্দর’ আর একটি বিদগ্ধ প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধে প্রবন্ধকার নজরুলের সমগ্র সৃষ্টিতে ‘সুন্দর’কে খুঁজে ফিরেছেন। এই ‘সুন্দর’ কেবলমাত্র একটি শব্দের ব্যঞ্জনা নয়- নজরুল ইসলাম সারা জীবন মানব চরাচরে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুন্দরের সাধনা করেছেন। যাবতীয় অন্যায়, ক্লেদ আর গ্লানির মধ্যে সুন্দরের অবিনাশী শক্তিকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। চেয়েছেন মানবতার বিজয়। সাধনা করেছেন হিন্দু ও মুসলমানের মিলনের ‘সুন্দর’ কল্যাণ। সুব্রত কুমার দাস গভীর অভিনিবেশে নজরুলের মানসজগৎ পাঠ করেছেন এবং তাঁর ‘সুন্দর’কে খুঁজে বের করে এই প্রবন্ধে স্থাপন করেছেন। সেই সঙ্গে নজরুলের সাহিত্যচিন্তাও প্রবন্ধকার নিষ্ঠার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে নতুনভাবে, ভিন্ন ব্যঞ্জনায় প্রতিষ্ঠা দেবার প্রয়াস পেয়েছেন। ‘সুন্দর’ নজরুল মানসের প্রধান শক্তি ছিল অবশ্যই। ব্যক্তিজীবনের হতাশা, দারিদ্র্য, রোগ, শোগ, সবখানে ‘সুন্দর’ই ছিল তাঁর অম্বিষ্ট। সে কারণেই সবাইকে ছাড়িয়ে তিনি অনন্য।
‘নজরুলের রচনায় ইউরোপীয় সাহিত্যের উল্লেখ’ সুব্রত কুমার দাসের বিশেষ প্রবন্ধ বলে মনে হয়। নজরুলের জীবনটাই একটা নাটক, একটা বড় ঝড়, আবেগের ঢেউ। তিনি ছিলেন বেহিসেবী মানুষ। জীবনে অংক কষে চলেন নি, তাঁর চরিত্রে ছিল না এসব। ফলে তাঁকে নিয়ে বিস্ময়ের শেষ নেই। যে যেভাবে পেরেছেন স্মৃতিচারণের নামে নিজেকে মহিমাম্বিত এবং প্রধান করার চেষ্টা করেছেন। অনেকে নজরুলের লেখাপড়া বিশেষ করে বিদেশী সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞানকে অপর্যাপ্ত বলতে চেয়েছেন। এইসব বক্তব্য ও ধারণাকে বাতিল করে বিদেশী সাহিত্য সম্পর্কে নজরুলের ধারণাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন সুব্রত কুমার দাস ‘নজরুলের রচনায় ইউরোপীয় সাহিত্যের উল্লেখ’ প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধে প্রবন্ধকার নজরুলের সাহিত্যে, প্রজ্ঞায় ও মেধায় ইউরোপীয় সাহিত্যের জ্ঞানকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেনÑটীকা টিপ্পনীসহ নানা লোকের অভিমতকে প্রামাণ্য হিসেবে ধরে। নজরুল বহুমাত্রিক প্রতিভার মানুষ ছিলেন। আর স্বাভাবিকভাবেই একজন বহুমুখি-প্রতিভার মানুষ কেবল নিজের ভেতরে নয়, বিচিত্র স্রোতে অবগাহন করবেন এটাই বাস্তব।
এরপরও এ বিষয়ে আর কোন দ্বিমত থাকার অবকাশ করেন নি প্রবন্ধকার। ছিদ্র অন্বেষণকারীদের কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে। নজরুলকে যে মুসলমান সম্প্রদায় এক সময় কাফের বলে ধিক্কার দিয়েছিল, সেই মানসিকতার মুসলমানেরাই এখন তাঁকে মহা মুসলমান বানাবার চেষ্টা করছে। সুতরাং নজরুলকে নিয়ে বিপদ নানামুখী। এইসব বিপদ, বিতর্কের মধ্যেও সুব্রত কুমার দাস নজরুলকে নিয়ে ভাবেন, প্রবন্ধ লেখেন। আশা করা যায় সমস্ত কুয়াশার অবগুণ্ঠন সরিয়ে একদিন সম্পূর্ণ নজরুল, মানুষ নজরুল আরও বিকশিত, আরও পরিস্ফুটিত হয়ে উঠবেন।
সুব্রত কুমার দাসের বইটির নাম একটু অন্য ধরনের, সরল আবার আন্তরিক। নামটার মধ্যে দিয়ে বইটির চরিত্র উন্মুক্ত। বইটির ভেতরে কয়েকটি মুদ্রণ বিভ্রাট আছে। সুব্রত নজরুল চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রাখলে নজরুল মানসের বিভিন্ন দিক উন্মোচিত হবে- আশা করা যায়। তবে তাঁর প্রবন্ধের নেতিবাচক একটি দিক হলো প্রবন্ধকারের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যায়নের স্বল্প প্রকাশ। নজরুল সম্পর্কিত বেশ কমই উদ্ধৃতি আছে। ভুল ধারণাগুলোকে খণ্ডন করতে ভাল উদ্ধৃতির প্রয়োজন আছে, কিন্তু আধিক্য ঘটলে আবার প্রবন্ধ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হয়।
নতুন দিগন্ত ২য় বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০০৪