হে মহাজীবন – এক গৃহস্থ সন্ন্যাসীর আত্মকথন

সায়ীদ যাদীদ

অন্য যে কোন গ্রন্থ আলোচনা যতটা নির্মোহভাবে করা সম্ভব, জীবনীগ্রন্থ নিয়ে ঠিক তেমনটা করা চলে না – যেহেতু এখানে লেখক নিজেই তার রচনার প্রধান চরিত্র। কিন্তু, বর্তমান গ্রন্থটির ক্ষেত্রে কাজটা তেমন কঠিন নয়। কারণ, আলোচ্য গ্রন্থটির লেখক একজন অত্যন্ত নির্মোহ, নির্গ্রন্থ মানুষ। তাঁর জীবনের কর্মসূত্রই হচ্ছে নিঃস্কাম কর্ম। কাজের বিনিময়ে যিনি ফলের আশা করেন না, সংসারে যিনি থেকেও নেই তাঁকে কোনভাবেই বিব্রত করা যায় না।

আমার কাছে মনে হয়েছে, লেখক আকবর হোসেনের “হে মহাজীবন” নামের পুরো বইটি একটি ভ্রমণ কাহিনি যেখানে শারীরিকভাবে তিনি ভ্রমণ করেছেন কুমিল্লার তিতাসের তীর থেকে ঢাকা, রাওয়ালপিণ্ডি হয়ে জাপান, জেদ্দা, আবুধাবি আর আমেরিকা, এবং অবশেষে থিতু হয়েছেন এসে কানাডায়। কিন্তু তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থের মূল উপজীব্যই হচ্ছে তাঁর নৈর্বক্তিক মানস-ভ্রমণ। জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গা ঘুরতে ঘুরতে তিনি বলেছেন তাঁর মনোজগতের বিবর্তনের গল্প, রচনা করেছেন আত্মপলব্ধির রোজনামচা, যা অন্য দু-চার-দশটা ভৌগলিক ভ্রমণ কাহিনীর চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।

কিশোর বয়সে লেখক আকবর হোসেনের মানস-যাত্রা শুরু হয় ‘রাব্বি যিদনি ইলমান কাতিরা’ এই আয়াত পাঠের মধ্য দিয়ে। যার অর্থ, ‘হে প্রভু আমাকে অনেক জ্ঞান দান করো।’ আজ তাঁর এই পরিণত বয়সে প্রভু তাঁকে কতটা জ্ঞান দান করলেন কিংবা নিজে তিনি কতটা জ্ঞান আহরন করতে পারলেন সেই বিচারের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জ্ঞানের পথে তিনি কতটা দূরত্ব অতিক্রম করতে পেরেছেন।

‘ঈশ্বরের খোঁজে বের হয়ো না, জ্ঞানের খোঁজে বের হও। যেদিন জ্ঞান হবে সেদিন ঈশ্বরের কথা আর মনে থাকবে না’ –  স্বামীজির এই উপদেশটি তিনি সারাজীবন মনে রেখেছেন। তাঁর ‘হে মহাজীবন’ গ্রন্থের ৯৪ পৃষ্ঠায় তিনি বলছেন, স্কুলে রুশ বিপ্লবের উপরে বই পড়ে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন, ঈশ্বর নেই। লেখক আরো জানাচ্ছেন, তাঁর স্কুলের শিক্ষক পরিতোষ বাবুর দেয়া গীতা, মহাভারত পড়ে প্রথাগত ধর্মবোধ থেকে তিনি মুক্তি পেলেন। জ্ঞানের সাথে অজ্ঞানের পার্থক্যটা সেখানেই তাঁর তৈরি হয়ে গেল। ধার্মিকরা যেখানে ধর্মগ্রন্থ পড়েন আরো বেশী ধার্মিক হওয়ার আশায়, লেখক সেখানে ধর্ম থেকে মুক্ত হয়ে মুক্ত মানব হয়ে গেলেন! ঠাকুর তাঁকে বলেছিলেন, ‘তুমি সংসারে থাকো কিন্তু সংসার যেন তোমাতে না থাকে।’ অতঃপর সংসার থেকে তিনি নিঃষ্ক্রান্ত হলেন কিন্ত তাই বলে তিনি সন্ন্যাসী হলেন না।

রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সবসময় বলতেন, ‘রসে বসে থাকো। আগে পেট ভরে খাওয়া পরে ধর্ম করা।’ লেখক আকবর হোসেনের বিশিষ্টতা এইখানে যে, জ্ঞানের পথের পথিক হয়েও তিনি সন্ন্যাসী হননি বরং জীবিকার প্রয়োজনে পত্রিকায় কলাম লিখেছেন, বিমানে এবং অন্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। প্রথম জীবনে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে এবং পরবর্তীকালে কর্মক্ষেত্রে তিনি এমন কিছু ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে এসেছেন যারা তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক মানস গঠনে ভূমিকা রেখেছেন। যেমন, কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ, ড. নীহাররঞ্জন রায়, ইতিহাসবিদ ড. রোমিলা থাপার, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং শেষের দিকে কানাডায় এসে ড. মিজান রহমান।

লেখক তাঁর বইয়ের ৫৪ পৃষ্ঠায় বলছেন, ‘দারিদ্র, হতাশা আর দুঃসহ অত্যাচারের ইতিহাসই সমাজতন্ত্রের প্রকৃত ইতিহাস।’ অতএব, তিনি সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ পরিত্যাগ করলেন। কিন্তু, ইদানীং আমরা কমিউনিস্টদের যেমন হজ্জ করে মুসল্লী হতে দেখছি, তা না করে তিনি গীতা, মহাভারত, বেদ-উপনিষদে মনোনিবেশ করলেন। অথচ, সৌদী আরবে কাজ করার সূত্রে চাইলে তিনি একাধিকবার হজ্জ করে পূণ্য অর্জন করতে পারতেন। একজন মানুষ যিনি বাংলাদেশের পল্লীর এক মুসলমান পরিবার থেকে উঠে এসেছেন, খুব অল্প বয়সেই ঠাকুর, স্বামীজীদের সংস্পর্শে এসেছেন, মঠে মন্দিরে ঘুরেছেন, সেই তিনিই নিরীশ্বরবাদী, কমিউনিস্ট হয়ে আবার বেদ-উপনিষদে শিকড়ের সন্ধান করেছেন।

স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়, ‘যে মানুষ পরিবর্তনশীল নয়, যে মানুষ রূপান্তরবাদী নয় তার উত্তোরন কী করে সম্ভব?’ বিবেকানন্দ আরো বলেন, ‘মানুষই নিজেকে ভাঙতে পারে, গড়তে পারে, স্বয়ং ঈশ্বরও যা পারেন না।‘ লেখক আকবর হেসেন নিজেকে সনাতন ধর্মাবলম্বী বলে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করেন।

ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন তাঁর ‘The Hindu way of life’-এ বলেছেন, “Hinduism is a movement, not a position; a process not a result; a growing tradition, not a fixed revelation.” লেখক আকবর হোসেন কথায় কথায় প্রায়ই বলে থাকেন, কোন আকাশী ধর্মে বা গ্রন্থে তিনি বিশ্বাস করেন না। স্বামীজীও যেমন বলেন, “I do not believe in a god or religion which cannot wipe the widow’s tears or bring a piece of bread to the orphan’s mouth.” যেহেতু ‘ People do not live by reason alone ‘, নিরীশ্বরবাদী হয়েও লেখককে সত্যের সন্ধানে, জ্ঞানের পথে হাঁটতে হয়। বিবেকানন্দ আরো বলেন, ‘জ্ঞানই জ্ঞানের সর্বোচ্চ পুরস্কার।’ কিন্তু, কোথায় সেই জ্ঞানের আধার? মনুসংহিতায় বলা হচ্ছে, “ বেদঃ অখিলধর্মমূলম” – অর্থাৎ, বেদ হচ্ছে সকল ধর্মের মূল।

“বিদ্যতে অনেন ইতি বেদঃ” – অর্থাৎ, যে শব্দরাশি দ্বারা মানবজীবনের ইহলৌকিক এবং পারলৌকিক সুখ সম্মন্ধে জ্ঞান লাভ করা যায় তাই হচ্ছে বেদ। যদিও বেদ অপৌরুষেয়, বিশ্বের প্রাচীন ইতিহাস জানতে হলে বেদই একমাত্র সহায়ক গ্রন্থ। বেদকে আশ্রয় করেই বৈদিক সনাতন ধর্ম টিকে আছে। কথাগুলো বললাম কারণ, লেখক নিজেকে সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী একজন নিষ্কাম কর্মের, জ্ঞানের পথিক বলে মনে করেন। তার নিজের কথায়, “মানুষ যখন ন্যায়, সত্য আর জ্ঞানকে ত্যাগ করে তখনই সে ধর্মচ্যুত হয়। আমাদের জীবনের ভিত্তিই হচ্ছে বেদ উপনিষদ হতে পাওয়া জ্ঞান।”

কর্মসূত্রে লেখক আকবর হোসেন পাকিস্তানে থাকার সময়ে উর্দু ভাষাটা ভালোই রপ্ত করেছিলেন। যার প্রমাণ পাই তাঁর বইয়ের পাতায় পাতায় মির্জা গালিব, মীনা কুমারী, ইকবালসহ অন্যান্য উর্দু শের-যাত্রীর অসংখ্য উদ্ধৃতির মধ্যে। ইতিহাসের ছাত্র হলেও আকবর হোসেন ইংরেজি এবং বাংলা সাহিত্যের নিমগ্ন পাঠক। বিশেষ করে শেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ এবং জীবনানন্দ থেকে অতি অনায়াস তাঁর উচ্চারণ।

মুসলিম শাসনের বাহ্যিক সংঘাতে বাংলা যখন বিক্ষত, সেই ষোড়শ শতাব্দীতে চৈতন্য মহাপ্রভু নবদ্বীপে তথা বাংলায় প্রথম রেনেসাঁ ঘটান। কিন্তু, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে মনে হয়, আমরা আমাদের ভারতীয় ঐতিহ্যের গুণী মানুষগুলোর সব অবদান বিস্মৃত হবার কাজটি সুসম্পন্ন করেছি। লেখক আকবর হোসেন তাই আক্ষেপ করে বলেন, “স্বার্থপর মানুষেরা গীতার কর্ম বিভাজনকে যদি অলঙ্ঘনীয় শ্রেণিভেদে রূপান্তরিত না করতো তাহলে অন্য কোন ধর্মীয় মতবাদ এখানে প্রবেশ করতে পারতো না। তাঁর বইটি পড়তে গিয়ে আমারও অন্তরাত্মা কেঁদে উঠেছে যখন তিনি প্রশ্ন করেন, কী সেই দুর্দম প্রলয় যা বিশ্বম্ভর ডাক্তার, ক্ষেত্রমোহন কিংবা নিত্যানন্দ রায়দের বাড়িঘর বিক্রী করে উধাও হয়ে যেতে বাধ্য করে?

এই দীর্ঘশ্বাসের পরেও লেখক বলছেন, “আগে পাওয়ার আনন্দে অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়াতাম, আর এখন না থাকার আনন্দে বিভোর হয়ে থাকি।” পাওয়া না-পাওয়ার, আনন্দ বেদনার এই যে রসায়ন, যুক্তির পথ থেকে মুক্তির পথে এই যে পরিভ্রমণ, তারই বৃত্তান্ত “হে মহাজীবন” বইটির ১৮৩টি পৃষ্ঠা জুড়ে। মানুষের ক্ষুদ্র একটি জীবন আলোর পথে, মুক্তির আনন্দ নিয়ে কী অনায়াসে মহাকালের মহাজীবন স্রোতে মিশে যেতে পারে, তারই উদাহরণ লেখকের ‘হে মহাজীবন’ গ্রন্থটি। আমার মতে, তাঁর বর্তমান বইটি আগের প্রকাশিত বই দুটি ( ‘আমার সময় আমার পথ’ এবং ‘My lonely thoughts’) সহ বিষয় সাযুজ্যের কারণে ট্রিলজি হয়ে উঠেছে। কোন এক আনন্দলোকে, মঙ্গলালোকে সত্য ও সুন্দর যেখানে বিরাজ করে, সেই যাত্রাপথের অভয়বাণী কী গভীর অনুভবে লেখক তাঁর গ্রন্থে বিবৃত করেছেন! যাদের কাছে জীবন মানে শুধু বেঁচে থাকা নয়, তাদের জন্য গ্রন্থটি অবশ্য পাঠ্য।