অন্য এক মানস সরোবর ‘লেক ল্যুইস’

শেখর কুমার সান্যাল

ব্যাম্‌ফ থেকে ট্রান্সকানাডা হাইওয়ে-১ ধরে ছাপ্পান্ন কিলোমিটার উত্তরপশ্চিমে লেক ল্যুইসে পৌঁছে গেলাম ঘন্টাখানেকের মধ্যে। পার্কং স্পেস থেকে লেক পর্যন্ত বনময় পথে সামান্য হাঁটতে হলো। হিমবাহের পটভূমিতে অসামান্য সুন্দর হ্রদটি দেখে বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে গেলাম। লেক ল্যুইস সম্ভবত এই অঞ্চলের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন হ্রদ।

১৮৮২ সালে কানাডা প্যাসিফিক রেলওয়ের নির্মাণকাজ চলছিল এখন যেখানে ‘লেক ল্যুইস ভিলেজ’ সেখানে। কনস্ট্রাকসান ক্যাম্পের চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ বি রজার্সের হর্স প্যাকার ছিলেন টম উইলসন। একদিন তিনি উপত্যকায় হিমবাহ ধসের গম্‌ গম্‌ প্রতিধ্বনি শুনে আদিবাসী স্টোনী নাকোডা ইন্ডিয়ানদের কাছে জানতে চান এই শব্দ কোথা থেকে আসছে। তারা বলে ‘হো রাম ন্যাম নাহ্‌’র বজ্রনাদ। এই ইন্ডিয়ান শব্দের অর্থ ‘দ্য লেক অব লিটল্‌ ফিশেস’।

কৌতূহলী উইলসন পরদিন ছুটি নিয়ে ইন্ডিয়ান গাইড এডউইন হান্টারের সাথে পাঁচ কিলোমিটার দূরে হ্রদে এসে বিমুঢ় বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। দিনপঞ্জিতে লিখলেন “ঈশ্বর জানেন, আমি জীবনে যত অভিযান করেছি এমন তুলনাহীন অনুপম দৃশ্য কখনোই দেখি নি”। এখানে আসা প্রথম শ্বেতাঙ্গ উইলসন পাহাড়ে ঘেরা হ্রদের উজ্জ্বল সবুজাভ-নীল রং দেখে নাম রাখলেন ‘এমারেল্ড লেক’। ভিক্টোরিয়া হিমবাহের বরফগলা জলে পুষ্ট প্রায় ছয় হাজার ফুট উঁচু আশি হেক্টর আয়তনের হ্রদের এই নাম অনেক দিন পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। পরে ‘কানাডীয়ান প্যাসিফিক রেলওয়ে’ মহারানি ভিক্টোরিয়ার চতুর্থ কন্যা ল্যুইস ক্যারোলাইন আলবার্টার নামে হ্রদের নূতন নাম রাখে ‘লেক ল্যুইস’। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ইংল্যান্ডের রানি অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডারও সাংবিধানিক প্রধান। ভিক্টোরিয়া হিমবাহের পা ছোঁয়া আশ্চর্য রকম পান্না সবুজ জলে শুভ্র গ্লেসিয়ারের প্রতিবিম্ব ভুবনমোহিনী রূপে সাজিয়েছে হ্রদকে। সরোবর সবুজাভ-নীল রং পেয়েছে জলবাহিত কঙ্করকণা থেকে।

হ্রদের সামনে ভিক্টোরিয়া হিমবাহের মুখোমুখী অপরূপ পরিবেশে গড়ে উঠেছে রাজকীয় পাঁচতারা  হোটেল ‘ফেয়ারমন্ট স্যাতো লেক ল্যুইস’। সমগ্র রকির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পান্থনিবাস। হ্রদের ওভারফ্লো ‘ফেয়ারমন্ট স্যাতো’র পাশ দিয়ে নাতিদীর্ঘ ল্যুইস ক্রীক হয়ে বো রিভারে পড়ছে ‘লেক ল্যুইস ভিলেজে’র উপকন্ঠে। খুব ছোটো আকারে হোটেলের গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৮৯০ সালে কানাডা প্যাসিফিক রেলওয়ের প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম কর্নেলিয়াস ভ্যান হর্নের হাতে। কালক্রমে পান্থশালা মহীরুহ হয়ে ওঠে। লেক ল্যুইস ও স্যাতোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে কানাডীয়ান প্যাসিফিক রেলওয়ের মেইন লাইনের উপর ‘লাগানে’ (বর্তমানের লেক ল্যুইস ভিলেজ) ১৮৯০ সালে একটি স্টেশান নির্মিত হয়েছিল। কালক্রমে সড়কপথের উন্নয়ন এবং অটোমোবাইলের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠলে ‘লাগান’ স্টেশান অলাভজনক হয়ে পড়ে বন্ধ হয়ে যায় এবং ১৯৭৬ সালে ক্যালগেরী হেরিটেজ পার্কে প্রদর্শনীর জন্য স্থানান্তরিত হয়।                 

২০১৪ সালের শরতে ‘আপটেক সামিট’ হয়েছিল ‘ফেয়ারমন্ট স্যাতো লেক ল্যুইসে’। কানাডা ন্যাচারাল রিসোর্সেস লিমিটেডের প্রতিনিধি দলে ছিল আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র জয়দীপ। লেক ল্যুইসে আমি আগেও কয়েকবার গিয়েছি। এবার জয়দীপের সঙ্গী হয়ে স্যাতোতে দুটি দিন অবকাশ যাপন করে এলাম। সাড়ে পাঁচশ গেস্টরুম ও সুইট ছাড়াও স্যাতোতে রয়েছে ছ’টি রেস্তোরাঁ ও বার, স্পা, বলরুম, জুয়েলারী শপ, বেশ কয়েকটি স্যুভেনীর শপ, বুকস্টোর, সুইমিং পুল, গেস্টদের বেবি-কেয়ার। আমাদের ব্রেকফাস্ট ও গালা ডিনার হয়েছিল ‘ভিক্টোরিয়া বলরুমে’। জয়দীপ দিনমান ব্যস্ত সেমিনারে। আমার সময় কাটত লেক, হিমবাহ আর পাইনবনের বিচিত্র সৌন্দর্য আকন্ঠ উপভোগ করে আর এদের দেখতে আসা নানা ভাষা নানা দেশ নানা পরিধানের মানুষের রূপবৈচিত্র্য দেখে। হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম লেকপাড়ের ট্রেইল ধরে দু’কিলোমিটার দূরে ভিক্টোরিয়া হিমবাহের প্রায় গোড়ার কাছে। মাঝে মাঝে লগ বেঞ্চে বসে চেয়ে থাকতাম নীলকান্ত হ্রদের দিকে। এক প্রান্তের বোটহাউস থেকে ক্যানো ভাড়া করে লাইফ-জ্যাকেট গায়ে জলবিহার করছে অনেকে। কত নারী-পুরুষ, এমনকি প্রবীণ দম্পতি জোড়া হাইকিং স্টিক নিয়ে পাহাড়ের মধ্যে ট্রেকিং করে চলে যাচ্ছে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে ‘এ্যাগনেস লেকে’। অদ্ভুত জীবনী শক্তি!

লেক ল্যুইস গ্রীষ্ম ও শীতে একই রকম আকর্ষণীয়। শীত মৌসুমে লেক ল্যুইসের ওপরের স্তর কঠিন বরফ হয়ে যায়। সে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য! সে সময় উইন্টার ফেস্টিভ্যালে তুষারভাস্কর্যের আকর্ষণে প্রচুর পর্যটক সমাগম হয়। জমাটবাঁধা হ্রদে চেয়ারে বসে থাকা বা স্লেজে হ্রদ পাড়ি দেওয়া এক উত্তেজনাময় অভিজ্ঞতা। এই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আমাদেরও হয়েছিল পরবর্তী এক শীতে জয়দীপ, বধূমাতা লোপা আর দাদুভাই বর্ণর সাথে।

লেক ল্যুইস স্কী রিজর্ট স্কী-বিলাসীদের স্বর্গরাজ্য। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচিত পৃথিবী সর্বশ্রেষ্ঠ দশটি স্কী-রিজর্টের মধ্যে লেক ল্যুইসের স্থান ছিল প্রথমে। শীতকালে ‘ফেয়ারমন্ট স্যাতো’ থেকে সম্পূর্ণ তুষারাচ্ছাদিত চারটি পর্বত, ভিক্টোরিয়া গ্লেসিয়ার, লেক ল্যুইস ও পাইনবীথির অপরূপ দৃশ্য অকল্পনীয়।