আমার বাবা-মা

দিলীপ চক্রবর্তী

ভগবানকে দেখিনি। কিন্তু আমার জীবনে ভগবানের দুই প্রতিনিধিকে দেখেছি। তাঁরা হলেন আমার বাবা এবং মা। তাঁদের জন্যই আমি এই দুর্লভ মানব জন্ম পেয়েছি। বাবার নাম জগদীশচন্দ্র চক্রবর্তী (১৯১০-১৯৫৬), মায়ের নাম রেণুকনা চক্রবর্তী (১৯২০-২০০৫)।

বাবাকে অল্প বয়সে হারিয়েছি। তিনি মাত্র ছেচল্লিশ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। তিনি জীবনে খুব সার্থক ছিলেন। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। তিনি এম.এসসি., বি. এল. (গোল্ড মেডেলিস্ট) ছিলেন।  কর্মজীবনে ছিলেন গেজেটেড অফিসার। আর সে কারণেই  আমাদের ভাই-বোনদের জীবন ছিল মাতৃকেন্দ্রিক।

আমার বাবা সম্বন্ধে একটা ঘটনা বললেই আমার বাবার ছবিটা আপনাদের কাছে একটু পরিষ্কার হবে। কথাটি বলার জন্য আমার নিজের কথাও একটু বলতে হবে, উপায় নেই। ১৪ বছর বয়সে আমি যখন ক্লাস টেনের ছাত্র তখন আমার একটা বড় রকমের মোটর দুর্ঘটনা হয়। এক মাস কলকাতার আর. জি. কর মেডিকেল হসপিটালে বিশিষ্ট সার্জেন্ট ডক্টর সুবোধ দত্তের চিকিৎসাধীন ছিলাম। আমি বেঁচে ফিরবো এই কথা ডাক্তারবাবু সহ অনেকেই ভাবেননি। ভগবানের দয়ায় এবং সকলের শুভেচ্ছায় আমি বেঁচে ফিরি। ডাক্তারবাবু আমাকে পড়াশুনা বন্ধ করে দিতে বললেন কারণ আমার ব্রেন সার্জারি হয়েছিল। যদিও সেই সময় ব্রেন সার্জারি খুব সচরাচর হতো না। আমার জন্য পড়া নিষিদ্ধ হয়ে গেল।

কয়েক মাস বাদে আমার স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা। আমি আর পড়াশোনা করতে পারবো না এমনকি ম্যাট্রিক পাসও করতে পারবো না, সেটা ভেবে আমার তো কাহিল অবস্থা। আমার চিরকালের শখ শিক্ষকতা করা। তাই আমি জেদ ধরলাম যে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবই। শেষে ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মতন ঠিক হল যে আমি পরীক্ষা দেবো, কিন্তু আমি নিজে পড়তে পারবো না। আমার বাবা এবং মা দুজনে মিলে আমার বই থেকে আমাকে পড়ে শোনাবেন এবং আমি শুনে শুনে শিখবো। কিন্তু আমিতো শ্রুতিধর নই। বাবা সারাদিন অফিসের খাটুনির পর অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমাকে পড়ে শোনাতেন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখতে চাই, আমার বাবা নিজেও লেখাপড়া খুব ভালবাসতেন। বাবাকে দেখতাম শোবার সময় একটা বই নিয়ে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়তেন।

ম্যাট্রিক পরীক্ষা (ওখানে বলতো স্কুল ফাইনাল এক্সামিনেশন) পরপর পাঁচদিন চলল। সেই পাঁচদিন বাবা ছুটি নিলেন এবং বাবার এক বন্ধু ডক্টর সুধির লাল মুখার্জী সাহেবের গাড়ি নিয়ে আমার সঙ্গে পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতেন এবং আমার পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওখানে অপেক্ষা করতেন। পরীক্ষা শেষ হলে আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। আমার পরীক্ষা হত সকাল দশটা  থেকে একটা এবং দুপুর দুটো থেকে পাঁচটা। বাবা আমার টিফিনের সময় খাবার এবং কয়েকটা ওষুধ নিয়ে গাড়িতে বসে থাকতেন। ওষুধ সঙ্গে করে রাখতেন কোন আপাতকালীন অবস্থার জন্য। আমি গর্বিত যে এরকম বাবা পেয়েছিলাম এবং মর্মাহত যে এত তাড়াতাড়ি সেই বাবাকে চিরতরে হারিয়েছিলাম।

এবার আসি মায়ের কথাতে। সবার কাছেই তাদের মা অতি প্রিয় মানুষ। মাকে নিয়ে আমার নিজের লেখা দুটো লাইন শোনাতে ইচ্ছে করছে,

“Oh Mother, we bow at the feet of thine,

Thou art God’s noblest gift – love divine.”

আমার মা আমাদের কাছে এক আদর্শ মানুষ ছিলেন। এখানে বলতে পারি যে আমার দাদু ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছাত্র এবং আমার মা ছিলেন সঙ্গীতাচার্য ভীষ্মদেব চ্যাটার্জীর এক সময়ের ছাত্রী। মা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস ১০ এর ছাত্রী  ছিলেন বিয়ের সময়। তারপর প্রথাগত শিক্ষা আর এগোয়নি।

একটা কথা মা সম্বন্ধে বললেই অনেক কথা বলা হয়ে যাবে যে আমাদের মা জীবনে আমার বা আমার ভাই বোনদের গায়ে কখনো হাত তোলেননি। সেই সময় ছোটদের মারধর করাটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। “ঠিক কথা বলেছেন নবনীতা সরকার,/ ছেলেদের মাঝে মাঝে মারধর দরকার“ – এটাই ছিল সেকালের প্রচলন।

কথায় বলে “বাজনার চেয়ে খাজনা ভারী”, বসেছি মায়ের সম্বন্ধে একটা কথা আপনাদের জানাতে কিন্তু ভূমিকা লিখতেই রাত কাবার। যাক, এবার আসল কথায় আসি। সেটা  ১৯৫৭ সাল। দুমাস আগে আমার বাবা মারা গেছেন। মায়ের বয়স তখন ৩৬ বছর – আমরা পাঁচ ভাই-বোন, আমি সবচেয়ে বড়, আমার বয়স তখন ১৮।  মা শিলং যাচ্ছেন আমার ছোট তিন ভাইবোনকে নিয়ে। মায়ের মানসিক অবস্থা তখন বুঝতেই পারেন, চেহারায় হতাশার ছাপ স্পষ্ট।

গাড়ির কামরা মোটামুটি খালি – মা যে বেঞ্চে বসে আছেন তার সামনের বেঞ্চে চারটে ইয়াং স্টুডেন্ট নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করতে করতে, হইচই করতে করতে যাচ্ছেন। মায়ের ওই করুণ চেহারা দেখে ওই ছাত্ররা মাকে ঠিক ধর্তব্যের মধ্যেই ধরেনি এবং মোটামুটি বলা যায় ওরা মাকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করছিল। হঠাৎ ওই ছেলেদের মধ্যে একজন বলল আচ্ছা ‘Good Earth’ উপন্যাসের লেখক এর নাম কী? ওরা অনেক চেষ্টা করেও ঠিক মনে করতে পারছে না – যাকে বলে নামটা পেটে আসছে কিন্তু মুখে আসছে না। জোরে জোরে অনেক লেখকদের নাম বলেন ও সেই নাম শুনে বাতিল করে দেন। ওই ছেলেরা মাকে শুরু থেকেই পাত্তা দিচ্ছিল না, কাজেই মাও চুপচাপ ছিলেন হঠাৎ মা আস্তে করে বললেন, “বোধহয় Pearl Buck”। ছেলেদের ওপর মনে হয়ে বিদ্যুতের ঝটকা লাগল, ওরা এক বাক্যে  চেঁচিয়ে শুধু বললো, “মাসিমা”। বাকি সারা রাস্তা মায়ের প্রচন্ড ভক্ত হয়ে গেল ওরা।  মনের ওই অবস্থার মধ্যেও মা ওদের গান শোনালেন।  মায়ের গান শুনে এবং মায়ের সঙ্গে আলাপ করে সেই ছাত্ররা অভিভূত হয়েছিল।শুরুতে মাকে অবজ্ঞা করার জন্য পরে ওরা আন্তরিকভাবে অনুতপ্তও হয়েছিল।

বাবার মৃত্যুর প্রায় ছয় দশক পর, আর মায়ের মৃত্যুর দুই দশক পরে এসে বুঝি আমার বাবা-মা আমার কতোটা উচ্চতার অধিকারী ছিলেন। তারাই ছিলেন আমার কাছে প্রত্যক্ষ ভগবান।