ইকবাল হাসানের গল্প: সমকালের নিখাঁদ দর্পণ
খালেদা জাহান
বাংলাদেশের সাহিত্যে প্রচারবিমুখ নিভৃতচারী এক কবির নাম ইকবাল হাসান (১৯৫২-২০২৩), যিনি সত্তর দশক থেকে এদেশের কাব্য ও গদ্যের ভুবনে নিজস্ব আবাস গড়ে তুলেছেন। দেশের চিরসবুজ জেলা বরিশালের কোমল পরিবেশে জন্ম ইকবাল হাসানের। শৈশব-কৈশোর এবং যৌবনের তরঙ্গায়িত দিনগুলো অতিক্রম করে তিনি অর্থনীতিতে স্মারক শেষ করে সাংবাদিকতায় এম.এ করার জন্য ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকায় আগমনের মধ্য দিয়েই ইকবাল হাসান তাঁর কবি-সত্তাকে যথাযথভাবে উপভোগ করতে শুরু করেন, রচনা করতে থাকেন চমৎকার সব উপমা-সম্বলিত কবিতা: ‘বিষণ্ণ কাকের মতো ঘুরে ঘুরে কোথায় কাটালে তুমি? …/ সাদা কাফনের মতো জ্যোৎস্নার জলে একটি একাকী দীর্ঘশ্বাস/ শুধু শব্দহীন ঝরে গেল। … তুমি এলে না, এলে না। (কবিতা- সারাদিন) সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেও জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন মেয়াদে প্রবাস জীবন বেছে নেন তিনি। সাহিত্য রচনার স্বীকৃতি-স্বরূপ বাংলা একাডেমি থেকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া ইকবাল হাসান ওয়ালীউল্লাহ্র মতোই প্রবাসে স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়ে আমৃত্যু কানাডার টরেন্টোতে বসবাস করেন।
রোম্যান্টিক সত্তার অধিকারী ইকবাল হাসান কবিতার মতো গদ্য রচনায়ও রেখেছেন প্রাতিস্বিকতার স্বাক্ষর। কবিতা-গল্প-উপন্যাস এবং স্মৃতিকথা মিলে প্রায় অর্ধশতকের মতো গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। দীর্ঘ প্রবাস জীবন সত্ত্বেও ইকবাল হাসান রচিত সাহিত্যের বিষয় আহৃত হয়েছে বাংলাদেশের সমকালীন আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে। আর এ কারণেই কথাকার সেলিনা হোসেন ইকবাল হাসানের লেখনী সম্পর্কে বলেন: বাংলাদেশের সাহিত্যে ইকবাল হাসান সত্তর দশকের কবি ও কথাসাহিত্যিক। শিল্প সাধনায় নিজের ভুবন গড়েছেন দীর্ঘ সময় ধরে। এই ভুবনে শিল্পের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়েছেন প্রবাসে বাস করেও। (মুখবন্ধ: আলো আঁধারে কয়েকটি সোনালি মাছ, ইকবাল হাসান)
২
ইকবাল হাসান বিশ্বাস করেন মানুষের জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে হাজার হাজার গল্পের বীজ’। তাই মানব জীবনই তার গল্পের প্রধান কুশীলব। যে গল্পে পরী নেই-তে ইকবাল হাসান ছোটগল্পের প্রবাদ-পুরুষ মোপাশা-ফ্লবেয়ারের প্রসঙ্গ টেনে ছোটগল্প সম্পর্কে নিজের অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন গল্প হবে নির্মেদ তথা ফ্যাটলেস; আর গল্পকে বানিয়ে বানিয়ে লম্বা করা চলবে না। গল্প লেখার ক্ষেত্রে তিনি নিজেও এই রীতি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলেছেন। তাঁর রচিত কোনো গল্পেই যেমন শাখাকাহিনি বা উপকাহিনির আধিক্য নেই আবার চরিত্র সংখ্যাও রাখা হয়েছে সীমিত। সবগুলো গল্পই পাঠকের বোধকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে স্বল্পায়তনের মধ্যে শেষ হয়েছে। আত্মমূল্যায়নের ক্ষেত্রেও নিরপেক্ষ থেকেছেন তিনি, ইকবাল হাসান বলছেন: আমি কোনো নামি লেখক নই। সামান্য গল্প কবিতা লিখি আর কি! ইকবাল হাসান গল্পের পরিচর্যারীতির ক্ষেত্রে রূপক-প্রতীকের নবতর সংস্করণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন ম্যাজিক রিয়ালিজমের বিভিন্ন প্রান্তকে। সমকালীন সাহিত্যিকদের মতো তিনি জাদুবাস্তবতাকে অবলম্বন করে গল্প লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন, এ সম্পর্কে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের মন্তব্য স্মরণযোগ্য: আমাদের কালের গল্প লিখেছেন ইকবাল হাসান। লিখেছেন এক অপরূপ নকশাদার ভাষায়, তার বৈশিষ্ট্য, চিত্ররূপময়। তার চরিত্রগুলো বাস্তব ও কুহেলিকার মধ্যে কুয়াশার ঢেউয়ের মতো আসা যাওয়া করে, যদিও তাদের উদ্দিষ্ট আসলে এক নিরেট বাস্তবতা, বাস্তবতাকে তুলে ধরার প্রয়োজনেই এক স্বপ্নবাস্তবতা নির্মাণ করেন ইকবাল হাসান। (মুখবন্ধ; নির্বাচিত গল্প, ইকবাল হাসান)
ইকবাল হাসানের কবিতা লেখার ক্ষেত্রে যেই প্রযতœ লক্ষ করা যায় গল্প বা উপন্যাসে তা অনেকটাই বিরল। তবে ইকবাল হাসান রচিত গল্পগুলো বৈচিত্র্যময়, একই বিষয় নিয়ে লিখলেও কোনো গল্পে পুনরাবৃত্তির প্রবণতা দেখা যায় না। প্রতিটি গল্পই সম্পূর্ণ মৌলিকতার বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। তাঁর গল্পে সমকালীন জীবন-জিজ্ঞাসার নানা প্রসঙ্গের অবতারণা যেমন রয়েছে তেমনি ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায় বিশেষ করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্পর্শকাতর ঘটনারও অবতারণা আছে। ইকবাল হাসান গল্পের বিষয়ের বিচিত্রতার সাথে সাথে আঙ্গিকের ক্ষেত্রে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা জারি রেখেছেন। তিনি গল্প-গ্রন্থের নামকরণের ক্ষেত্রে এনেছেন আলাদা চমৎকারিত্ব যথা: কপাটবিহীন ঘর, মৃত ইঁদুর ও মানুষের গল্প, কার্তিকের শেষ জ্যোৎস্নায়, সুখলালের স্বপ্ন ও তৃতীয় চরিত্র, আলো আঁধারে কয়েকটি সোনালি মাছ প্রভৃতি তাঁর গল্পগ্রন্থের নাম।
৩
ইকবাল হাসান তাঁর বিভিন্ন গল্পে বাংলাদেশের সমকালীন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকৃত চেহারা উন্মোচনে নিষ্ঠাশ্রম স্বীকার করেছেন। এসব দলের কাছে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব, প্রতিভাবান যুবকদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে ব্যবহার করা, দলগুলোর প্রভাবশালী ব্যক্তিদের লালসার শিকার হয়ে প্রান্তবাসী তরুণীদের সম্ভ্রমহানী এবং তাদের নির্মম মৃত্যুর নির্মোহ বর্ণনা আছে বেশকিছু গল্পে।
কুয়াশার টানেল গল্পে বল্টু সেরাজ চরিত্রের মধ্য দিয়ে দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের এক অনিকেত তরুণের স্বপ্নহীন ছিন্নমূল জীবনকে পুঁজি করে প্রভাবশালীরা কীভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ হাসিলের জন্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যায়। বদরুল পাশার মতো যারা অপরাজনীতির সাথে জড়িত তারা বল্টু সেরাজদের মতো তরুণদের দিয়ে ‘খুন-খারাবি, রক্তারক্তি, চাঁদা তোলা, ছিনতাই, হাত-পা ভেঙে দেয়া, আর অনবরত মানুষকে ভয় দেখানোর কাজ করিয়ে নেয়। এসব অন্যায় কাজ করতে অনীহা দেখানোর সাহস করলে তাকে হত্যা করতেও দ্বিধা করেন না বদরুল পাশারা।
এক আশ্চর্য সন্ধ্যায় গল্পে সার্থক ছোটগল্পের শর্ত পূরণ করে ঘোর লাগা এক সংলাপের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি টানা হলো। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তৃষ্ণা অথবা তৃষা নামের দারুণ স্মার্ট এবং আকর্ষণীয় এক তরুণীর গল্প এটি। হালকা গোলাপি শিপন, সর্ট হাতা ব্লাউজ আর রোদ-চশমায় তাকে মানিয়েছে বেশ। ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিকের আলতো ছোঁয়া, কপালের মাঝখানে ম্যাচ করা ছোট্ট একটা টিপ, পায়ে গোলাপি স্ট্রাইপের স্যান্ডেলে মোহনীয় মেয়েটা বইমেলার ঘুরে ঘুরে স্টলে স্টলে কমলকুমার মজুমদারের গোলাপ সুন্দরী বইটি খুঁজছে। স্যানিটোরিয়ামে থাকা অসুস্থ একজনকে নিয়ে লেখা এই বইটি সে নিজের অসুস্থ রুমমেটের জন্য খুঁজছে। তৃষ্ণা অথবা তৃষা নামের মেয়েটির চরিত্রের এই আলাদারকম দ্রুতির জন্য সহজেই সে জামিল ইউনুসের নজরে আসে। খানিক সময় বাদেই তারা অনেক দিনের চেনা মানুষের মতো ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে এরপর বইমেলা থেকে উত্তরায় একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়া, জামিলের ছোট্ট ফ্ল্যাটে আতিথ্য গ্রহণে রাজি হওয়া, রাত বারোটার আগে তৃষাকে হোষ্টেলে পৌঁছে দেবার প্রসঙ্গ সবকিছুর মধ্যে একটা স্নিগ্ধ ভালোলাগা বোধ করছিলো জামিল কিন্তু তার সুন্দর অনুভবের মধ্যে বিষাদের ছায়া নেমে আসে যখন তৃষার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়: “এক রাতের জন্যে আমার রেট কিন্তু পাঁচ হাজার।
পাটুরিয়া ঘাটের মরা জ্যোৎস্নায় গল্পে নগরজীবনের ভিন্ন বাস্তবতা দেখানো হয়েছে । সিডরে বাবা মাকে হারিয়ে ফতি নামের কিশোরী কচুরিপানার মতো ভাসতে ভাসতে একদিন শহরে এসে ওঠে। দীর্ঘ অনাহারে হাড্ডিসার ফতি হারু খালাশির নজরে পড়ে। এই হারু খালাশি তাকে নতুন জীবনের সন্ধান হিসেবে তামাম দুনিয়ার সবচে বড়ো পল্লি দৌলতদিয়া ঘাটের যৌনপল্লিতে নিয়ে যাবে। যাত্রা পথে বাসযাত্রী মহিদুলের সাথে কথোপকথন কালে জানা যায় গরিবের হারেমখাানা বলে খ্যাত এই পল্লিতে বারো তেরো বছর বয়সী কন্যা শিশুদের ওরাডেক্সন তথা গরুর ট্যাবলেট বলে পরিচিত ঔষধ সেবন করানো হয়, ফলে ‘কয়েক মাসের মধ্যেই এই জাদুকরী ট্যাবলেটের জোরে ওরাও গরু-ছাগলের মতো মোটাতাজা হয়ে এক্কেবারে আঠারো বিশ বছরের যুবতিতে পরিণত হয়। বাংলাদেশের হাজারো প্রান্তিক নারী-শিশুদের প্রতিনিয়তই এরকম দুর্ভাগ্য বরণ করণ করে নিতে হচ্ছে; ভয়ংকর কঠিন বাস্তবতায় রচিত পাটুরিয়া ঘাটের মরা জ্যোৎস্নায় গল্পে লেখকের সমাজমনস্কতার পরিচয় পাওয়া যায়।
অপূর্ব বয়ন-কৌশলের গল্প আলো আঁধারে কয়েকটি সোনালি মাছ-এ প্রান্তিক সংখ্যালঘুদের দুর্দশা তুলে ধরা হয়েছে। হালকা হিউমারের আবহে এই গল্পে সমাজের তরুণ প্রজন্মের অধঃপতন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসততা, শাসক গোষ্ঠীর দুর্বৃত্তায়ন প্রভৃতির বলি হতে হয়েছে হরিপদ বালার পরিবারকে। জীবিত হয়েও হরিপদ বালার পরিবার দুঃখি, মরা মানুষ-এর জীবন যাপন করে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে বিষখালি নদীতে ভেসে যায় অজানা গন্তব্যের দিকে। সুখলালের স্বপ্ন ও তৃতীয় চরিত্র গল্পে জাদুবাস্তবতাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে শহর থেকে গ্রামে আসা এম.পি সাহেবের পুত্রের লাম্পট্যের শিকার কদম শেখের কন্যা ফতির করুণ মৃত্যুর প্রসঙ্গটি তুলে ধরেছেন লেখক।
৪
পবন মাঝির নাও গল্পে ইকবাল হাসান ফিরে গিয়েছিলেন একাত্তরের সময়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সনাতন ধর্মাবলম্বী নারী শিশুরা কেমন করে পাক-বাহিনীর এদেশীয় দোষীদের কারণে ভয়ংকর পরিণতির শিকার হয়েছিলো তার সংক্ষিপ্ত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ বয়ান আছে এই গল্পে। বরিশালের বিশখালি নদী তীরবর্তী হরিহরের মাতৃহীন কন্যা কিশোরী শিবানীকে ঈমান আলী মাতুব্বর নিজের কন্যার সাথে থাকবে এমন আশ্বাস দিয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু সে শিবানী কে তুলে দেয় রাজাপুরে অবস্থিত পাক বাহিনীর ক্যাম্পে; নির্মম নির্যাতনে ক্যাম্পেই শিবানীর মৃত্যু হয়। সহায় সম্বলহীন হরিহর কন্যার এমন পরিণতিতে সামান্য প্রতিবাদও করতে পারেনি; নিজের আত্মচিৎকার চেপে রেখে সুহৃদ পবন মাঝিকে সাথে নিয়ে কন্যার মৃত দেহ সে সনাতনী সৎকারের রীতির পরিবর্তে সমুদ্রের কাছাকাছি ভাসিয়ে দেওয়া সাব্যস্ত করে। ভগবানের অশেষ কৃপার প্রতি দীর্ঘদিন ধরে অবিচল আস্থা ছিলো হরিহরের, কিন্তু কন্যার এমন পরিণতিতে ধর্মের রীতিনীতিও গুরুত্ব হারালো তার কাছে।
বরিশালের বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম কুদ্দুস মোল্লাকে স্মরণে রেখে কিংবদন্তির ছায়া গল্পটি রচনা করেন ইকবাল হাসান। ডাকাত দলের প্রধান মেসের আলি ওরফে গিট্টু মেসের ওরফে আন্ধার আলী জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধ শেষে ফিরে দেখে তার দলের অন্যতম সদস্য সুরুয ওরফে নসু প্যাদা পাক-বাহিনীর সমর্থনে রাজাকারের ভূমিকা পালন করে। আর এজন্য তার কোনো অনুশোচনা পর্যন্ত নেই বরং তার যুক্তি ‘রাজাকার ফাজাকার বুঝি না ওস্তাদ, আপনে ইন্ডিয়ার লইগ্যা যুদ্ধ করছেন আর মুই পাকিস্তানের লইগ্যা যুদ্ধ করছি’। এই কথোপকথনের রাতেই দুর্গাসাগর দিঘির শীতল সিঁড়িতে মেসের আলির নিথর দেহ পড়ে থাকে দেখে এলাকাবাসী। যুদ্ধের পরে রক্ষীবাহিনী, রাজাকার বাহিনীসহ সুযোগ সন্ধানী গোষ্ঠী কীভাবে নির্বিচার হত্যাকা- চালিয়েছে তার বাস্তবচিত্র এগল্পে তুলে ধরা হয়েছে।
৫
ইকবাল হাসান তাঁর বেশকিছু গল্পে জাদুবাস্তবতাকে আশ্রয় করে সমকালীন সমাজের রূঢ় বাস্তবতাকে প্রতীকায়িত করতে চেয়েছেন। স্বপ্নপর্বের তিন কাহন পুরোপুরি জাদুবাস্তবতার গল্প। অবসরপ্রাপ্ত সচিব আবদুর রশীদ পাটোয়ারীর অবচেতনের চিন্তনক্রিয়াকে জাদুময় করে উপস্থাপন করা হয়েছে এখানে। উপকথার মতো এই গল্পে কথা বলা মুরগি একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে রয়েছে; যেটি আবদুর রশীদ পাটোয়ারীর কোলে কাপড়ের পোটলার মতো করে আসন পেতে বসে ছিলো। সে এই মুরগি মার্কা নিয়ে জাতীয় নির্বাচন করতে চায়; কারণ তার ধারণা ‘একবার এম.পি হতে পারলে অই মুরগি প্রতিদিন একটা করে সোনার ডিম পাড়বে। বছরে ৩৬৫টি সোনার ডিম। … ভাবা যায়! তার উপর কবিতা, টেন্ডার বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, নিয়োগ ও বদলি, তদবির বাণিজ্য এসব উপরি তো আছেই’। এই উক্তির মাধ্যমে মূলত আমাদের দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা এবং জনপ্রতিনিধিদের প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে।
মৌ নামের এক তরুণীর অবচেতনের ভাবনাকে ঘিরে লেখা হয়েছে ওয়েবক্যাম নামের গল্পটি। পিতা-মাতার স্নিগ্ধ দাম্পত্য সম্পর্কের আবহে মৌ নিজের জীবনেও প্রণয়ঘেরা বৈবাহিক সম্পর্কের অস্তিত্ব অনুভব করে, যেখানে রাশেদ নামের এক প্রবাসী যুবকের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেয় সে। কিন্তু গল্পের শেষে জানা যায় রাশেদ নামের কেউ নেই মৌ-এর জীবনে।
আধুনিক মানুষের বহু-বঙ্কিম দাম্পত্য জীবনকে বিভিন্ন আঙ্গিকে পর্যবেক্ষণের প্রয়াস আছে কিছু গল্পে। অভিনব শৈলীতে লেখা ওর আর আমার গল্প-তে তন্দ্রা ও রেজা আহাম্মেদের যৌথজীবনের নিগূঢ় দিকটি নির্মোহভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা রয়েছে। পরিবার, পরিজনদের প্রবল বাধার মুখেও শারীরিক সমস্যাগ্রস্ত রেজাকে মায়ায় পড়ে বাইশ বছর বয়সে বিয়ে করে তন্দ্রা । প্রায় দুইদশকের দাম্পত্যে তাদের কোনো সন্তান নেই, রেজাকে ছেড়ে নতুন করে জীবন গোছানোর সমস্ত সুযোগ সত্ত্বেও তন্দ্রা শিশুর মতো নির্মল রেজাকে রেখে কোথাও পালিয়ে যাবার কথা চিন্তাও করতে পারেনা। প্রথম জীবনের মায়ার বাঁধনকে অগ্রাহ্য করতে পারে না সে।
৬
চির-বাউ-ুলে স্বভাবের আড্ডাবাজ সাহিত্যিক ইকবাল হাসান কোনো স্বীকৃতি, পুরস্কার বা বাহবা পাবার জন্য সাহিত্য রচনা করেননি বরং একজন জাত-সাহিত্যিকের মতো ব্যক্তিগত প্রণোদনা থেকেই সাহিত্য রচনা করে গেছেন। তাঁর লেখনীর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো তিনি কাউকে অনুকরণের চেষ্টা না করে জীবন সম্পর্কে নিজের ব্যক্তিগত অনুভবকে সাহিত্যে তুলে ধরেছেন। আটপৌরে ভাষায় সাবলীল গদ্যে রচিত ইকবাল হাসানের ছোটগল্প গুলো বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে অপশাসনের যেই দুষ্টচক্র সবকিছু গ্রাস করে যাচ্ছে তার প্রকৃত আয়না হিসেবে ধরা দিয়েছে। এদেশের সাহিত্যের একান্ত সুহৃদ ইকবাল হাসান তাঁর লেখনীর যথাযথ মূল্যায়ন পাননি ঠিকই কিন্তু একজন নিষ্ঠাবান সাহিত্যিক হিসেবে তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।
তথ্যঋণ
১। খোন্দকার আশরাফ হোসেন (অনূদিত), সাহিত্যতত্ত্ব, টেরি ঈগলটন, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ২০০৪
২। ইকবাল হাসান, গল্পসমগ্র, রয়েল পাবলিশার্স, ঢাকা, ২০১২
৩। ইকবাল হাসান, নির্বাচিত গল্প, ধ্রুবপদ পাবলিকেশন, ঢাকা, ২০১৭
৪। কালের প্রতিবিম্ব, শিল্প-সাহিত্যের কাগজ, বর্ষ ১১, সংখ্যা ২; ঈদুল আজহা সংখ্যা ২০২৩
প্রাবন্ধিক বাংলাদেশে সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল গবেষক।