উন্নতবিশ্বে প্রধান নির্বাহীর লাগামহীন বেতন  

নিরঞ্জন রায়

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে একটি সাধারণ কথা প্রচলিত আছে যে এসব কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান যা খুশি তাই করতে পারে। এক মালিকানা কোম্পানি তো বটেই, লিমিটেড কোম্পানি বা নিবন্ধিত কর্পোরেশন বলে খ্যাত যে সব প্রতিষ্ঠান আছে, তারাও তাদের ইচ্ছামত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অথচ লিমিটেড কোম্পানি বা নিবন্ধিত কর্পোরেশনের অনেক আইন এবং বিধিবিধান মেনে চলার বাধ্যবাধকতা আছে। অবশ্য এসব নিয়ম এবং আইনকানুন মূলতে কাগজেকলমে থাকলেও বাস্তবে খুব কমই মেনে চলা হয়। যতটুকু মেনে চলতে দেখা যায়, যেমন – কিছু মেধাবিদের নিয়োগদান, পণ্য বা সেবার মান একটা পর্যায়ে রাখা বা বাজারমূল্য, তা মূলত নিয়মের বাধ্যবাধকতার কারণে নয়, বরং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে টিকে থাকার স্বার্থে মার্কেট ফোর্সের কারণে।

আমাদের দেশে একটি কোম্পানির মালিক, চেয়ারম্যান বা বোর্ড যেভাবে চাইবেন সেভাবেই তাঁরা প্রতিষ্ঠান চালাবেন। যাকে চাইবেন, তাকেই প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবেন। একারণেই দেখা যায় যে একজন প্রধান নির্বাহী সেই কোম্পানি, গ্রাহক বা অর্থনীতির চেয়ে মালিক পক্ষ বা চেয়ারম্যানের স্বার্থ রক্ষার জন্য বেশি ব্যাস্ত থাকেন। বিনিময়ে প্রধান নির্বাহীর বেতনও থাকে মাত্রাতিরিক্ত। একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীকে যে পরিমাণ বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়, তার সামান্যতম অংশও দেয়া হয়না নিচের সারির কর্মকর্তাদের। অনেকের ধারণা আমাদের দেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চপদস্থ নির্বাহীদের সাথে নিচের সারির কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতায় আকাশপাতাল পার্থক্য। কিন্তু তাদের হয়ত উন্নতবিশ্বের বেতন-ভাতার তারতম্যের মাত্রা সম্পর্কে সেরকম ধারণা নেই। আমাদের দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বেতন-ভাতার পার্থক্য অন্তত তুলনা করা যায়। যেমন, আমাদের দেশের একটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর বেতন যদি হয় মাসে ১২ লাখ টাকা, সেই ব্যাংকের নিচের সারির কর্মকর্তার বেতন মাসে ৪০ হাজার টাকা। অথচ উন্নতবিশ্বে বেতন ভাতার তারতম্য এতই বেশি যে এর মধ্যে তুলনা করার সুযোগ কম। যেমন  উন্নতবিশ্বে, বিশেষ করে আমেরিকা-কানাডায় একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর বেতন যদি হয় বছরে ১২ মিলিয়ন বা ১ কোটি ২০ লাখ ডলার, সেই ব্যাংকের নিচের সারির একজন কর্মকর্তার বেতন বছরে প্রায় ৪০ হাজার ডলার।

উন্নতবিশ্বে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর ১২ মিলিয়ন ডলার বেতন একেবারেই সাধারণ ঘটনা। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে প্রধান নির্বাহীর বেতন বছরে এক বিলিয়ন ডলারের উপরে। এমনকি দু-একজন প্রধান নির্বাহীর বেতন-ভাতা ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এক্ষেত্রে অবশ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বিশ্বের সবচেয়ে অন্যতম ধনি ব্যাক্তি এলন মাস্ক, যার বাৎসরিক বেতন-ভাতা হতে চলেছে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এলন মাস্ক হচ্ছেন আমেরিকার ইলেকট্রিক গাড়ি প্রস্তুতকারি কোম্পানি, টেসলার প্রধান নির্বাহী। সম্প্রতি টেসলার পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানির প্রধান নির্বাহী, এলন মাস্কের জন্য বেতন-ভাতা নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছে এক ট্রিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২৫ লাখ কোটি টাকা। বিষয়টি এই মুহূর্তে বিশ্ব গণমাধ্যমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর হলেও বিষয়টি নিয়ে সেই মাত্রার আলোচনা বা সমালোচনা নেই বললেই চলে।

তথ্যের একটা সুবিধা হচ্ছে যে বিশ্লেষক নিজের মত করে এটি ব্যবহার করতে পারে। যেজন, উন্নত জীবনের সংজ্ঞা নির্ধারণের মাপকাঠি হিসেবে যদি মাথাপিছু গড় আয়, বা গড় খাদ্য গ্রহণের পরিমাণকে বিবেচনায় নেয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে যে উন্নত বিশ্বের মানুষের জীবনমান যথেষ্ট উন্নত, আর উন্নয়নশীল বিশ্বের মানুষের জীবনমান খুবই খারাপ। কিন্তু যদি মাথাপিছু গড় ব্যাক্তিগত ঋণের পরিমাণ বিবেচনায় নেয়া হয়, তখন দেখা যাবে যে উন্নত বিশ্বের মানুষের অবস্থা ভয়াবহ, কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বের মানুষের অবস্থা যথেষ্ট ভাল। সেরকম অবস্থাই হয়েছে এলন মাস্কের বেতন-ভাতার বিষয়টি। কেননা এক ট্রিলিয়ন ডলারকে এমনভাবে বলা হচ্ছে তাতে খুব সহজেই মনে হতে পারে যে টেসলার প্রধান নির্বাহী বছরে এক ট্রিলিয়ন ডলার বেতন পাবেন। বিষয়টি মোটেই সেরকম নয়। এখানে অনেক হিসাবনিকাশ আছে এবং অনেক অংক মিলানোর বিষয় জড়িত।

টেসলার পরিচালনা পর্ষদ প্রধান নির্বাহীর বেতন-ভাতা যে এক ট্রিলিয়ন ডলার নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে, তা মূলত আগামি দশ বছরের জন্য প্রাপ্য বেতন-ভাতার সর্বোচ্চ সীমা। এখানে বলে রাখা ভাল যে উন্নতিবিশ্বে, বিশেষ করে আমেরিকা-কানাডায় প্রধান নির্বাহীর মোট বেতন-ভাতার খুব সামান্য অংশই থাকে নগদ এবং বেশির ভাগ থাকে সেই কোম্পানির শেয়ারের অংশ। একারনেই এখানে প্রধান নির্বাহীর বেতন-ভাতাকে কমপানসেশন প্যাকেজ বলা হয়। এলন মাস্কের যে এক ট্রিলিয়ন ডলারের কমপানসেশন প্যাকেজ নির্ধারণ করা হয়েছে, তা বেশ শর্তসাপেক্ষ। এলন মাস্ক টেসলাকে এমনভাবে পরিচালনা করবেন যাতে করে আগামি দশ বছরে এই কোম্পানির বাজার মূলধন (মার্কেট ক্যাপিটাল) ৮.৫ ট্রিলিয়ন ডলার হয়। মাস্ক যদি ৮.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের বাজার মূলধনের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন, তাহলেই তিনি পাবেন কোম্পানির ১২% শেয়ারমুল্য, যা মূলত এক ট্রিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। আগামি দশ বছরের মধ্যে মাস্ক যদি এই লক্ষ্য অর্জনে সফল হন, তাহলেই তিনি এই ট্রিলিয়ন ডলারের কমপানসেশন প্যাকেজ পাবেন। আর যদি এই লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হন, তাহলে কি হবে, সেটা হয়ত সময় বলবে।

এলন মাস্ক যে মাপের ক্যারিসম্যাটিক মানুষ, তাতে এই লক্ষ্য তার পক্ষে অর্জন করা হয়ত কঠিন হবে না। ২০১৮ সালে যখন এলন মাস্কের কমপানসেশন প্যাকেজ নির্ধারণ করা হয়েছিল তখনও তাকে শর্ত দেয়া হয়েছিল যে আগামি দশ বছর সময়ের মধ্যে তিনি টেসলার বাজার মূলধন ৬০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৬৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নিত করবেন, যা তিনি অনেক আগেই করে ফেলেছেন। বর্তমানে এই কোম্পানির বাজার মূলধন এক ট্রিলিয়ন ডলারের উপরে। তাই বিনিয়োগকারী এবং শেয়ার মালিকদের যথেষ্ট আস্থা আছে তাদের কোম্পানির প্রধান নির্বাহীর উপর এবং তারা এলন মাস্কের প্রস্তাবিত এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেতন-ভাতা নিয়ে খুব একটা আপত্তি হয়ত জানাবেন না। এখানে আরও একটি শর্ত আছে। একটি মূলত শর্ত না হলেও কোম্পানির বাজার মূলধন উন্নতি করার লক্ষ্য পূরণ করতে হলে তাঁকে এই কাজটি করতে হবে। এই শর্ত অনুযায়ী মাস্ক নেতৃত্ব দিয়ে বছরে ২০ বিলিয়ন বা দুই কোটি ইলেকট্রিক গাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা করবেন। ত্রিশ কোটি জনসংখ্যার দেশ আমেরিকায় বিশ্বের সব গাড়ি প্রস্তুতকারীর বাজার আছে। সেখানে বছরে দুই কোটি ইলেকট্রিক গাড়ি কিভাবে বিক্র হবে সেই প্রশ্ন অবশ্য অনেকেই তুলছেন। তবে উঠতি বয়সী তরুণদের টার্গেট করে এই কাজটি করা সম্ভব বলেই অনেকের ধারণা।

তরুণরা এক ধরনের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাতেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে এবং তারা লাভক্ষতির হিসাব না করে এক ধরণের কৃত্রিম ইমেজ দারাই বেশি প্রভাবিত হয়। মাসে তেল খরচ বাবদ একশ ডলার সাশ্রয় করার জম্য টেসলার ইলেকট্রিক গাড়ি কেনার জন্য আগ্রহি হবে, অথচ এই গাড়ির মুল্য বাবদ যে বিশ হাজার ডলার বেশি দিতে হবে, সেই হিয়াব একেবারেই করেনা। আসলে এরকম হিসাব করে আমেরিকা-কানাডার নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা চলে না। বরং তারা একটু হুজুকেই চলে। আর এলন মাস্করা তাদের এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই কোম্পানিকেও ট্রিলিয়ন ডলারের মুল্যে নিতে পারে এবং সেই সাথে নিজেরাও বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মালিক হতে পারে।

যে হিসাবনিকাশের মাধ্যমেই হোক, আর যে শর্ত পূরণ সাপেক্ষেই হোক না কেন, টেসলার প্রধান নির্বাহী হিসেবে এলন মাস্ক যে আগামি দশ বছরে এক ট্রিলিয়ন ডলার বেতন-ভাতা পাবেন, সেটাই এখন বাস্তবতা। এই বিশাল অংকের বেতন ভাতা আগামি দশ বছরের জন্য হলেও টেসলাকে প্রধান নির্বাহীর বেতন-ভাতা বাবদ প্রতি বছর ১১৪ বিলিয়ন ডলার খরচ দেখাতে হবে। অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থে টেসলার প্রধান নির্বাহী এলন মাস্কের বাৎসরিক বেতন হবে একশত বিলিয়ন ডলারের বেশি। এর আগে এলন মাস্কের বেতন ভাতা যখন ৫০ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছিল তখন বিষয়টি আমেরিকার একটি রাজ্যের আদালত পর্যন্ত গিয়েছিল, যেখানে বিচারক বিষয়টি নিয়মবহির্ভূত আখ্যা দিয়ে রায় দিয়েছিলেন। বিষয়টি উচ্চ আদালতে আপিল কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। পরবর্তীতে সম্ভবত আইন পরিবর্তন করায় এখন হয়ত এত বিশাল অংকের বেতন-ভাতা দেয়ার ক্ষেত্রে কোনরকম আইনি জটিলতা দেখা দিবে না।

টেসলার প্রধান নির্বাহী, এলন মাস্কের যে ট্রিলিয়ন ডলারের বেতন ভাতা নির্ধারণ করা হয়েছে, এই পরিমাণ জাতীয় বাজেটও বিশ্বের অধিকাংশ দেশের নেই। শুধু তাই নয়, এই বিশাল অংকের বেতন-ভাতা যে দেশের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীকে প্রদান করা হবে, সেই আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশ হলেও দেশটি রাষ্ট্রীয় ঋণে জর্জরিত। আমেরিকা এমন একটি দেশ, যেখানে অর্থনীতির আকারের চেয়ে রাষ্ট্রীয় ঋণের পরিমাণ বেশি। এমনকি এখানকার মানুষের ব্যাক্তিগত ঋণের পরিমাণ মোট উপার্জনের চেয়ে অনেক বেশি। এরকম অবস্থায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী পাবেন আগামি দশ বছরে এক ট্রিলিয়ন ডলার বেতন-ভাতা। বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের মত দেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর বেতন-ভাতা মাত্রাতিরিক্ত বেশি হলেও, উন্নত বিশ্বে তা একেবারে লাগামহীন, যার বড় উদাহরণ হচ্ছে এলন মাস্কের এক ট্রিলিয়ন ডলার বা ১২৫ লাখ কোটি টকার বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা।

নিরঞ্জন রায়, CPA, CMA, CAMS
সার্টিফাইড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিষ্ট ও ব্যাংকার।
টরনটো, কানাডা
Nironjankumar_roy@yahoo.com