একজন নভোচারীর সাথে প্রাতরাশ

শেখর কুমার সান্যাল

উন্মাদনায় ভরা কাউবয় জীবনের রোমাঞ্চময় ঐতিহ্য স্মরণে প্রতি গ্রীষ্মে জুলাই মাসের প্রথমার্ধে দশদিন ব্যাপী জাঁকজমকপূর্ণ এক উৎসবের আয়োজন হয় ক্যালগেরী শহরে। কানাডীয়ান ওয়েস্টের কেন্দ্রে ম্যাজেস্টিক রকি মাউন্টেইন থেকে মাত্র ঘন্টাখানেকের দূরত্বে ক্যালগেরী শহরে সমস্ত পৃথিবী মিলিত হয় বুনো পশ্চিমের (Wild West) সাথে। ওয়েস্টার্ন হেরিটেজ উদ্‌যাপনের এই আয়োজন ‘ক্যালগেরী স্ট্যামপিড’ নামে ভুবনবিখ্যাত। ক্যালগেরীবাসী এই উৎসবকে ‘গ্রেটেস্ট আউটডোর শো অন আর্থ’ বলে দাবি করে। সে সময় বিভিন্ন কমিউনিটি এবং প্রতিষ্ঠান ‘স্ট্যামপিড ব্রেকফাস্ট’ আয়োজন করে।

ইসমাইলিয়া মুসলিম কমিউনিটিও তাঁদের সপ্তদশ বার্ষিক স্ট্যামপিড ব্রেকফাস্টের আয়োজন করেছিলেন ক্যালগেরী ইসমাইলি সেন্টারে। CNRL-এর কয়েকজন সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার সেখানে সপরিবারে আমন্ত্রিত। জ্যেষ্ঠ পুত্র জয়দীপের সাথে আমি এবং জ্যেষ্ঠ পৌত্র তীর্থদীপ নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিলাম। ডীয়ারফুট ট্রেইল ও ম্যাকনাইট বুলেভার্দের কোণে অনেক উঁচুতে ইসমাইলি জামাতখানার উন্মুক্ত উদ্যানে একটি ছোটো খোলা মঞ্চ। দূরে অনেক নিচে ডাউনটাউনে হাইরাইজের সারি। একপাশে তিনটি তাঁবু থেকে মেয়েরা চা, কফি ও কোমল পানীয় পরিবেশন করছে। অন্য পাশে সারি সারি সার্ভিস স্টেশানে ব্রেকফাস্টের প্রস্তুতি চলছে। সামনে অনেকটা জায়গা ফাঁকা রেখে একটা বড়ো তাঁবুতে অতিথিদের বসার ব্যবস্থা। অতিথিরা পছন্দের পানীয় হাতে মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করছেন। বিশিষ্ট অতিথিরাও রয়েছেন।

প্রধান আকর্ষণ সস্ত্রীক নভোচারী কমান্ডার ক্রিস হ্যাডফিল্ড। সাথে আলবার্টার প্রিমিয়ার মিসেস অলিসন রেডফোর্ড ও ক্যালগেরীর মেয়র নাহিদ নেনসী। সদালাপী হ্যাডফিল্ড ঘুরে ঘুরে সবার সাথে কথা বলছিলেন। আমিও দু’তিন মিনিট আলাপের সুযোগ পেলাম। আটটায় মঞ্চে উঠে কয়েকটি কথা বললেন প্রিমিয়ার হাস্যময়ী অলিসন রেডফোর্ড। এর পরেই এলেন ১০১তম ক্যালগেরী স্ট্যামপিডের প্যারেড মার্শাল দীর্ঘ সুঠামদেহী হ্যাডফিল্ড। সামান্য কয়েকটি কথায় তিনি সবাইকে মোহিত করে গেলেন। বিশেষ করে তাঁর দু’টি কথা ছিল অসাধারণ।

“Talk to as many people as possible. Every single person you ever meet knows something you don’t know”  

তিনি আরও বললেন, মহাশূন্য অভিযানে গিয়ে তাঁর মনে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। পৃথিবী পরিক্রমার সময় তাঁর মনে হতো এই সুন্দর গ্রহের বাসিন্দাদের মধ্যে যদি কোন বিভেদ না থাকত তবে আমরা ‘এক’ মানবজাতি হয়ে এই সুন্দর পৃথিবীতে বাস করতে পারতাম।

হ্যাডফিল্ডের জন্ম ওন্টারিওর সারিনায় এক খামারবাড়িতে ১৯৫৯ সালের ২৯শে আগস্ট। কৈশোরে টেলিভিশানে এ্যাপোলো নভোযানের চন্দ্রে অবতরণের দৃশ্য দেখে তিনি নভোচারী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। ২০১৩ সালের ২০শে জুলাই তিনি টুইটারে লেখেন-

“44 years ago today Mike, Buzz & Neil took us to the Moon. They inspired me like no other. Eternal thanks.”

কানাডার রয়েল মিলিটারি কলেজ থেকে অনার্স সহ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েট। আমেরিকার টেনেসী ইউনিভার্সিটি স্পেস ইনস্টিটিউট থেকে এভিয়েশান সিস্টেমে মাস্টার্স। এ ছাড়াও কর্মজীবনে এভিয়েশান ও মহাশূন্য কর্মসূচী সম্পর্কিত অজস্র উচ্চতম মানের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কানাডীয়ান এয়ারফোর্সের কর্নেল হিসেবে পঁচিশ বছরের মিলিটারি সার্ভিস শেষ করে ২০০৩ সালে কানাডা স্পেস এজেন্সীতে সিভিলিয়ান এস্ট্রোনট হিসেবে যোগ দেন। আমেরিকার নাসা এবং রাশিয়ার ইউরী গ্যাগারিন কসমোনট সেন্টারে শীর্ষপদে থেকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ১৯৯৫ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে তিনটি মহাশূন্য অভিযানে অংশ নিয়েছেন। সর্বশেষ মহাশূন্য মিশানে তিনি প্রথম কানাডীয়ান হিসাবে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশান কমান্ড করেছেন এবং সাড়ে পাঁচ মাস মহাশূন্যে থেকে ২০১৩ সালের ১৩ই মে সয়্যুজ ক্যাপসুলে করে কাজাখাস্থানের স্তেপে অবতরণ করেন। ১১ই মে হ্যাডফিল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশান থেকে টুইটারে লিখলেন-

“Good Morning, Earth! Today I proudly hand command of Space Station to Pavel Vladimirovich Vinogradov. Time to rev up the Soyuz, home tomorrow.”

মহাশূন্য অভিযানে তিনি দেড় ঘন্টায় একবার করে ২,৩৩৬ বার পৃথিবী পরিক্রমা করেন এবং ৯৯.৮ মিলিয়ন কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন। ১৪ ঘন্টা ৫০ মিনিট মহাশূন্যে পদচারণা করে দশ বার পৃথিবীকে ঘুরে এসেছেন। এমন কৃতিত্ব অর্জনকারী প্রথম কানাডীয়ান হ্যাডফিল্ড। তিনি মহাশূন্য থেকে পৃথিবীর ছবি তুলে টুইটারে ও ফেসবুকে পোস্ট করেছেন এবং মহাশূন্য থেকে গিটার বাজিয়েছেন। সংগীতানুরাগী হ্যাডফিল্ডের ‘ড্যানি বয়’ ও ‘জুয়েল ইন দ্য নাইট’ নামে দু’টি গানের এ্যালবাম আছে। তাঁর প্রথম গান ‘জুয়েল ইন দ্য নাইট’ মহাশূন্যে রেকর্ড করে ২০১২ সালের খ্রিষ্টমাস ইভে ইউ-টিউবের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। তিনি মঙ্গলগ্রহে মনুষ্যবাহী মহাকাশযান প্রেরণে খুবই আশাবাদী। ২০১১ সালে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল প্রথম মানুষ হিসাবে তিনি মঙ্গলগ্রহে ‘one-way’ যাত্রায় আগ্রহী কি না। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন-

“I would be honoured to be given the opportunity”                                                                                                                             

দেশে এবং বিদেশে তিনি অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। একটি গ্রহানুর নাম ‘গ্রহাণু ১৪১৪৩ হ্যাডফিল্ড’ রাখা হয়েছে তাঁর সম্মানেই । ক্যালগেরী স্ট্যামপিডের প্যারেড মার্শাল হওয়ার আমন্ত্রণে তিনি  মহাশূন্য থেকেই সম্মতি জ্ঞাপন করেছিলেন। স্ত্রী হেলেন এবং তিন সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার। হ্যাডফিল্ড ২০১৩ সালের ৩রা জুলাই মহাশূন্য কর্মসূচী থেকে অবসর নিয়ে দু’দিন পরেই (৫ জুলাই) স্ট্যামপিড প্যারেডে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরদিন ভোরে তিনি টুইটারে লিখেছিলেন-

“Good morning! Hope to see you at the 17th Annual Ismailia Muslim Community Stampede Breakfast, supporting Boys & Girls Club of Calgary.”

সবার সাথে কিউয়ে দাঁড়িয়ে তিনিও প্রাতরাশ নিলেন। বর্ণাঢ্য রোমাঞ্চময় জীবনের অধিকারী একজন অসমসাহসী বিশ্ববিখ্যাত মানুষের সান্নিধ্যে স্মরণীয় একটি সকাল কাটল।