এক কাপ চায়ে আমি…তোমাকে চাই

শ্রেয়সী বোস দত্ত

চায়ের মাদকতা ঠিক কিসে? শুধুই কি তার স্বাদে গন্ধে বর্ণে নাকি আসল রোম্যান্স লুকিয়ে আছে প্রাত্যহিক অভ্যাসের আমেজে? চা আমাদের যাপনের সাক্ষী – সে একাকী যাপনই হোক অথবা যৌথ । “ওর কিন্তু খুব চায়ের নেশা” কথাটার মধ্যে বেশ একটা আদুরে প্রশ্রয় আছে, তিরস্কার বা সামাজিক অননুমোদন নেই। চায়ের নেশা বেশ আটপৌঢ়ে অথচ অন্তরঙ্গ একটা ব্যাপার – বলা যায় প্রতিদিনের চা-পান এমন একটা আচারানুষ্ঠান যা সাক্ষী থাকে আমাদের দৈনন্দিনতার, আর যা ক্রমে হয়ে ওঠে স্মৃতি ও অনুভূতির একেকটি খণ্ড। ‘চায়ের আড্ডা বলতে কী মনে আসে?’ এই প্রশ্ন করাতে আমার মা খুব আগ্রহ সহকারে যা জানালেন তাই নিচে লিখলাম।

চায়ের আড্ডা বা চা পান করা প্রসঙ্গে কিছু বলা আমার কাছে যেন বসন্তের সুমিষ্ট সুবাসিত বাতাস। এই প্রস্তাবে মনে অনেক খুশীর বার্তা ভীড় করে এসে মনকে যেন তোলপাড় করে দিল। কিন্তু এই প্রসঙ্গে কিছু বলতে হলে অতীতের স্মৃতির পাতা খুলতে হবে, এই যেমন সন্ধ্যেবেলায় প্রদীপ জ্বালানোর আগে সকালবেলায় সলতে পাকানোর আয়োজন।

আমি যৌথ পরিবারের মেয়ে। আমার ছোটবেলা কেটেছে মেদিনীপুর ও কলকাতায়। মনে আছে, মেদিনীপুরে মা কাকীমারা ভোরের চা তৈরী করতেন যে যার নিজেদের ঘরে ইলেক্ট্রিক হীটার বা স্টোভ জ্বেলে। যদিও তখন আমরা ভাই-বোনেরা খুব ছোট, তাও মনে আছে, ভোরের চা আরাম করে না খেয়ে বড়রা তাঁদের সাংসারিক দায় দায়িত্বে এগোতেন না । তারপর দিনের মধ্যে আরো কতবার চা হতো! জায়েরা মিলে বেলায় কাজ সেরে চায়ে চুমুক। তাছাড়া ফরমায়েসী চা ও তৈরী হতো দফায় দফায়। বড় ঠাকুমাকে একটু বেলার দিকে তাঁর পুজো ইত্যাদি সম্পন্ন হওয়ার পর পাথরের গ্লাসে গরম চা বিস্কুট দিয়ে আসা হতো। কলকাতা তে শ্রদ্ধানন্দ পার্কের সামনে আমরা থাকতাম। আমার বাবা ছিলেন শিক্ষক। আমাদের বাড়ির নীচে বাবার একটা প্রেস ছিল; নাম “এন আই”। সেই সূত্রে প্রতি সন্ধ্যেয় ক’জন প্রেসের কাকা-জ্যাঠারা চায়ের আড্ডা বসাতেন। সাথে চলত বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা। জমজমাট পরিবেশ তৈরী হতো চায়ের সাথে।  

স্থান কাল পাত্র ভেদে চায়ের আড্ডার কত যে পরিবর্তন হয় তা বেশ উপলব্ধি করেছি। আমার বাবা একসময় সোদপুরে যান প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার গ্রহণ করে। তিনি, শিবপ্রসাদ নাগ, ছিলেন শিক্ষক, লেখক ও সাংবাদিক। এই কারণে প্রায়ই বাড়িতে গুণীজনের সমাগম হতো আর চা পর্ব চলত দফায় দফায়। এই প্রসঙ্গে আরো কিছু বলার আগে আমার মায়ের চা প্রিয়তার বিষয়ে আবার ফিরতে চাই। আমার মাসিদের কাছে শুনেছি মা খুব গরম গরম চা খেতে পছন্দ করতেন। ভাগলপুরে আমার মামার বাড়ি। কোনও বিশেষ উপলক্ষে বিবাহিত বোনেরা যখন একসঙ্গে বাপের বাড়ি যেতেন, তখন জমাটি চায়ের আড্ডা হতো। দোতলায় শোওয়ার ঘরে দিদিমা বাড়ির পরিচারক মুন্নাকে দিয়ে সবার জন্য চা ও মুখরোচক কিছু খাবার পাঠিয়ে দিতেন । মা চা’য়ে চুমুক দিয়ে বলতেন “চা ঠান্ডা হয়ে গেছে গরম করে নিয়ে আয়।“ বিহারী পরিচারক মুন্না একটুও বিরক্ত না হয়ে আবার গিয়ে গরম করে ওপরে পৌঁছে দিত চা। কোনও রকম বিরক্ত না হয়ে বোনেরা তাদের মেজদির এই গরম চায়ের আবদার নিয়ে হাসাহাসি করতেন। আমরা দেখেছি বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নের জন্য মা সবসময় চা ও নোনতা কিছু দিয়ে শুরু করতেন ও তারপর অন্য খাবারের আয়োজন করা হতো। নিজে চা খেতে পছন্দ করতেন বলে সবাইকে চা খাওয়াতে ভালোবাসতেন।  

সোদপুরের বাড়িতে চায়ের আড্ডায় আমরাও যুক্ত হতাম। ভোরের চা পানে একটু ব্যস্ততা থাকত সবারই, স্কুল কলেজ বা য যার কাজে যাবার জন্য কিন্তু বিকেলে সকলে বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে বসে চা খেতে খেতে গল্প করার আনন্দই ছিল আলাদা। থাকত একটা ভালো লাগার আমেজ। আমাদের বাড়িতে চায়ের বিরাট জমাটি আড্ডা হতো প্রতি রবিবার বিকেলবেলায়, যা চলত প্রায় রাত্রি ন’টা সাড়ে ন’টা পর্যন্ত। বাবার কাছে অনেক জ্ঞানী গুনী পরিচিত ব্যক্তিরা আসতেন এবং নিয়ম করে প্রতি রবিবার বসত বিভিন্ন আলোচনাচক্র ও চিন্তার আদান প্রদান, যার একটা বড় অংশ ছিল নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আদর্শ, তাঁর কর্মকানণ্ড, তাঁর অন্তর্ধান ও তাঁর চিন্তা-ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান অবস্থার বিশ্লেষণ। মেঝেতে কার্পেট বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা হতো আর দফায় দফায় সরবরাহ করা হতো প্রায় ৩০-৩৫ কাপ চা। এর আয়োজন করা হতো রবিবার সকাল থেকেই – সমস্ত উপকরণ যথেষ্ঠ পরিমাণে মজুত আছে কি না দেখা, কিছু কিনে আনতে হলে ছুটে গিয়ে পাড়ার দোকান থেকে আনা, কাপ প্লেট হাতের সামনে রাখা। মা’কে সাহায্য করতাম আমরা – বোনেরা। রবিবারের দিনটা বাবার চায়ের আড্ডাকে কেন্দ্র করে বাড়িতে বেশ একটা ব্যস্ততার ভাব থাকত। মাঝে মাঝে রাত সাড়ে নটার পরও কয়েকজন বসে থাকতেন, তখন “আরেকবার চা হবে নাকি?” শুনলেই আমরা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। আরেকবার চা মানে তো আরও একঘন্টার আড্ডা আর তার মানে আমাদের রাতের খাওয়া বা রান্নাঘরয়ে সব গুছিয়ে তোলার সময়ও এক ঘন্টা পিছিয়ে যাওয়া।

আমার মা চায়ের কাপ হাতে নিলে খুব খুশী হতেন। আমরা যখন বিয়ের পর কলকাতা থেকে কোনও উপলক্ষে সোদপুর যেতাম, ফিরে আসার দিন দুপুরবেলা কলকাতা ফেরার ট্রেন ধরার তাড়া থাকত। ব্যস্ত হয়ে গোছগাছ করতাম। হঠাত দেখতাম মা থালায় করে বেশ কয়েক কাপ চা নিয়ে হাজির হতেন। রওনা হওয়ার আগে একটু চা খেয়ে যাই আমরা সেই ভেবে নিজে বিশ্রাম না নিয়ে আমাদের চায়ের জোগাড় করতেন।

আ্মার জীবন সঙ্গীরও ছিল চায়ের প্রতি আসক্তি। এক কাপ চা হাতে পেলেই মুখে আসত আরামের মৃদু হাসি। অফিসের দিনে প্রধান চা-পর্ব হতো অফিস থেকে বাড়ি আসার পর, স্নান সেরে আরাম করে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে। সারাদিনের ঘটনা নিয়ে আড্ডা দিতে দিতে আমরা চা খেতাম। ছুটির দিনে চায়ের পরিবেশ পালটিয়ে যেত। ভোরবেলায় হাত মুখ ধোওয়ার পর চা নিয়ে বসে বেশ অলস ব্যস্ততাহীন চা-পর্ব চলত। টুকটাক কথা আর থিন্যারারুট বিস্কিটের সাথে ভোরের শান্ত পরিবেশও উপভোগ করতাম। ছুটির দিনে অন্তত চার বার চা হতো বাড়িতে। তাছাড়া বাইরে বেরোলে তো কথাই নেই। গড়িয়াহাটে কেনাকাটা করতে বেরিয়ে পথে ধারে চায়ের দোকান থেকে মাটির ভাঁড়ে চা খেতে বেশ একটা এক্সাইটমেন্ট লাগত। আমরা দুজন ছাড়াও আরো কত লোক পাশে দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে আড্ডা দিত। কোনও ক্যাফেতে বসে চা খাওয়ার থেকে রাস্তার দোকান থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লোক দেখতে দেখতে চা খেতে আমাদের বেশী ভালো লাগত। চা তার এত প্রিয় ছিল যে কারোর বাড়ি গিয়ে চা খেতে না দিলে, সে অন্য যত খাবারই খাওয়া হোক না কেন, বাড়ি এসে তাকে এক কাপ চা খেতেই হতো। সে তখন রাত্রি দশটা বেজে গেলেও।

আর যেই চায়ের আড্ডার কথা খুব মনে পড়ে সেটা হলো আমার ননদের বাড়ি জামসেদপুরে। অনাবিল আনন্দের সেইসব চা পর্বে চলত সুদৃশ্য কাঁচের টী পট থেকে দফায় দফায় চা ঢেলে তিন চার রকমের বিস্কিট বা মুখরোচক টা সহযোগে। আর চলত তুমুল আড্ডা বিভিন্ন বিষয়ে। বিহারে তখন রাবড়ি দেবীর রাজ চলছে তাই আমাদের আড্ডাতেও ছেয়ে থাকতেন তিনি ও লালু প্রসাদ। ননদ ছিলেন হাই স্কুলের শিক্ষিকা আর ওনার এক সহকর্মী হয়ে উঠেছিলেন রীতিমতো পরিবারের সদস্যের মতো অন্তরঙ্গ। তিনিও থাকতেন আমাদের আসরে নিয়মিত।  

মনে পড়ে বেড়াতে গিয়ে চা খাওয়া, বিশেষ করে ট্রেনে। আগে ট্রেনে মাটির ভাঁড়ে চা দিত। তখনও প্লাস্টিকের কাপের এত চল ছিল না। প্রচণ্ড গরম সেই চা ট্রেন চলাকালীন দুলতে দুলতে খাওয়ার আলাদা মজা ছিল। ট্রেনের প্রচণ্ড দুলুনিতে হাত থেকে চলকে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকত কিন্তু সেই গরম ভাঁড় অতি সাবধানতার আর বিশেষ নিপুনতার সাথে ঠোঁটে নিয়ে চুমুক দেওয়ার আরামই আলাদা। জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে ওই চা খাওয়া – চোখ বুজলেই মনে ভেসে ওঠে। আবার আশে পাশের কোনও জানলা থেকে চায়ের ভাঁড় ট্র্যাকে ফেলেছে আর অবশিষ্ট চা হাওয়ায় উড়ে আমাদের মুখে এসে পড়েছে এমনও হয়েছে। কী রেগে যেতাম এমন হলে! একবার মনে আছে কোথাও একটা বেড়াতে গিয়ে সাথে একটা ছোট স্টোভ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হোটেল রুমে চা বানিয়ে খাওয়া হবে বলে। সেই কী এডভেনচার! আমরা তিন চারজন বোন পরিবারসুদ্ধু গেছি। একটা ঘরে দরজা বন্ধ করে স্টোভ জ্বালানো হয়েছে। আমার পরের বোন বরুণা এক কোনায় স্টোভ জ্বালিয়ে একটা ছোট সসপ্যানে জল বসিয়েছে। একেকবারে মাত্র কয়েক কাপ করে হচ্ছে আর বোনপো বোনঝিদের মধ্যে একজন গিয়ে অন্য ঘরে চালান করে আসছে। বেচারা আমার বোন সারা সন্ধ্যে এই দফায় দফায় চা বানাতেই কাটিয়ে দিয়েছে।

এখন চা-পর্বের প্রধান সঙ্গী আমি নিজেই। জীবনের পথ চলতে চলতে কালের নিয়মে যেই অন্তরঙ্গ প্রিয় সঙ্গীদের হারিয়েছি, এখন ভোরের চা-পানে তারা হাজির হয় স্মৃতির পাখায় ভর করে। এখন কথা মনে মনে হয় । গরম চায়ের চুমুক দিতে দিতে খোলা জানালা দিয়ে নীল আকাশ দেখেতে দেখতে নিঃশব্দে তাদের দর্শনাতীত উপস্থিতি উপভোগ করি। এখন মেয়ে জামাইয়ের কাছে কানাডায় চায়ের আড্ডায় সংযোজিত হয়েছে একটি নতুন মাত্রা – টিম হরটনস। প্রতীকী এই ক্যাফের চা বা কফি আমাদের নিত্যসঙ্গী এবিং সেই সূত্রে, আমার কিছু অনুভূতি ও স্মৃতির ধারকও। মনে আছে প্রথম কানাডায় যখন এলাম, তখন সদ্য হারিয়েছি আমার জীবনের প্রধান মানুষটিকে। টিম হরটনসের টেবলে বসে তখন এক অদ্ভূত বিষাদের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল মনে। মনে হচ্ছিল চা-প্রিয় সেই প্রিয় মানুষটি আমার পাশে টিম হরটনসে কফি নিয়ে বসতে পারতেন, নিশ্চই তৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে থাকত তাঁর মুখখানি।

এখন চায়ের আড্ডা বলতে টিম হরটনসও যোগ হয়েছে আমার চেতনায়, তবে সেই গল্প অন্য এক দিন।

এ তো গেল মায়ের কথা। আমি নিজে ঠিক চা-রসিক নই, কিন্তু চা-পানকে ঘিরে স্মৃতি বা অভ্যাসগুলি আমার মনের খুব কাছের। আমার মনে আছে বড় হয়ে ওঠার সময় আমার চা খাওয়ার অনুমতিই ছিল না । কিন্তু তাও দিনে ঠিক কখন বাবা মা চা খাবেন, কাজের দিন কখন আর ছুটির দিনে কখন, তা বেশ অবচেতনে গেঁথে গিয়েছিল। আমি নিজে চা না খেলেও আমি জানতাম যে সকালের আর বেলার চা মা তৈরী করবেন আর ছুটির দিনে বকেলের চা বাবা। আর সন্ধ্যের চা টা হবে রাতের রুটি তরকারি তৈরী হওয়ার পর, সন্ধ্যারতি হওয়ার পর। চা না খেলেও মাঝে মধ্যেই সামনের দোকান থেকে তেলেভাজা আসত যেটাতে আমি অবশ্যই ভাগ বসাতাম। চপের তেলে ঠোঙা চপচপে হয়ে থাকত অনেক সময়! কিন্তু তাও ওই জিনিষের স্বাদই আলাদা! চায়ের সাথে মুড়িমাখা বা চপ, সন্ধ্যের চায়ের সাথে টিভিতে খবর বা “এক আকাশের নীচে” সিরিয়াল, ভোরের চায়ের সাথে শান্ত নিস্তব্ধতা বা খবরের কাগজ, ছোট পিসির বাড়ি জামসেদপুরে চায়ের টেবিলে আড্ডা যার বিষয়বস্তু অনেক সময়ই আমি কিছুই বুঝতাম না অথচ যেখানে উপস্থিত থাকতে ভালো লাগত – এইগুলো আমার মূল স্মৃতি হয়ে রয়েছে। আমি প্রথম চা পান শুরু করি বাড়ির বাইরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট নম্বর চারের বাইরে একটা চায়ের দোকান ছিল যেখানে থেকে একটি ছোট ছেলে দু হাতে চার পাঁচটা করে গরম কাঁচের গ্লাস ব্যালেন্স করে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ভবনে চা দিয়ে যেত। এই লিকার চা লেবু আর বেশ খানিকটা করে চিনি দিয়ে বানানো হতো; আর খাওয়ার পর গ্লাসের মুখটা চটচটে হয়ে যেত। ঠোঁট লাগলে ঈষৎ মিষ্টি মিষ্টি টক টক আঠা আঠা একটা অনুভূতি হতো। যে যেখানে বসে বা দাঁড়িয়ে চা খেতাম সেখানেই চায়ের গ্লাস ছেড়ে দেওয়া যেত, বাচ্চা ছেলেটি কোনও এক সময়ে এসে সংগ্রহ করে নিয়ে যেত। আমার সময় ক্যাফের চল খুব একটা ছিল না, এখনকার মতো পাড়ায় একটা দুটো করে তো নয়ই। তাও, মনে আছে দক্ষিনাপণে ডলি রায়ের ক্যাফেতে চা খেতে যাওয়া মাঝে মাঝে। সাদামাঠা চা নয়, ফ্যান্সি চা, পুদিনা পাতা দেওয়া আইসড টী (পরবর্তীতে খেয়েছি খাঁটি সেকেন্ড ফ্লাস) নান্দনিক পরিবেশন!

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে কানাডায় যখন পড়তে আসি, তখন আমি পুরোপুরি কফি আসক্ত হয়ে পড়ি। আসক্তি মানে কিন্তু পরিমানের প্রতি নয় । দিনে এক বারই যথেষ্ঠ বা কখনও কখনও দুবার। আসক্ত হয়ে পড়ি হাতে গরম কফি হাতে নিয়ে চুপচাপ নিজের সাথে সময় কাটিয়ে দিন শুরু করার প্রতি। যাই হোক, চা আমার জীবনে আবার ফিরে আসে আমি শিক্ষকতার কাজ নিয়ে তাইওয়ানে যাওয়ার পর। ওখানে প্রধানত চা খাওয়ার চল, তবে ঠান্ডা বা অল্প গরম চা, অনেক সময় দুধ আর ট্যাপিওকা দেওয়া। বলত ‘নাই ছা’ আমি যেই ভাষা-স্কুলে পড়াতাম সেখানে ক্লাসে শিক্ষক তো বটেই, ছাত্র-ছাত্রীদেরও চা আনার অনুমতি ছিল। প্লাস্টিকের গ্লাসে বিক্রী হতো এই চা, মুখটা পাতলা প্লাস্টিক দিয়ে আঁটা আর সাথে দিত মোটা মতো একটা স্ট্র। তাতে চা চলকে পড়ার কোনও সম্ভাবনা ছিল না । চায়ের স্বাদ বেশ ভালোই লাগত যদিও গরম  হতো না বলে আমার এগুলিকে চায়ের থেকে বেশী চা দেওয়া পানীয় মনে হতো। পরবর্তীকালে উপহার হিসেবে অনেক ধরনের উলং চা পেয়েছি আর গরম পানীয় হিসেবে খেয়েছি; অনেক বেশী তৃপ্তি লেগেছে তখন।

আমি ছোটবেলা থেকে দুধ ছাড়া দার্জিলিং চা বাড়িতে দেখে বা পরে নিজে খেয়ে অভ্যস্ত তাই বাড়িতে তেমন চা পাতাই কেনা থাকত। হায়দ্রাবাদে আমার নিজের সংসার শুরু করে একটা ঘটনার মাধ্যমে বুঝতে পারি যে বাড়িতে শুধু লিকার চায়ের পাতা নয়, দুধ চায়ের উপকরণও রাখা উচিত। আমার এক দক্ষিণ ভারতীয় সহকর্মী আমাদের বাড়িতে এসে এক চুমুকও শেষ না করতে পেরে বলেছিলেন ‘দিস ইজ নট টী।‘ অত্যন্ত লজ্জায় পড়েছিলাম আর তখনই ঠিক করেছিলাম অতিথিদের জন্য সবসময় বাড়িতে দুধ চায়ের আয়োজন রাখব। এখন বিশেষ বিশেষ কয়েকটি পরিস্থিতে চিনি এলাচ আদা দেওয়া দুধ চা ই বেশী ভালো লাগে। ড্যানফোর্থে থাকাকালীন ‘ঘরোয়া’ রেষ্টুরেন্ট থেকে ভাবীর দোকানের চা নিয়ে চলে যাওয়া হতো সোজা স্কারবোরো ব্লাফ। খুব ঠাণ্ডায় বেরোতে না পারলেও জমে যাওয়া লেকের সামনে গাড়ি পার্ক করে হাঁস দেখতে দেখতে গরম গরম দুধ চা খাওয়া আমার খুব ভালো লাগার স্মৃতি। তাছাড়া এখানে বাঙালি পারিবারিক বন্ধুদের সাথে জমায়েতে বা পিকনিকে এটা একটা প্রধান আকর্ষণ। কাপের পর কাপ দুধ চা ছাড়া আড্ডা জমে না। যেই আমি এমনিতে বাড়িতে চা খাই না, সেই আমার এই সমস্ত গেট টুগেদারে গিয়ে যিনি চা বানাচ্ছেন বিশাল ডেকচিতে তার আশে পাশে গিয়ে ঘুরঘুর করতে ইচ্ছে করে। আর তারপর চা হাতে আড্ডার চেয়ারে। ছোট আকারের এমন আড্ডা হয় আমার শ্বশুর বাড়ির চায়ের টেবিলেও যেখানে চা নিয়ে বসে আমার জায়ের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে গল্প করা আর মতের আদান প্রদান করা আমার ভালো লাগার একটা অভ্যাস। আক্ষরিক অর্থে ‘চায় পে চর্চা’। এই মুহূর্তগুলিই চায়ের মায়াকে বাড়িয়ে তোলে শতগুণ।