কানাডায় বাংলাদেশির অস্বাভাবিক মৃত্যু কাম্য নয়

নিরঞ্জন রায়

গত সপ্তাহে কানাডায় এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে দুজন প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশী অকালে মৃত্যুবরণ করেছেন। ঘটনাটি ঘটেছে বৃহত্তম বাণিজ্যিক শহর টরন্টো থেকে প্রায় দেড়শত কিলোমিটার উত্তরে কত্রা লেক অঞ্চলে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী, টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিজিএমই এর সাবেক সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাইলট সাইফুজ্জামান কত্রা লেক এলাকায় গিয়েছিলেন কটেজে অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যে। অবকাশ যাপনের সময় রাকিব এবং সাইফুজ্জামান কনুই নিয়ে লেকে গিয়ছিলেন এবং সাথে ছিল রাকিবের ছেলে। লেকে বৈরি আবহাওয়ার কারণে কনুই উল্টে তিনজনই পানিতে পড়ে যায়। রাকিবের ছেলে সাঁতরে তীরে উঠতে পরলেও রাকিব এবং সাইফুজ্জামান দুর্ভাগ্যজনকভাবে পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন।

এরকম দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কানাডায় বাংলাদেশিদের মৃত্যু যে এটাই প্রথম তেমন নয়। বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশী চারজন ছাত্রছাত্রী গভীর রাতে মহাসড়ক দিয়ে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে যাবার সময় দুর্ঘটনায় পড়লে তিনজন ছাত্রছাত্রী মৃত্যুবরণ করে। এর আগেও বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি সড়ক দুর্ঘটনা এবং অন্য কোনো দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির শিকার হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করেছে। এভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে বাংলাদেশিদের অস্বাভাবিক মৃত্যু যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ থেকে দুবছর আগে টরন্টোর মহাসড়কে বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে তিনজন ছাত্রছাত্রীর মৃত্যুর পর আমি একটি কলাম লিখেছিলাম, যেখানে আমেরিকা-কানাডা ভ্রমণের সময় দুর্ঘটনা এড়ানোর ব্যাপারে কিছু সতর্কতা অবলম্বনের জন্য সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটেই ঘটে গেল আরেকটি দুর্ঘটনা, যেখানে দুজন প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশিকে হারাতে হয়েছে।

আমরা আজ যে দুজন প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশীদের অকালে হারালাম, তাঁরা কি আসলেই দুর্ঘটনার শিকার, নাকি নিজেরাই বিপদকে ডেকে এনেছেন। প্রথমত, যখন তাঁরা টরন্টো থেকে প্রায় দেড়শত কিলোমিটার উত্তরে কটেজে অবকাশ যাপনে গেছেন, তখন কানাডায় কটেজে যাবার মত সময় হয়নি। জুন মাস শুরু হলেও অফিসিয়ালি এখনও বসন্ত কাল, অর্থাৎ গ্রীষ্মকাল বা সামার শুরুই হয়নি। তাছাড়া এবারের আবহাওয়া মোটেই অনুকূল নয়। এখনও তাপমাত্রা ১০ থেকে ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যার অর্থ হচ্ছে বেশ ঠাণ্ডা। যেহেতু তাদের কটেজ টরন্টো থেকে প্রায় দেড়শত কিলোমিটার উত্তরে, তাই সেখানকার তাপমাত্রা নিশ্চয়ই দশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচেই ছিল। এরকম আবহাওয়া কটেজে অবকাশ যাপনের জন্য মোটেই উপযুক্ত নয়। তাঁদের অবকাশ যাপন কটেজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু কটেজ থেকে বেড় হয়ে এরকম শিতের মধ্যে কনুই নিয়ে লেকে চলে গেছে পানির আনন্দ উপভোগের জন্য। কনুই হচ্ছে খুবই ক্ষুদ্রাকৃতির একটি ডিঙ্গি নৌকা, যা আমাদের দেশের তালের নৌকার মত দেখতে। এরকম নৌকা চালানোর জন্য প্রয়োজন বিশেষ প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা। বিশেষ করে বাতাসের গতিপ্রকৃতি এবং পানির দেউয়ের মাত্রা দেখে কনুইয়ের গতি সমন্বয় করতে হয়। আর এটা করতে ব্যর্থ হলে কনুই উল্টে যাবে এটাই স্বাভাবিক। আমার এক সহকর্মী ছোটবেলা থেকে কনুই চালায়। আমি যখন এই দুর্ঘটনার কথা তাঁর সাথে আলোচনা করছিলাম, তখন সে আমাকে উপরের কথাগুলো বলেছিল। এই ঠাণ্ডা আবহাওয়ার মধ্যে কনুই নিয়ে বিশাল লেকে যাওয়ার কথা শুনে আমার সেই সহকর্মী রিতিমত অবাক।

সবচেয়ে মারাত্মক ভুল ছিল লাইফ জ্যাকেট পরিধান না করা। কনুই নিয়ে বিশাল লেকে চলে গেছে, অথচ শরীরে লাইফ জ্যাকেট নেই। আমার ভাবতে অবাক লাগে, যারা কনুই ভাড়া দিয়েছে তাঁরা লাইফ জ্যাকেট ছাড়া এটা দিল কিভাবে। নিশ্চয়ই পুলিশি তদন্তে বিষয়টি বের হয়ে আসবে, যদি পুলিশ সঠিক তদন্ত করে। নিহত দুজনই যদি বাংলাদেশি নাগরিক এবং ভিজিট ভিসা নিয়ে কানাডা বেড়ানোর জন্য এসে থাকে, তাহলে পুলিশ হয়ত সেই মাত্রার তদন্ত নাও করতে পারে। এরকম দুর্ঘটনায় যদি কানাডার নাগরিক বা স্থায়ী বাসিন্দা মারা যেত, তাহলে পুলিশ তদন্ত করে কনুই সরবরাহকারীকেও শাস্তি দিত।

অনেক ক্ষেত্রে এরকম হয় যে কনুই এবং লাইফ জ্যাকেট পৃথকভাবে ভাড়া নিতে হয়। আমাদের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা আছে যে আমরা অকারণে প্রচুর অর্থের অপচয় করলেও, অনেক সংগত কারণে অর্থ ব্যায় করতে কার্পণ্য করি। একারনেই প্রশ্ন জাগে যে অর্থ সাশ্রয়ের উদ্দেশ্যে শুধুমাত্র কনুই ভাড়া নেয়া হয়েছে, কিন্তু লাইফ জ্যাকেট ভাড়া নেয়াকে অর্থের অপচয় মনে হতে পারে। তা নাহলে লাইফ জ্যাকেট ছাড়া কোনো অবস্থাতেই কনুই নিয়ে লেকে যাওয়ার কথা নয়। অনেকেই আমার সাথে একমত নাও হতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমরা অর্থ সাশ্রয়ের জন্য অনেক প্রয়োজনীয় সার্ভিস না নিয়ে নিজেদের সবসময়ই বিপদের সামনে ফেলে রাখি। একটি দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টি অনেকের কাছে পরিষ্কার হতে পারে। বাংলাদেশ থেকে যারা ভিজিট ভিসা নিয়ে কানাডা আসেন, তাদের অধিকাংশ স্বাস্থ্য বীমা বা হেলথ ইনুসুউরেন্স ক্রয় করে না। আমি যাদের সাথে কথা বলেছি, তাদের কেউই হেলথ ইনস্যুরেন্স নিয়ে কানাডা আসেনি। হেলথ ইনস্যুরেন্স ব্যাতিত কানাডা ভ্রমণ যে কতটা বিপদজনক হতে পারে, তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন। একইভাবে যে মহাসড়ক দিয়ে ঘণ্টায় ৭০ কিমি গতিতে গাড়ি চালানর বাধ্যবাধকতা আছে, সেখানে ১৫০ কিমি গতিতে গাড়ি চালিয়ে বিপদে পড়বে, আর তাকে নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিবে, তা তো হতে পারে না।

এসব দুর্ঘটনা বা বিপদ ডেকে আনার জন্য যত না কানাডা বেড়াতে আসা বাংলাদেশিরা দায়ি, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ি আমরা যারা এখানে স্থায়িভাবে বসবাস করছি। কেননা যারা বাংলাদেশ থেকে কানাডা বেড়াতে আসেন, তাঁরা এখানকার ভাল এবং খারাপ দিকগুলো সেভাবে জানবে না, এটাই স্বাভাবিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা আমাদের উপর নির্ভর করে। কিন্তু আমরাও তাদের সঠিক কথাটা বলি না। উল্টো আমরা অতিরঞ্জিত সবকিছু বলে বা দেখিয়ে হিরো সাঁজার চেষ্টা করি। একবার আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমাকে নিয়ে টরন্টো বিমানবন্দরে গিয়েছিল বাংলাদেশ থেকে আগত একজন বিশিষ্ট ব্যাক্তিকে রিসিভ করার জন্য। সেই ব্যাক্তিকে নিয়ে যখন ফিরছিলাম, তখন আমার সেই বন্ধু যেভাবে বেপরোয়া গাড়ি চালাচ্ছিল, তাতে আমি নিজেই মারাত্মক ভয় পেয়েছিলাম। যে মহাসড়ক দিয়ে ৭০ কিমি গতিতে চলার কথা, সেখানে সে ১২০/১৩০ কিমি গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল। যত্রতত্র কারণে অকারণে লেন পরিবর্তন করছিল। আমি বেশ কয়েকবার ইশারায় তাকে গাড়ি চালানোর ব্যাপারে সতর্ক করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারনি। সেই বিশিষ্ট ব্যাক্তিকে পৌঁছে দিয়ে যখন ফিরছিলাম, তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে “আপনি এভাবে বেপরোয়া গাড়ি চালালেন কেন?”। উত্তরে সে আমাকে বলল “দাদা, বোঝেন না, বাংলাদেশ থেকে এসেছে, তাই একটু দেখালাম, আর কি”। আমি তাকে বললাম “খুবই ভাল, তবে চরম বিপদের ঝুকি নিয়ে”।

বাংলাদেশ থেকে কোনো অথিতি আসলে পেশাগত আলোচনার জন্য আমরা তাঁদের সময় পাই না। আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতরা তাদেরকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাতিব্যস্ত হয়ে যায়। এই অতিরঞ্জিত আপ্যায়ন এবং আতিথেয়তার পিছনে থাকে এক ধরণের দেখানো এবং শো-আপের প্রবণতা। যারা এখানে বেড়াতে আসেন তাদেরকে ধারণা দেয়ার চেষ্টা হয় যে আমরা এখানে কত ভাল আছি। এমনও বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে তোমরা এখানে না এসে মারাত্মক ভুল করেছো, আর আমরা এখানে এসে অনেক ভাল কাজ করেছি। অথচ যে দেশে আয়ের চেয়ে ব্যায় বেশি, বা অনেক ক্ষেত্রে যে দেশে ঘিয়ের চেয়ে তেলের মুল্য বেশি, সে দেশ যে খুব ভাল থাকার জায়গা না, তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেই না। অবশ্য বাংলাদেশের চেয়ে আমরা হয়ত অনেক ভাল আছি। কিন্তু সেটা তো আর তুলনা করার মাপকাঠি হতে পারে না। কেননা বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ যেখানে বছর জুরেই থাকে রাজনৈতিক অস্থিরতা। যা-হোক কানাডায় আগত অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য টানাহেঁচড়া করতে যেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই নিয়মনীতির বত্যায় ঘটে, যার পরিণতিতে ঘটে এরকম দুর্ঘটনা। ফলে অনেক মূল্যবান প্রান অকালে ঝড়ে যায়। আমরা যারা কানাডায় স্থায়িভাবে বসবাস করি তাদের উচিৎ হবে কানাডা বেড়াতে আসা বাংলাদেশিদের নিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে হিরোইজম দেখানোর পথে না হাটা। বরং সবরকম নিয়মনীতি মেনে যা কিছু স্বাভাবিক এবং সাধারণ, তাই যেন করার চেষ্টা করি। 

যে দুজন প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশী দূরদর্শিতার অভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অকালে চলে গেলেন, তাঁরা আর ফিরে আসবে না। অপূরণীয় খতি হয়ে গেল তাদের পরিবারের এবং দেশের। যে ছেলে বাবাকে মরতে দেখেও তাকে বাঁচাতে না পেরে নিজে বেচে রইল, সে এই শোক সামলাবে কিভাবে, তা কল্পনা করতেও গা শিহরে উঠে। আমরা তাদের আত্মার শান্তি কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি এটাও প্রত্যাশা করি যে আর কোনো বাংলাদেশী যেন কানাডায় অপরিণামদর্শিতার পরিচয় দিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ না করে। কেননা কানাডা এমন একটি দেশ যেখানে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা আছে। তাই এরকম দেশে কোনো বাংলাদেশির অস্বাভাবিক মৃত্যু কোনভাবেই কাম্য নয়। #

নিরঞ্জন রায়, CPA, CMA, CAMS
সার্টিফাইড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিষ্ট ও ব্যাংকার।
টরনটো, কানাডা
Nironjankumar_roy@yahoo.com