কানাডায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি আমাদের কর্তব্য
মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তার সন্তানকে। ঈশ্বর পাটনি নামের মাঝিকে মা অন্নপূর্ণা বর চাইতে বলাতে সে বলেছিল, “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।” ভগবান যেমন মানুষের মুখের আয়নায় নিজেকে দেখতে চান, সেরকম মানুষও তার সন্তানের মুখের আয়নায় নিজেকে দেখতে চায়।
আমরা সবাই চাই , আমাদের সন্তান সর্বগুণ-সম্পন্ন হোক । কিন্তু, শুধু চাইলেই তো হবে না। তার জন্য প্রয়াসও করতে হবে। একটা গাছের চারা পুঁতে দিলেই সেটা ফুলে ফলে ভরে উঠবে না। তাকে জল দিতে হবে, সার দিতে হবে, আলো-হাওয়া দিতে হবে।
আজকে কানাডায় বাঙালিদের জন্য একটা সম্মানের আসন পাতা আছে। কিন্তু সেটা একদিনে হয়নি বা হাওয়ায়ও হয়নি। তার পেছনে বহু লোকের অক্লান্ত পরিশ্রম আছে। তাদের মধ্যে অনেকেই আজ পরলোকগত। তাদের আদর্শ আমাদের পাথেয়। তাদের আশীর্বাদ আমাদের প্রেরণা। আমি দুই বাংলার বাঙালিদের কথাই বলছি। একথা স্বীকার করতেই হবে যে, আজ বিশ্বে বাংলা ভাষার যে স্বীকৃতি তার কৃতিত্বের অনেকটাই বাংলাদেশের অধিবাসীদের।
আমরা সবাই জানি, সন্তানের প্রথম শিক্ষক তার বাবা-মা। আমরা এও জানি, যে গাছের শিকড় মাটিতে ভালোভাবে প্রোথিত আছে সেই গাছ সহজে ঝড়ে ভেঙে পড়ে না। সেই রকম যার মধ্যে আত্মসম্মানবোধ আছে, স্বাভিমান আছে, সে সহজে প্রতিকূল অবস্থায় আঘাতে ভেঙে পড়ে না। আর তাই আমাদের প্রথম কর্তব্য সন্তানকে আত্মসম্মানবোধ দেওয়া। সেটা দিতে পারে আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের সাহিত্য, আমাদের ধর্ম-বোধ।
কেননা, ধর্ম আমাদের উদার হতে শেখায়। বিশ্বভ্রাতৃত্ব শেখায়। অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে শেখায়। সকল ধর্মের ভালোটুকু নিতে শেখায়। আমরা জানি, সব ধর্মের মধ্যেই ভালো আছে। বুদ্ধ, খ্রিস্ট, মোহাম্মদ ,নানক, রামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ পৃথিবীর কোন ধর্মগুরুই মানুষকে কুশিক্ষা দেন নাই।
আমি যদি চাই যে, আমার সন্তান সর্বগুণ-সম্পন্ন হবে, একজন যথার্থ মানুষ হবে, তাহলে আমাকে নিজেকেও সেইভাবে তৈরি করতে হবে। এজন্যেই বলা হয়, আপনি আচরি ধর্ম অপরে শেখাও। আমার সন্তানের উপর আমার দশটা উপদেশের চাইতে আমার আচরণের প্রভাব বেশি কার্যকরী হবে।
একথা সত্য যে, নিজের দেশে সন্তান মানুষ করা অনেক সহজ। কেননা, বিদেশে পরিবেশ পরিস্থিতি আলাদা হয়। সেখানে ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, নৈতিকতা সবই অনেকটাই ভিন্ন হয়ে থাকে। সেইজন্য আমাদের দায়িত্বও অনেকটা বেড়ে যায়। যদি আমরা কানাডায় সন্তানদের মানুষ করতে চাই, আমাদের মনে রাখতে হবে যে আমরা দেশান্তরী হয়েছি নিজেদের গরজে। কিন্তু আমাদের সন্তান এদেশে নিজের ইচ্ছায় আসেনি। এখানে আসার ব্যাপারে তার মতামত আমি জিজ্ঞেস করিনি। আমার সন্তান আমার প্রতি চরম বিশ্বাসে আমার হাত ধরে অজানা অচেনা দেশে সানন্দে চলে এসেছে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছেন ,
যেথায় যে রয়ে যাবে কথাটি না কয়ে যাবে ,
সাথে যাবে ছায়ার মতন
তাই বলে দেখো দেখো, এ বিশ্বাস রেখো রেখো ,
মাথারে দিও না বিসর্জন।
কাজেই কানাডায় এসে আমার সন্তানের প্রতি আমার দায়িত্ব এবং নৈতিক কর্তব্য অনেক বেড়ে যায়। কেননা, আমার সন্তান তো এখানে এসে দিশেহারা। কারণ তার ভাষা আলাদা, ধর্ম আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা। পুরো পরিস্থিতিই তার জন্যে ভিন্ন। পরিবেশ তার সম্পূর্ণ প্রতিকূল। আর ঠিক তখনই আমাকে তার পাশে দাঁড়াতে হবে। তাকে ভরসা দিতে হবে। দিতে হবে শক্তি ও সাহস।
ইংরেজিতে বলে, Thus far and no farther. এটা সব সময় আমাদের মনে রাখতে হবে আমি সন্তানের হাত ধরবো কিন্তু সেটা সব সময় নয়। তাকে সাহায্য করবো কিন্তু সব জায়গায় নয়। ২৪ ঘন্টা সন্তানের পেছনে লেগে থাকলে তার নিজের ব্যক্তিত্বের বিকাশ হবে না। সে চির শিশু হয়ে থাকবে। আর যে সন্তানের জন্ম এ দেশে তার অবস্থা আরও করুণ। তার তো নিজের ধর্ম বা সংস্কৃতির সাথে কোন প্রত্যক্ষ পরিচয়ই নেই। কানাডায় তো তার সত্তা ঘরেবাইরে দ্বিধা বিভক্ত। আর তাই তার প্রতি আমাদের কর্তব্য আরও বেশি। নিজের ধর্ম এবং সংস্কৃতি বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান না হলে সে সারা জীবন শিকড়হীন হয়ে থাকবে।
আমাদের খেয়াল রাখতে হবে আমাদের সন্তান যেন উন্মুক্ত-মনা হয়। যেন কুপমণ্ডুক না হয়। কানাডার যে জিনিসগুলো আমাদের সমাজের চাইতে ভালো (যেমন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, নিয়মানুবর্তিতা, শ্রমের মর্যাদা ইত্যাদি) এগুলো যেন সে অনায়াসে গ্রহণ করতে পারে। আবার যেগুলো এখানে খারাপ (যেমন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কম পারস্পরিক আকর্ষণ, আত্মীয়তার শিথিল বন্ধন, বয়সে বড়দের গুরুজন হিসেবে না মানা , শিক্ষককে উপযুক্ত সম্মান না জানানো ইত্যাদি) সেগুলো যেন সে বর্জন করে চলতে পারে।
বয়স্কদের মধ্যে একটা সমস্যা প্রায়ই দেখা যায়। সেটিকে সমস্যা না বলে কমপ্লেক্স বলাই ভালো। সেটি হলো জেনারেশন গ্যাপ। আমার ছেলে আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট হওয়া সত্ত্বেও সে আমার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান হতে পারে এটা স্বীকার করতে আমাদের অহংকারে লাগে। কিন্তু আমরা যদি বায়োলজিক্যাল এভলিউশন চিন্তা করি তবে এটাই তো স্বাভাবিক যে আমার সন্তান আমার চেয়ে বেশি বিচক্ষণ হবে। আমি বাল্যকালে পড়াশোনা করেছি কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে। আর অন্যদিকে আমার সন্তান পড়ে কম্পিউটার নিয়ে এটা ভুলে গেলে চলবে না।
আমি নার্সারি রাইম পড়েছি,
Twinkle twinkle little star,
How are you wonder what you are.
কিন্তু এখন আমার সন্তান পড়ে,
Twinkle twinkle Little Star,
I do not wonder what you are,
For by the spectroscopic ken,
I know that you are hydrogen.
ছোটবেলায় আমরা বিশ্বাস করেছি যে –
ঠিক কথা বলেছেন নবনীতা সরকার
ছেলেদের মাঝে মাঝে মারধর দরকার।
কিন্তু এখানে ছেলে-মেয়েকে বাবা-মা মারলে, সে নিজেই ৯১১ কল করে পুলিশ ডাকে। এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাচ্চাদের মারধর করা পছন্দ করতেন না। আশ্রমে ভূষণবাবু নামে একজন শিক্ষক ছেলেরা পড়াশোনা না করলে মাঝে মাঝে উত্তম মধ্যম দিতেন। সেটা কবিগুরুর নজরে আসে। ভূষণবাবু একদিন একটা চিরকুট পেলেন। তাতে লেখা
ওহে ভূষণ দাদা,
গাধা পিটিয়ে হয় না ঘোড়া,
ঘোড়া পিটিয়ে হয় যে গাধা।
এখানে শান্তিনিকেতনের আরেকটা কথা মনে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে শিক্ষকদের সাথে ঘরোয়াভাবে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন। একদিন সেই সভায় সবাই বললেন, “গুরুদেব ,ছেলেরা পড়াশোনা করতে চায় না। এর প্রতিকার কী?” গুরুদেব একটু হেসে আস্তে করে বললেন, “তোমরা পড়ো।” কত দামী কথা এই দুটো কথার মধ্যে বলে গেলেন। ছাত্ররা যদি দেখে শিক্ষকরা মন দিয়ে পড়াশোনা করছেন, তবে তারাও পড়বে। পড়ার জন্য কোন উপদেশ দিতে হবে না।
আজকালকার ছেলেদের বুদ্ধি বেশি। বিশেষ করে দুষ্টু বুদ্ধি। যেমন ধরুন, এক বৃদ্ধ শিক্ষক একদিন ক্লাসে বললেন, “বাবারা, তোমরা মন দিয়ে পড়াশোনা করো। জ্ঞানের কোনো বিকল্প নাই। আমি আগে ভাবতাম আমি সব জানি। এখন এই বুড়ো বয়সে এসে বুঝতে পারছি আমি কিছুই জানি না।“ পিছনের বেঞ্চে বসা একটি ছেলে উঠে বলল, “স্যার, আপনি যে কিছু জানেন না এইটা বুঝতে আপনার এত বছর লেগে গেল? আমি তো আপনাকে প্রথম দিন দেখেই বুঝেছিলাম যে আপনি কিছুই জানেন না।” তারপর সেই গুরুজি আবার বললেন,”আচ্ছা বাবারা, ভগবান যদি তোমাদের টাকা পয়সা অথবা বিদ্যাবুদ্ধি এই দুটো বরের একটি নিতে বলেন, তোমরা কোন বরটা চাইবে? একটা পাবে, দুটো পাবে না, মনে রেখো। ওই ছেলেটা আবার দাঁড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার আপনি হলে দুটোর মধ্যে কোন বরটা চাইতেন?” গুরুজি বললেন, “আমি চাইতাম বিদ্যাবুদ্ধি।” ছেলেটি হেসে বলল, “সেটাই স্বাভাবিক। যার যেটা নেই সে তো সেটাই চাইবে।”