কানাডার নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের সৌন্দর্য
বাংলাদেশে থাকতে আমি কখনই রাজনীতির সাথে যুক্ত হবার চেষ্টা করিনি। সত্যি বলতে কি, বাংলাদেশের যে রাজনীতি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তাতে নিজেদের সেভাবে জড়িত করার মত অবস্থা ছিলনা। তাই সেখানে নিজের পেশা নিয়েই ব্যাস্ত থাকার চেষ্টা করেছি। কানাডা চলে আসার পর এখানকার রাজনীতির সাথে নিজেকে জড়িত করার চেষ্টা করি। এখানকার রাজনীতি বেশ পরিচ্ছন্ন এবং শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের অসাধারণ এক মিলন মেলা, যেখানে নেই কোনো নোংরামি, কাদা ছুড়াছুড়ি এবং অর্থ ও পেশী শক্তির প্রাধান্য। তাছাড়া এই দেশে যেহেতু পরবর্তী প্রজন্ম বসবাস করবে, তাই নাম লেখালাম এখনকার মূল ধারার রাজনীতিতে।
এখানে এসে বিশাল এক অর্থনীতির দেশে যেভাবে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছি, তাতে এখানে রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে খুব বেশিদূর যাওয়ার সুযোগ নেই। তারপরও পরবর্তী প্রজন্মের রাজনীতিতে প্রবেশের পথ তৈরির অভিপ্রায় নিয়েই এই পথে যাত্রা শুরু। কিন্তু এখানকার নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা রাজনীতি নিয়ে সেভাবে মাথা ঘামাতে চায় না। তাদের অধিকাংশই লেখাপড়া, পেশা এবং জীবন উপভোগ করার বিষয় নিয়ে বেশি ব্যাস্ত থাকে। এখানে মূলধারার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হতে যেয়ে দেখলাম যে রাজনীতি করার জন্য অর্থ এবং সময় অপরিহার্য। উল্লেখযোগ্য অর্থ বরাদ্দ এবং পর্যাপ্ত সময় ব্যায় করা ছাড়া এখানকার রাজনীতিতে জায়গা করে নেয়া সম্ভব নয়।
কানাডার বিগত নির্বাচনের তুলনায় এবারের নির্বাচনে যথেষ্ট উত্তেজনা ছিল। সেই উত্তেজনাও নিজেও কিছুটা সামিল হয়েছিলাম এবং সেই সুবাদে কিছু অভিজ্ঞতারও সঞ্চার হয়েছে, যা পাঠকদের সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যেই এই লেখা। ভোট দিতে যেয়ে মনে হলো যে আমি কি বাংলাদেশে, না কানাডার কোনো ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে এসেছি। অল্প সংখ্যাক ভোটার উপস্থিত হয়েছে, অথচ লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে অনেকক্ষণ। পোলিং অফিসাররা মন্থর গতিতে সবকিছু দেখে ভোটারকে ব্যালট পেপার প্রদান করছিল। অনেক ক্ষেত্রে বুঝতে পারছিল না যে কি করতে হবে। প্রায়ই সুপারভাইজারের মুখাপেক্ষী হতে হয়েছে। দায়িত্ব পালনের ধরণ দেখে মনে হচ্ছিল যে ভোট গ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণের অভাব আছে। সেখানে উপস্থিত এক কর্মকর্তার সাথে কথা বলার সুযোগ হওয়ায় আমি তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে পোলিং অফিসারদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে কিনা। তিনি বললেন যে প্রশিক্ষণ ঠিকই দেয়া হয়, তবে তা পর্যাপ্ত নয়। সবাইকে মূলত ম্যানুয়াল পড়েই জেনে নিতে হয় কিভাবে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করতে হয়। এজন্য অবশ্য কোনো অভিযোগও থাকে না এবং বিশৃঙ্খলাও দেখা দেয় না। ধীর গতিতে হলেও বেশ সুন্দরভাবেই ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়।
অনেক ভোটারের জন্য কিছুটা সমস্যা হয় ব্যালট পেপার থেকে পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে। কেননা এখানকার ব্যালট পেপারে প্রার্থীর দলের কোনো মার্কা থাকে না। প্রার্থীর নাম দেখে ভোটারকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। অনেকের নাম বেশ বড় এবং জটিল উচ্চারণ। যেমন, এখানকার মূল ধারার মানুষ আমার নাম সঠিকভাবে উচ্চারণই করতে পারে না, মনে রাখা তো দুরের কথা। তেমনি আমরাও অনেকের নাম সঠিকভাবে উচ্চারণও করতে পারি না, এমনকি মনে রাখতেও বেশ কষ্ট হয়। ফলে পছন্দের প্রার্থীর নাম রীতিমত মুখস্ত করে না আসলে সেই প্রার্থীকে বেছে নিয়ে ভোট দিতে বেশ বেগ পেতে হয়। অনেকেই সেভাবে পছন্দের প্রার্থীর নাম মুখস্ত করে আসেনা। ফলে অনেকের ভোট পছন্দের প্রার্থীর স্থানে নাও পড়তে পারে। যে নির্বাচনী এলাকায় দুই/তিন জান প্রার্থী থাকে, সেখানে তেমন সমস্যা হয় না। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা বেশি, সেখানে এটি একটি সমস্যা তো বটেই। যেমন, আমার নির্বাচনী এলাকায় আটজন প্রার্থী ছিল, ফলে এরকম সমস্যা তো ছিলই। একারণেই লাইনে দাঁড়ানো অনেক ভোটারকে একে অপরের মধ্যে প্রার্থীর নাম জিজ্ঞাসা করতে শুনেছি।
ভোট প্রদানের পর প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার জন্য সারাদিন তেমন কিছু থাকে না। নির্বাচনী প্রচারের অফিসে বসে গল্পগুজব করা, একটু খোঁজখবর রাখা, বিশেষ করে প্রার্থী এবং তাঁর সহযোগীদের সাথে কথা বলে একটা নেটওয়ার্ক তৈরির সুযোগ নেয়া। এরপর ভোট গ্রহণ শেষ হবার মুহূর্তে প্রার্থীর প্রতিনিধি হিসেবে একটি ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত থাকার দায়িত্ব। এখানে যেভাবে বিশ্বস্ততার সাথে নির্বাচন কমিশন ভোট গ্রহণ সম্পন্ন করে, তাতে প্রার্থীর কোনো প্রতিনিধির উপস্থিত থাকার প্রয়োজন নেই। এটা মূলত নিয়মরক্ষার কাজ। সাধারণত প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীই তাদের প্রতিনিধি প্রেরন করে থাকে।
আমি আমার প্রার্থীর ইস্যু করা প্রতিনিধি পরিচয়পত্র নিয়ে নির্ধারিত ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে দেখি যে অন্য আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর একজন প্রতিনিধি উপস্থিত আছেন একইরকম দায়িত্ব নিয়ে। সেই প্রতিনিধি এখানকার মূলধারার একজন নাগরিক এবং রীতিমত বিশাল এক কফির ডিব্বা নিয়ে হাজির হয়েছে। ভোট গণনা শুরু করতে এক ঘণ্টার মত সময় লেগে যায় প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে। ব্যালট পেপার মিলিয়ে নিতে হয় এবং রেজাল্টসিট প্রস্তুত করতে বেশ সময় লেগে যায়। এই সময়টুকু আমাদের ভোটকেন্দ্রে বসে কাটাতে হয়েছে। আমি আরেক প্রতিনিধিকে দেখে একটু ইতস্তত করছিলাম এবং ইচ্ছে করেই তাঁর কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছি, কেননা তিনি আমার প্রার্থীর প্রতিপক্ষের প্রতিনিধি। এক পর্যায়ে তিনিই আমাকে ডেকে পাশে বসতে বললেন এবং তাঁর ডিব্বা ঢেলে এক কাপ কফিও দিলেন। আমরা কফি খেতে খেতে বেশ গল্পে মেতে গেলাম। কানাডার রাজনীতি, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ এবং আরও অনেক সমসাময়িক বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। একটি বারের জন্য হলেও আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নিয়ে কথা হয়নি। একবারই কানাডার দুটো বড় দল, লিবারেল এবং কনজারভেটিভ পার্টির নাম উল্লেখ করে বলেছিল যে দলই ক্ষমতায় যাক তাদের জন্য সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।
কথা বলতে বলতে ভোট গণনা শুরু হয়ে যায়। তখন আমরা দুজনেই চেয়ার থেকে উঠে বুথের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। এখানকার ভোট গণনার পদ্ধতিও অভিনভ। আমি যে কেন্দ্রে প্রতিনিধিত্ব করছিলাম সেখানকার ভোট গণনার পদ্ধতি দেখে আমার ছোটবেলায় দাদু-দিদার আম গণনার কথা মনে পড়ে গেল। প্রথমে প্রতিটা সিরিজের ব্যালট পেপারগুলো সিরিজ অনুযায়ী পাঁচটি পাঁচটি করে ভাগা দিয়ে সাজাতে হয়। তারপর সেগুলো মিলিয়ে দেখে প্রার্থীর নাম অনুযায়ী আবার পৃথক করা হয়। তারপর ব্যালট গণনা করে রেজাল্ট সিটে ফলাফল লেখা হয় এবং সেখানে উপস্থিত প্রতিনিধি হিসেবে আমাদেরও স্বাক্ষর করতে হয়েছে। এভাবে ভোট গণনা দেখে আরেক প্রতিনিধি আমাকে বলল “২০২৫ সালে এসেও এভাবে ভোট গণনা হয়”। তাঁর কথার সাথে সুর মিলিয়ে আমি নিজেও যে অবাক হয়েছি সেটা তাকে জানাতে দ্বিধা করিনি। কেননা এর আগে আমি যে কয়বার ভোট দিয়েছি, সেখানে পেপার ব্যালট থাকলেও ভোট গণনার কাজটি হয়েছে মেশিনে।
ভোট গণনা শেষে দেখালাম যে আমার কেন্দ্রে আমাদের প্রার্থী প্রতিপক্ষের চেয়ে মাত্র ১৪ ভোট কম পেয়েছে। ভোটের এই সামান্য পার্থক্য দেখে সেই প্রতিনিধি আমার কাছে জানতে চাইল যে আমি পুনঃগণনার আবেদন করব কিনা। আমি বললাম “না”। কেননা আমাকে এরকম নির্দেশনা দেয়া হয়নি। আমি “না” করলেও প্রসঙ্গটা যেহেতু এসেছে, তাই আমার প্রার্থীর ক্যাম্পেইন ম্যানেজারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি আমাকে জানালেন যে অন্যান্য কেন্দ্রে ভোটের পার্থক্য অনেক বেশি তাই পুনঃগণনার প্রয়োজন নেই। সেরকম হলে আমরা কেন্দ্রিয়ভাবে সেই উদ্যোগ নিব। তারপরও সেই প্রতিনিধি ভোট পুনঃগণনার অনুরোধ জানায়, কিন্তু ফলাফল অপরিবর্তিত ছিল। এরপর আমরা দুজনেই রেজাল্ট সিটের একটা কপি নিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে ফিরছিলাম আর ভাবছিলাম যে আজ যদি আমার প্রার্থীর প্রতিনিধি প্রবাসী বাংলাদেশী হতো, তাহলে এরকম সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকত কিনা। আমার অভিজ্ঞতা বলে মোটেই না। উল্টো তিক্ততার সৃষ্টি হতো। বাংলাদেশের কথা বাদই দিলেম। এখানেও প্রবাসী বাংলাদেশীদের মাঝে কনজারভেটিভ এবং লিবারেল পার্টির সমর্থনের বিষয় নিয়ে তর্কবিতর্ক, গালাগালি, ঝগড়াঝাঁটি এবং মুখ দেখাদেখির বন্ধ হওয়ার মত অবস্থা তৈরি হয়ে যায়। নির্বাচনের কয়েকদিন আগে একটি বাসার ঘরোয়া অনুষ্ঠানে এরকম এক তিক্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এবং এর ফলে অনেকের মাঝে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেছে।
সবকিছু মিলিয়ে নির্বাচনের সীমাবদ্ধতাগুলো সাদরে মেনা নেয়া, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করা এবং প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মাঝে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ বজায় রাখা; এর সবকিছুই এখানকার নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য দিক। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে নির্বাচনের পর ফলাফল মেনে নিয়ে বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানানোর যে প্রথা, সেটাও সবাই অনুসরণ করে। এসবই হচ্ছে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য, যা পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান আছে উন্নত বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত এই কানাডার নির্বাচনে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এই রীতি আমাদের দেশে কতটা অনুসরণ করা হয়, তা পাঠকই আমার থেকে বেশি ভাল জানে। তবে এ কথা ঠিক যে বাংলাদেশের নির্বাচনে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের নির্বাচনে উৎসবমুখর পরিবেশের ঘাটতি না থাকলেও, গণতন্ত্রের সৌন্দর্যের ঘটতি যথেষ্টই আছে। কিন্তু কানাডা এবং উন্নত বিশ্বের অন্যান্য দেশের নির্বাচনে উৎসবমুখর পরিবেশের ঘাটতি থাকলেও, গণতন্ত্রের সৌন্দর্যের কোনো ঘাটতি নেই। #
নিরঞ্জন রায়, CPA, CMA, CAMS
সার্টিফাইড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিষ্ট ও ব্যাংকার।
টরনটো, কানাডা
Nironjankumar_roy@yahoo.com