‘কানাডা: বিবিধ প্রসঙ্গ’ এবং একটি প্রকাশনা উৎসব

রোকসানা পারভীন শিমুল

নিজের লেখা মলাট বন্দী দেখতে কার না ভাল লাগে! খুব অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম সুব্রত কুমার দাসের সম্পাদনায় ২৯ জন লেখকের সাথে নিজের লেখা বইটি ছুঁয়ে দেখার জন্য। কানাডার সমাজ, সংস্কৃতি , ইতিহাস ও জীবনধারা নিয়ে লেখা বই ‘কানাডা: বিবিধ প্রসঙ্গ’  বইটি একটি মূল্যবান সংযোজন। যারা কানাডার অভিবাসী হয়েছেন বা হবেন বলে ভাবছেন তাদের কানাডা সম্পর্কে জানার জন্য এই বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে কেননা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ভূখণ্ডে মানব ইতিহাসের সূচনা থেকে বর্তমান সময় অব্দি বিভিন্ন বিষয় খুব যত্ন করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন লেখকেরা।

গত ১১ মে বার্চমাউন্ট কমিউনিটি সেন্টারে হয়ে গেল বইটির প্রকাশনা উৎসব। ফারজানা হকের চমৎকার সাবলীল উপস্থাপনায় সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত পিনপতন নীরবতায় শ্রদ্ধেয় সুধীজনের আলোচনায় উঠে আসে ‘কানাডা: বিবিধ প্রসঙ্গ’ বইটির ভ্রূণ থেকে জন্ম নেয়ার সব গল্প।

“একটি বই খোল আর তাতে তুমি পেয়ে যাবে সব ধরনের মানুষ আর স্থান। একটি বই খোল তুমি হতে পারবে যা যা খুশি তুমি হতে চাও। একটি বই খোল আর তুমি ভাগ করে নইতে পারবে আশ্চর্য পৃথিবী ওখানে তুমি পেয়েছো।” চমৎকার একটা উদ্ধৃতি দিয়ে ফারজানা তার সুললিত কণ্ঠে উপস্থাপনা শুরু করে মঞ্চে ডেকে নেন অনুষ্ঠানের সভাপতি জনাব আকবর হোসেন, প্রধান অতিথি শহিদুল ইসলাম মিন্টু (এডিটর বাংলামেইল এবং সিইও, এনআরবি টেলিভিশন), বিশেষ অতিথি ডাঃ এএসএম নূরুল্লাহ তরুণকে। বিচেস-ইস্ট ইয়র্কের কাউন্সিলরের  পক্ষ থেকে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন  বইটির সম্পাদক সুব্রত কুমার দাসের হাতে।

এরপর কথার যাদুকর সুব্রত কুমার দাস অত্যন্ত আনন্দ চিত্তে বইটির আলোর মুখ দেখার ধাপগুলো বর্ণনা করেন। ‘কানাডা: বিবিধ প্রসঙ্গ’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে ঢাকার বেহুলাবাংলা প্রকাশন থেকে। বইটি প্রকাশনার ক্ষেত্র যারা ভূমিকা রেখেছেন তাদের প্রতি সুব্রত অত্যন্ত বিনয়ের সাথে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন। তিনি প্রথমেই যে নামটি উল্লেখ করেন সেটি হলো শহিদুল ইসলাম মিন্টুর কথা, যার পৃষ্ঠপোষকতায় ২০২৪ সালের ২০শে জুলাই কানাডা জার্নালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সাপ্তাহিক বাংলামেইল পত্রিকা ৩০ জন লেখকের কানাডার বিভিন্ন বিষয়ে লেখা ত্রিশটি প্রসঙ্গ নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা বের করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল কানাডায় যারা বসবাস করছেন তারা-সহ নতুন অভিবাসী অথবা যারা কানাডায় আসার চিন্তা-ভাবনা করছেন তারাও যেন কানাডা সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে কিছু ধারণা নিতে পারেন। ৩০ জন লেখকের লেখাগুলো নিয়ে বইটি প্রকাশের পাশাপাশি কানাডা জার্নালের ওয়েবসাইটটি ডেভেলপ করা হয়েছে। সুব্রত কুমার দাস কানাডায় বসবাসরত লেখকদের উদাত্ত কন্ঠে আহ্বান জানান কানাডা জার্নালে (c-j.ca) নিজেদের সম্পৃক্ত করার জন্য। লেখকদের কারও নাম যদি বাদ গিয়ে থাকে তাহলে ওয়েবসাইটে সংযুক্ত হওয়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানান।

তিনি অনুষ্ঠানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ব্যারিস্টার সূর্য চক্রবর্তীকে মঞ্চে আহবান করেন। বিভিন্ন সময়ে যারা কানাডা জার্নালে সহযোগিতা করেছেন যেমন মাহবুব ওসমানী এবং মনিষ পালকেও মঞ্চে আহবান করা হয়। উল্লেখ করা হয়,  ব্যারিস্টার ওমর হাসান আল জাহিদ, ব্যারিস্টার শামীম আরা, সিপিএ মোর্শেদ নিজামের কথা।  প্রধান পৃষ্ঠপোষক সূর্য চক্রবর্তী তার বক্তব্যে বলেন তাঁরা অত্যন্ত আনন্দিত আর গর্বিত এমন একটা মহতি উদ্যোগের অংশ হতে পেরে। তাঁরা ভবিষ্যতেও বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির প্রসারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

এরপর মঞ্চে এক এক করে ডাকা হয় বইয়ের সকল লেখককে যাদের লেখাগুলো জ্বলজ্বল করছে ‘কানাডা বিবিধ প্রসঙ্গ’ বইটিতে। তাঁদের হাতে তুলে দেয়া হয় বহু কাঙ্ক্ষিত বইটিকে।

‘কানাডা: বিবিধ প্রসঙ্গ’ বইটির সম্পাদক সুব্রত কুমার দাস অনেক আগে থেকে স্বপ্ন দেখতেন এমন একটা বইয়ের যেখানে কানাডায় বসবাসরত বিপুল সংখ্যক  লেখকের লেখা থাকবে। এই বইটি তাঁর স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ। তিনি বলেন, এই বইতে কানাডার সব বাঙালি লেখকের লেখা নেই। তবে তিনি বলেন “এখানে লেখক সংখ্যা ৩০ না করে ৩০০ হলেও দেখা যেত অনেক লেখক বাদ পরে গেছেন।” পরবর্তীকালে এরই বইয়ের ধারাবাহিকতায় তিনি আরেকটি ৬০০ পৃষ্ঠার বই প্রকাশের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন যাতে থাকবে যেটিতে তিনি কানাডায় থাকা এক শত বাঙালি লেখককে অন্তর্ভুক্ত করতে চান। তিনি বলেন, আমরা যারা বাঙালি লেখক আছি , তারা যদি এক থাকতে পারি , যুথবদ্ধ থাকতে পারি, তাহলে আমরা অনেক বেশি এগুতে পারবো।” তিনি টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল অব অথরস (টিফা)র কথা উল্লেখ করে বলেন “২০২০, ২০২২ ও ২০২৩ সালে আমরা আমন্ত্রণ পেয়ে অংশগ্রহণ করি। সেটি সম্ভব হয়েছিল কারণ মূলধারার আয়োজকেরা বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলা ভাষা এখন টরন্টোর একটি প্রধান ভাষা।“ তিনি বলেন, আমরা একসাথে কাজ করলে বাংলা ভাষা, সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।

এরপর বক্তব্য রাখেন ডা তরুন। তিনি আমাদের কমিউনিটির একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি সমাজের একজন হিসাবে নিজেকে উল্লেখ করেন। তিনি আমাদের চিন্তা ভাবনার সাথে আমাদের সন্তানদের যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে তা উল্লেখ করেন। তিনি এটাকে পজিটিভলি নিয়ে তাদের সামনে আমাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য লেখাকে একটা মহতি উদ্যোগ মনে করেন। চিকিৎসা শাস্ত্র রসহীন হলেও কানাডার চিকিৎসা ব্যবস্থার নিয়ে তিনি লেখাটি পড়েছেন। এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা হজবরল অবস্থায় আছে সেটা উল্লেখ করেন। তিনি এতোজন লেখককে একসাথে করে একটা বই প্রকাশ করার জন্য বইটির সম্পাদক সুব্রত কুমার দাসের সফল চেষ্টার প্রশংসা করেন। সাথে শহিদুল ইসলাম মিন্টু, সূর্য চক্রবর্তীর সাপোর্টকে এবং সুন্দরভাবে তুলে ধরে সমাজের বিত্তবানদের আহ্বান জানান আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিতে ভাল কাজগুলোতে সাথে থাকার জন্য। আমাদের বাঙালি কমিউনিটির লোক সংখ্যা বাড়ছে। তাদের একতা আর ভাল কিছুর করার চেষ্টার মাধ্যমেই কানাডায় আমাদের আইডেন্টিটির মজবুত হবে।

এরপর মঞ্চে আসেন বাংলামেইলের সম্পাদক এবং এনআরবি টেলিভিশনের সিইও শহিদুল ইসলাম মিন্টু। যার সহযোগিতায় ‘কানাডা বিবিধ প্রসঙ্গ ‘ বইটির সম্পাদক সুব্রত কুমার দাসের উদ্যোগে বাংলা মেইলের বিশেষ সংখ্যায় ত্রিশজন লেখকের প্রবন্ধগুলো প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি সুব্রত কুমার দাসের উদ্যোগ আর চিন্তাকে ভালবাসা আর শ্রদ্ধা দিয়ে সামনে এগিয়ে নিতে পাশে থাকেন। তিনি বাংলাদেশের কৃষ্টি সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে বরাবরই সাথে থাকেন তাঁর মিডিয়ার মাধ্যমে। তিনি সবকিছুকে সংখ্যা হিসাবে দেখেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বারেবারেই কানাডার রাজনীতির কথা তুলে ধরেন। ডাঃ তরুন এবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে গতবারের প্রার্থীর প্রায় দ্বিগুণ ভোট পান। তাই তিনি মনে করেন ভাল কাজের মাধ্যমে মানুষের সংখ্যাগুলো দ্বিগুণ, তিনগুণ হয়ে যায়। তিনি বাঙালি অভিবাসীদের প্রেমিক মন হিসাবে আখ্যা দেন। যারা মুখে কিছুই বলতে পারে না।

বইটির মূল লক্ষ্য অভিবাসী বাঙালি সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদেরই মাতৃভাষায় পরিবেশিত। তাদেরই নির্বাচিত প্রবাস ভূমির সাথে আগ্রহ ও পরিচয় গড়ে তোলার চেষ্টা এটি।  অভিবাসীদের সংগ্রাম এবং অভিবাসী পরিচয়ের সঙ্কট বা বিপন্নবোধ নিয়ে এমন ইতিবাচক, আগ্রহবর্ধক রচনাসংগ্রহ তেমন চোখে পড়ে না। সম্পাদক সুব্রত কুমার দাসের পরিকল্পনায় সবার সম্মিলিত প্রয়াসে বাঙালি-কানাডীয় আইডেন্টিটির মেলবন্ধনের দিকে একটি ছোট্ট কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপ।

এরপর সদ্য প্রকাশিত বইটি নিয়ে আলোচনা করেন গবেষক ড. ফজলুল হক সৈকত। তিনি একজন লেখক প্রাবন্ধিক‌। তিনি বলেন, “আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি এই বইয়ের ত্রিশ জন লেখকের প্রতি। কেননা তারাই মূল কারিগর। যদি এটাকে উৎপাদন বলি , শিল্পই বলি , কৃষিই বলি যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন তারাই মূল শক্তি।“ তিনি বলেন এই বইটি যারা পড়েছেন বা পড়বেন তারা নিশ্চয় জানবেন কানাডার সম্পর্কে লোকেদের আকর্ষণের কারণ কী? তিনি বইটিকে দেখেছেন একটা জ্ঞানকোষ হিসাবে। তাঁর ধারণা এই ত্রিশজন লেখক যে যে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তারা সে বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন। তিনি ধন্যবাদ দেন সম্পাদক সুব্রত কুমার দাসকে এই ত্রিশ জন লেখককে খুঁজে বের করার জন্য।