ক্যালগেরী পাবলিক লাইব্রেরি
“মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া-পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। … … লাইব্রেরির মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপরে দাঁড়াইয়া আছি। কোনো পথ অনন্ত সমুদ্রে গিয়াছে, কোনো পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়াছে, কোনো পথ মানবহৃদয়ের অতলস্পর্শে নামিয়াছে। যে যে দিকে ইচ্ছা ধাবিত হও, কোথাও বাধা পাইবে না। মানুষ আপনার পরিত্রাণকে এতটুকু জায়গার মধ্যে বাঁধাইয়া রাখিয়াছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
২০০০ সালে আমি এবং ২০০১ সালে স্ত্রী সেবা শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে গিয়েছি। জ্যেষ্ঠ সন্তান জয়দীপ ২০০৫ সাল থেকে কর্মসূত্রে ক্যালগেরীর বাসিন্দা। ২০০৭ সালে দু’দফায় নয় মাস কানাডার আলবার্টা প্রদেশের অনিন্দ্যসুন্দর শহর ক্যালগেরীতে বেড়িয়ে এসেছি। ওর আগ্রহে ২০১৩ সালে সস্ত্রীক মোটামুটি স্থায়ী ভাবে থাকার জন্য ক্যালগেরী এলাম বাংলাদেশের নিজ শহর নাটোরের আজন্ম পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে। বেড়াতে যাওয়া এক, স্থায়ী ভাবে থাকা অন্য কথা। প্রশ্ন হলো ওখানে সময় কাটবে কী ভাবে!
মহাভারতের সূচনা পর্বের একটা কথা আমার বড়ো ভালো লাগে- ‘কেন হি অবসরঃ কালো যাপনীয়ো বৃথা ন হি’। কি ভাবে অবসর কাল বৃথা হতে না দিয়ে যাপন করা যায়! আমাদেরও অখণ্ড অবসর। অবসরের সবচেয়ে আনন্দময় সঙ্গী বই। নাটোরে আমাদের পারিবারিক লাইব্রেরি মোটামুটি সমৃদ্ধ। জয়দীপের বাসাতেও শ’তিনেক বইয়ের সংগ্রহ গড়ে তোলা হয়েছে। এগুলো আমাদের নিত্যসঙ্গী। তবে তা যথেষ্ট নয়।
বইয়ের খনির সন্ধানে পেয়ে গেলাম অসাধারণ গ্রন্থাগার ‘ক্যালগেরী পাবলিক লাইব্রেরি’। সিটি হলের পেছনের রাস্তায় নবনির্মিত অভিনব বিশাল কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি সহ শহর জুড়ে রয়েছে ২১টি শাখা। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে পৃথিবীর প্রায় সব ভাষার বই পাওয়া যায়, তবে ইংরেজি বই বেশি। অন্যান্য শাখার চার-পাঁচটি বাদে প্রায় সবগুলোতেই কম-বেশি বাংলা বই আছে।
১৯১২ সালের ২ জানুয়ারি স্থাপিত ‘ক্যালগেরী পাবলিক লাইব্রেরি’ বর্তমানে টরান্টো পাবলিক লাইব্রেরির পর কানাডার দ্বিতীয় এবং উত্তর আমেরিকার ষষ্ঠ বৃহত্তম ব্যবহৃত লাইব্রেরি ব্যবস্থা। তেরো লক্ষ জনসংখ্যা অধ্যুষিত ক্যালগেরী শহরের প্রায় সাত লক্ষ মানুষই লাইব্রেরি কার্ড সদ্ব্যবহার করেন। এখানে বাসে-ট্রেনে মানুষ বই পড়ছে এটা অতিপরিচিত দৃশ্য।
একদিন বধূমাতা লোপামুদ্রার সাথে আমাদের সবচেয়ে কাছে লাইব্রেরির ক্রোফুট শাখায় গিয়ে একজন কর্মীকে আলবার্টা ফটো আইডি দেখালে কয়েক মিনিটের মধ্যে লাইব্রেরি কার্ড পেলাম। ইমেইল আইডি ও বাসার ফোন নম্বর দিতে হলো। সদস্য হওয়ার জন্য কোন ফি নাই। নাই কোন রকম মেম্বারশিপ ফি। তিন রঙের কার্ড থেকে যে কোন একটা বেছে নেয়া যায়। কার্ডে সদস্যর নাম লেখা থাকে না। সদস্যের সকল তথ্য কমপিউটারে সংরক্ষিত। কার্ডের এক পিঠে বার কোডের নিচে ১৪ সংখ্যার আইডি নম্বর। আমার পছন্দের ‘ইউজার নেম’ ও ‘পিন নম্বর’ সেট করে দিলেন। এই কার্ড দিয়ে ক্যালগেরী পাবলিক লাইব্রেরির যে কোন শাখা থেকে শুধু বই নেয়া নয়, অন্যান্য সুবিধেও গ্রহণ করা যায়। সকল রকম লাইব্রেরি সুবিধে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। লাইব্রেরিতে সাহায্য করার জন্য সদাহাস্যমুখ কর্মীরা আশে পাশেই রয়েছেন। তবে একবার নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে গেলে কারো সাহায্য ছাড়াই সব কিছু করা যায়।
সারি সারি শেলফে থরে থরে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ের বই, অধিকাংশই ইংরেজিতে। ‘ওয়ার্ল্ড ল্যাঙ্গুয়েজ’ শেলফে অন্যান্য ভাষার সাথে বাংলা ভাষার বই রয়েছে। শহরের যে সব এলাকায় বাঙালির সংখ্যা বেশি সে সব লাইব্রেরিতে বাংলা বইও বেশি থাকে। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে শ’দেড়েক, অন্যান্য শাখায় বিশ থেকে পঞ্চাশ-ষাট খানা।
বই ইস্যু করার জন্য সব শাখাতেই একাধিক, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে আট দশটি চেক-আউট কমপিউটার আছে। শেলফ থেকে বই নিয়ে চেক-আউট কমপিউটারে লাইব্রেরি কার্ড স্ক্যান করে পিন নম্বর পোস্ট করে এন্টার চাপলেই কমপিউটার প্রস্তুত বই ইস্যুর জন্য। একটা একটা করে বই নির্দিষ্ট স্থানে রাখলেই ডিসপ্লেতে বইয়ের নাম আসতে থাকবে। সব বই হয়ে গেলে ‘ডান’ বোতাম চাপলে তিনটি বিকল্প আসবে। কি কি বই নিলে তার লিস্টের প্রিন্ট চাও, অথবা না চাও না, অথবা ইমেইলে চাও? প্রিন্ট অপশনে টাচ করলে প্রিন্ট বেরিয়ে আসবে, ইমেইল অপশান টাচ করলে সঙ্গে সঙ্গে মেইল চলে আসবে। একসাথে বিশ তিরিশটি বইও তোলা যায়। একটা বই একুশ দিন রাখা যায় এবং সময় শেষ হওয়ার দু’একদিন আগে রিনিউ করা যায়। এভাবে তিন বার পর্যন্ত রিনিউ করা যায়। রিনিউ করার জন্য লাইব্রেরিতে যেতে হয় না, নিজের কমপিউটার থেকেই অনলাইনে রিনিউ করা যায় শুধুমাত্র ‘রিনিউ’ অপশানে একটা ক্লিক করে। এখন তো তা-ও করতে হয় না। সময় পেরিয়ে গেলে অটো-রিনিউ হয়ে সে তথ্যও ইমেইলে চলে আসবে। তবে যদি ইস্যু করা কোন বইয়ের জন্য কোন কার্ডহোল্ডার রিকুইজিশান দিয়ে থাকে তবে সেটা রিনিউ হবে না, ফেরত দিতে হবে।
বই ফেরত দেবার জন্য লাইব্রেরিতে যেতে হবে। যেখান থেকে নিয়েছি সেখানেই ফেরত দিতে হবে এমন নয়, যে কোন শাখাতেই ফেরত দেওয়া যাবে। ফেরত উইনডোতে নির্দিষ্ট স্থানে একটা একটা করে বই রাখলে স্লটই বই টেনে নেবে। ইস্যু করা সব বই একসাথে ফেরত দিতে হবে তা-ও নয়। যে কটা খুশি ফেরত দিতে পারব। ফেরত হয়ে গেলে ‘ডান’ বোতাম চাপলে আবার আগের মতোই তিনটি অপশান আসবে। আমি যা চাই সেই অপশান পছন্দ করতে পারব। লাইব্রেরি খোলা থাকতে বই ফেরত দিতে হবে তা-ও নয়। বন্ধ থাকলেও বাইরের ‘ফেরত উইনডো’তে বই ড্রপ করা যাবে। তবে সে ক্ষেত্রে ফেরতের রেকর্ড তখনই পাওয়া যাবে না। পরদিন বাসার কমপিউটারে লাইব্রেরির ওয়েব সাইটে গিয়ে ‘সাইন ইন’ করে চেক-আউটে’ ঢুকলেই দেখা যাবে আমার কাছে কোন কোন বই রয়ে গেল।
যদি আমার আগ্রহের কোন বই আমি খুঁজে না পাই তবে লাইব্রেরি স্টাফকে বললে তারা অনলাইনে চেক করবে বইটি লাইব্রেরি সিস্টেমে আছে কি না। যদি সেই শাখাতে থাকে তারা বইটি এনে আমাকে দেবে। যদি অন্য কোন শাখায় থাকে তবে আমি রিকুইজিশান দিলে তারা বইটি এনে আমি যে শাখা থেকে নিতে চাই সেখানে ‘হোল্ডে’ রেখে আমাকে ইমেইলে বলবে এক সপ্তাহের মধ্যে গিয়ে বইটি ইস্যু করে নিতে। যদি বইটি আদৌ না থেকে সে ক্ষেত্রে তারা চেষ্টা করবে বইটি ক্রয় করে আমাকে দিতে।
কোন বই লাইব্রেরিতে আছে কি না তা আমি নিজেও লাইব্রেরি সিস্টেমে ঢুকে দেখতে পারব আমার কার্ড দিয়ে। ছাপান বই ছাড়াও লাইব্রেরিতে অনেক ই-বুক আছে, সেখান থেকেও আমি বই ইস্যু করতে পারব।
প্রতিটি লাইব্রেরিতে অনেক ল্যাপটপ আছে। আমি কার্ড দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ল্যাপটপ ইস্যু করে ব্যবহার করতে পারব, তবে ওখানে নির্দিষ্ট এলাকাতে বসেই ব্যবহার করতে হবে।
আর একটা সুবিধে। একটি লাইব্রেরি কার্ড ব্যবহার করে প্রত্যেক ক্যালেন্ডার মাসে ওদের প্রিন্টার থেকে ৫০ পৃষ্ঠা সাদা-কালো কপি অথবা ২৫ পৃষ্ঠা রঙিন কপি ফ্রি প্রিন্ট নিতে পারব। আমার দরকার হলেই ওয়ার্ড ফাইল পেন-ড্রাইভে নিয়ে গিয়ে ওখান থেকে প্রিন্ট নিয়ে আসি। এমন কি বাসার কমপিউটারেও প্রিন্ট অর্ডার দিয়ে লাইব্রেরিতে গিয়ে প্রিন্ট নিতে পারব। কাগজ-কালি সব ওদের। নির্ধারিত কমপিউটারে সাইন-ইন করে কার্ড নম্বর ও পিন নম্বর দিয়ে এন্টার চাপলে কমপিউটার প্রস্তুত। পেনড্রাইভ থেকে ওয়ার্ড ফাইল খুলে প্রিন্ট কম্যাণ্ড দিয়ে প্রিন্টারে যেতে হবে। সেখানেও একই ভাবে সাইন-ইন করে জব অর্ডার খুলে কাঙ্খিত ফাইল সিলেক্ট করে প্রিন্ট কম্যাণ্ড দিলে ছাপা শুরু হয়ে যাবে। কাজ শেষ হলে প্রিন্টার এবং কমপিউটার আবার সাইন-আউট করতে হবে। প্রথমে একটু জটিল মনে হওয়ায় দুই’এক বার লাইব্রেরি স্টাফের সাহায্য নিতে হয়েছে, এখন আমি নিজেই পারি।
চমৎকার দৃষ্টিনন্দন শৈলীতে নবনির্মিত চারতলা বিশাল সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে রয়েছে শিশুদের কর্নার। আছে ছোটো একটি স্ন্যাক ও কফি কর্নার। সেন্ট্রাল লাইব্রেরি ক্যালগেরী মেট্রোর ‘সিটি হল’ স্টেশান সংলগ্ন। সেথায় আমার নিত্য আনাগোনা।