গল্পকার আতোয়ার রহমান ও ‘মধ্যরাতের শিকার’

ফজলুল হক সৈকত

বাংলাদেশি-কানাডিয়ান গল্পকার আতোয়ার রহমানে দ্বিতীয় গল্প-সংকলন ‘মধ্যরাতের শিকার’। এর আগে তিনি গল্পের ডালি নিয়ে পাঠকের কাছে হাজির হন ২০১৫ সালে; ১১টি গল্পের সংকলন ‘যাপিত জীবন’ নামে লেখকের প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ঢাকার বিভাস প্রকাশনী থেকে। ওই বই-এর বেশিরভাগ গল্প কানাডাভিত্তিক। বর্তমান গ্রন্থটিতে মোট ২৩টি গল্পে জায়গা জুড়ে আছে বাংলাদেশ ও কানাডার মানুষ, জীবনধারা এবং প্রতিবেশ। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে ‘আড়িয়াল প্রকাশনী’। বিপণন-ব্যবস্থাপনায় রয়েছে গতি প্রকাশন।

আতোয়ার রহমানের জন্ম রংপুরে মিঠাপুকুরের গিরাই গ্রামে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। পরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলোশীপ নিয়ে সম্পন্ন করেন এমফিল ডিগ্রি। সরকারি কলেজে শিক্ষকতায় যোগদান করেন ১৯৯৬ সালে। জগন্নাথ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হলে প্রায় ৪ বছর সেখানে পাঠদান করেন। আতোয়ার লেখালেখি শুরু করেন ছাত্রজীবনে। স্কুল-কলেজের ম্যাগাজিনে ২-৪টি কবিতা ছাপা হয়েছে। আতোয়ারের টরন্টো জীবন শুরু হয় ২০১০ সালে। ২০১৩ সালে তাঁর শিক্ষক রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের প্রফেসর আলী আনোয়ারের মৃত্যুর পর স্মৃতিমূলক লেখা দিয়ে টরন্টোতে অভিবাসী-লেখক জীবনে শুরু। টরন্টো থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বাংলা কাগজ’-এ লেখাটি প্রকাশিত হয়। নিবন্ধটি বাংলাদেশের ‘দৈনিক সমকাল’-এর সাহিত্যপাতা ‘কালের খেয়া রিপ্রিন্ট করে। ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা দেখে ভালো লাগার অনুভব থেকে লিখতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন আতোয়ার রহমান। ফেলানীর ঘটনা তাকে বিমর্ষ করে। লেখেন সে বিষয়েও। এভাবে লেখার জগতে প্রবেশ। জাহিদ হাসানের গল্পের রিভিউ করেন তখন। জাহিদের গল্পে তিনি প্রবাস-জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান। দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত মনের আতোয়ার তখন ‘জীবনের গল্প’ লিখতে শুরু করেন। নিজেকে কাহিনির কেন্দ্রে রেখে প্রবাসজীবন ও মাতৃভূমির স্মৃতিকাতরতা এবং নতুন জীবনের অনিশ্চয়তা, শঙ্কা তার গল্পে স্থান পেতে থাকে। নতুন জীবনে রাতের শিফটে কাজ করার ফাঁকে লিখতে শুরু করেন তিনি- নিজের গল্প, অপরের গল্প। লেখার জন্য কিছু গল্পের বইও যোগাড় করেন তখন- সাম্প্রতিক গল্পের কাঠামোর সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য। বিশেষ করে কোভিডের সময় ঘরে বসে সময় কাটাতে গিয়ে গল্প লেখায় বেশি মনোযোগী হয়ে ওঠেন আতোয়ার। বর্তমানে তিনি ‘বাংলা কাগজ’-এর নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

আতোয়ারের গল্পের বিবরণে একধরনের অভিভাবকীয় প্রৌঢ়ক্তির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন হতে পারে এটা। সহজ করে বললে এমন দাঁড়ায় যে, গল্পকার আতোয়ার জীবন-বিষয়ক পরিণত-উপলব্ধির প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁর ‘মধ্যরাতের শিকার’ গল্পগ্রন্থে। তিনি তীক্ষ্ণভাবে অনুভব করেছেন চরিত্রগুলোর বিচরণ, লক্ষ্য করেছেন সামাজিক অধোগতি, বস্তুগত সামাজিক অগ্রগতির মেকি-হাওয়া এবং জীবনের যাবতীয় জটিলতা; অত্যন্ত সহজ বর্ণনার ভেতর দিয়ে কোনো কোনো গল্পে তুলে ধরেছেন কঠিন-সংকটের কথালাপ। সমাধান হয়তো এখানে লেখকের লক্ষ্য নয়, তবে সামাজিক সচেতনতা কিংবা শুভবোধ ও অকল্যাণচিন্তার মধ্যে সংযোগ সৃষ্টি ও সমন্বয় সাধনের একটি মৃদু বাসনা যে সেখানে প্রথিত রয়েছে, তা অনুমান করা যায়। ‘মধ্যরাতের শিকার’ বইটিতে পাঠক একজন মৃদুভাষী গল্পকারকে পেয়ে যাবেন অনায়াসে। কিন্তু তাঁর বক্তব্যে ও বিশ্লেষণে সমাজের ও রাষ্ট্রের যে বিপুল বিপর্যয়কে ধারণ করেছেন তিনি, তা ঠাহর করতে খানিকটা ডুব দিতে হয় কল্পনা ও ভাবনার ভুবনে। পরিকল্পনা, বিশেষ করে সুখ-কেন্দ্রিক নেতিবাচক পরিকল্পনা যে মানুষের জীবন বিপন্ন করার পাশাপাশি টোটাল সমাজ-ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে দেয়, আতোয়ারের গল্প পড়তে পড়তে পাঠক সেরকম এক জার্নির ভেতর দিয়ে যাবেন আশা করি। গল্পগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো পাঠককে প্রস্তুত করে তোলা; বর্ণনায় ও বিবরণে সে-রকম আতিথেয় আহ্বান নজরে আসে। নামগল্পের সূচনাংশ থেকে খানিকটা পাঠ নেওয়া যেতে পারে: ‘আসলাম সাহেব শালবনের ভেতরের ছোট্ট রিসোর্টটির ম্লান আলোয় আচ্ছন্ন পিছনের সরু গলি ধরে হাঁটছেন। বড়ো রাস্তা থেকে নেমে আসা এবড়ো-থেবড়ো ইট বসানো পুরাতন ক্ষয়িষ্ণু রাস্তাটি বনের ভেতর দিয়ে উত্তর দিকে দুই কিলোমিটার এগোলে জঙ্গলের কেন্দ্রে একটুখানি ফাঁকা জায়গায় সবুজ বুনো ঘাসে মোড়া মাঠে অমসৃণ দেয়ালের ধূসর লাল ইটের তিনতলা পুরনো ভবন। গাছপালায় আর লতাগুল্মে মাকড়সার জালের মতো ঢেকে আছে পুরো বাড়ি। পরিত্যক্ত বাড়িই বলা যায়। একটু উঁচু থেকে চোখ মেললে দেখা যায়, মাইলের পর মাইল ঘন বনে ছেয়ে আছে। গাজীপুরের শালবনের ভেতরের এক ভিড়-ঝামেলা-বিহীন এই জায়গাটি সত্যিই অপূর্ব। প্রকৃতি যেন এখানে আত্মমগ্ন হয়ে সৌন্দর্যের আঁকিবুকি কাটে। সামনে কেয়ারি করা ফুলের বাগান। নীরব নিস্তব্ধ চারদিক। কাছে কোনো লোকালয় নেই। ছড়ানো-ছিটানো ছোট ছোট কিছু ফ্যাক্টরি দেখা যায় দূরে দূরে। রিসোর্টের সীমানা ঘেঁষে একটি শীর্ণ নদী সাপের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে, পাড়ঘেঁষে আগাছা ও ফার্নগাছ ঘেরা একটি পুরনো জীর্ণ শ্মশান। ব্যবসায় ডুবে থেকে হাঁপিয়ে উঠলে তিনি মাঝে মাঝে এখানে এসে শহরের বাইরে নিরালা নির্জনে শহুরে মনের ভারকে লাঘব করার জন্য সাময়িক অবসর যাপন করেন। গাছে ছাওয়া রাস্তাটা ধরে বিকেলে হাঁটাহাঁটি করেন, ক্লান্ত হলে সামনের বিশাল কাঠগোলাপ গাছটির নিচের বেঞ্চে বসে একটু জিরিয়ে নেন। আজও আধঘন্টা হাঁটার পর একটু বিশ্রামের জন্য গা এলিয়ে ধরলেন।’

আতোয়ার রহমানের গল্পগুলো জীবন-নিবিড়তায় পূর্ণ। তিনি সংলাপের মধ্য দিয়ে চলমান সমাজ-কাঠামো, পারিবারিক বন্ধন, প্রবাসজীবন, দুর্নীতিপ্রবণতা, শুদ্ধাচারের কল্পনা ও পরিকল্পনা- এসব নানান বিষয় পাঠকের কাছে যেন নতুন কনে পুনরায় প্রকাশ করতে চেষ্টা করছেন; যেন লোকেরা সবই জনেন-বোঝেন কিন্তু অতোটা খেয়াল করছেন না বা ঠিক পাত্তা দিচ্ছেন না- এমন। মানুষ যে লোভনীয় জীবনের দিকে ঝুঁকছে, অপরাধের মধ্যে নিমগ্ন হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষকের মতো অনুভব করেছেন আতোয়ার; এই মোহ থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে, তারই বিচিত্র নিরীক্ষা রয়েছে এসব গল্পে। তবে, সংকট থেকে উত্তরণের দিক-নির্দেশনা নয় এগুলো- কেবলই পর্যবেক্ষণ আর ভাবনার বিনীত প্রক্ষেপণ। প্রেম, দাম্পত্য, স্মৃতিরোমন্থন তাঁর গল্পে সাধারণ বর্ণনায় তুলে ধরে জীবনের ছায়া ও ছবি। আতোয়ারের গল্পের আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো মানুষের কল্পনাশক্তিকে পুঁজি করে সমাজকে অনুভব করার শক্তিগুলোকে আরেকবার নাড়িয়ে দেওয়ার চিন্তা। শিল্পী-সাহিত্যিকরা যুগে যুগে সভ্যতা নির্মাণে ও সমাজ-সংস্কারে তাঁদের ভাবনার বিস্তার করে গেছেন। আতোয়ার রহমানের বর্তমান গল্পগুলোতে সমাজ-সংস্কারভাবনা প্লাবনের পানির মতো প্রবাহমান- এমনটা ভেবে নেওয়া যেতেই পারে। যেহেতু আতোয়ার বাংলাদেশি-কানাডিয়ান, তাই তাঁর অনুভব ও প্রকাশে দুই দেশের ছায়া ও মায়া ক্রিয়াশীল থাকে প্রখরভাবে। কোনো কোনো গল্পের সংলাপ এবং চরিত্রও ধারণ করে লেখকের সেইসব উপলব্ধি। যেমন, ‘নাড়ির টান’ গল্পে পিটার ও মাসুদের কথোপকথনে ফুটে ওঠে ‘নিজভূমে পরবাসী’র অনুভব-রাজ্য:
‘- তুমি কতোদিন আগে কানাডায় এসেছো?
– কুড়ি বছর আগে।
– দেশে যাওনি?
– না।
– বল কী? গত কুড়ি বছরে একবারও দেশে যাওনি?

পিটার বেশ আশ্চর্য হলেন।

– না, একবারও না।
– আমি তোমার সমস্যা ধরতে পেরেছি। তুমি যত দ্রুত পারো দেশে বেড়াতে যাও।
– কেন?
– কারণ, দীর্ঘদিন দেশে না যাওয়াতে তোমার মনপ্রাণটা হয়ে আছে দেশে ভরপুর। ওপরে যাই হোক, ভেতরে ভেতরে সবসময় একটা মনকেমনের বালাই নিয়ে ঘুরছো। তুমি টরন্টোর দিকে চেয়ে থাকছো আর বাংলাদেশের কথা ভাবছো। তুমি ভেতর থেকে শিকড় উপড়ে কানাডায় চলে আসোনি। খিলান, ঘর, বারান্দা লোকেদের আচ্ছন্ন করে রাখে, বাড়ি ছেড়ে গিয়ে প্রায় মৃত্যুর কোলে পৌঁছে গেলে তাকে আবার পুরনো বাড়িতে নিয়ে আসে। ফেলে আসা দেশ, ঘর, খিলান, বারান্দা তোমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। অনেকদিনের না দেখা বাড়ি তোমার মনের ভেতরে জেগে আছে ভোরের শুকতারার মতো উজ্জ্বল হয়ে। তুমি দেশের এই ঘোর থেকে বের হতে পারছো না। তাই তোমার লেখায় আঁকা ছবিতে দেশ ছাড়া অন্য কিছু ভিড় করতে পারছে না। তুমি যদি বছর বছর দেশে আসা-যাওয়া করতে, তখন দেখতে যা ঢাকা, তা-ই টরন্টো।’

আতোয়ার রহমানের ‘মধ্যরাতের শিকার’ গ্রন্থের গল্পগুলো সাধারণভাবে জীবনের গল্প। কখনো রাজনীতি, কখনো সমাজ কখনো-বা সাংসারিক জীবনের প্রতিদিনের চালচিত্র শব্দের সাজানো বাগানের মতো উঠে এসেছে এখানে। গল্পগুলোতে আনন্দ আছে, আনন্দের পেছনে আছে শিক্ষা, আছে চেতনা; আতোয়ারের অনুভবগুলো লেপ্টে আছে শব্দের শরীরে শরীরে। অনুভবজ্ঞানে পরিশুদ্ধ হওয়ার প্রাথমিক পাঠ এই গল্পগুলোতে পাওয়া যেতে পারে। বইটির ‘প্রসঙ্গ-কথা’য় গল্পকার লিখেছেন: ‘এখানে সংলাপগুলোকে বলা যায় আমার একান্ত কল্পনা। কোনো কোনো কল্পনা শিল্পের খাতিরে খানিকটা পরিকল্পনা করে লিখতে হয়েছে। বর্তমান গ্রন্থের ক্যানভাস বা পটভূমি বাংলাদেশ ও কানাডা। আমার জীবনের দুটি অধ্যায় এখানে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে এক কাতারে দেখা যাবে। আমার দেখা ভুবনে, জানা জগতে মানুষগুলো কেমন আছে, দেশের রাজনীতি নিয়ে কী ভাবছে- এসব চিন্তা নিজের কল্পনার সাথে মিলিয়ে নিয়েছি। যদি সাহিত্য বা শিল্পের মাধ্যমে সমাজের রূপ-রূপান্তর ও পরিবর্তনের ইঙ্গিতকে সমর্থন করে, তাহলে বলা যেতে পারে এখানে সে রকমের কিছু ধারণা থাকলেও থাকতে পারে। সামাজিক অন্যায় থেকে, প্রেমের দোলাচল থেকে, সংসারের সংকট থেকে লোকেরা মুক্তি চায়। কিন্তু কী করে মুক্তি মেলে, তা আমাদের অনেকের জানা নেই; জানা থাকে না। বর্তমান গ্রন্থে গল্পগুলোর সংলাপের ভেতর দিয়ে জীবনের সংকট মোকাবেলার কিছু ধারণা সামনে আনার চেষ্টা করেছি মাত্র। সত্যিকার অর্থে, বইটি আমাদের চারপাশে পরিচিত ভুবনের সামাজিক জীবনের এক সাধারণ ছবি বললেও ভুল হবে না।’

আতোয়ার রাজনীতি-সচেতন মানুষ। তিনি জানেন যে, রাজনীতিই সমাজকে, মানুষকে বৃহত্তর অর্থে নিয়ন্ত্রণ করে। আবার মানুষই যে তার চিন্তা কল্পনা আর পরিকল্পনা দিয়ে সমাজকে বদলাতে পারে, নতুন শেপ দিতে পারে রাজনীতির আস্তিতে, তা আতোয়ারের অজানা নয়। গল্পের মধ্য দিয়ে তিনি ওই জানা কথাগুলোকেই কেবল নতুন করে পরিবেশন করতে চাইছেন হয়তো। নিজের কথা অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়ার এ এক শিল্পকৌশল মাত্র। ‘মধ্যরাতের শিকার’ ওরকম এক কৌশলেরই আশ্রয়।

গল্পগ্রন্থ: মধ্যরাতের শিকার
গল্পকার: আতোয়ার রহমান
প্রকাশনা সংস্থা: আড়িয়াল প্রকাশনী, মন্ট্রিয়ল-ঢাকা
প্রকাশক: শামীম ওয়াহিদ
প্রচ্ছদশিল্পী: সবওয়ারা জাহান জেরিন
বাংলা একাডেমি বইমেলা স্টল: গতি প্রকাশন, ১১৭
এবং লিটলম্যাগ চত্বর স্টল: ১০ (ধূলিপথ)
টরন্টোতে প্রাপ্তিস্থান: এটিএন বুক স্টোর, ড্যানফোর্থ