গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ
জহরলাল নেহেরু বলতেন যে, ভারতবর্ষকে জানতে হলে দুজনকে জানলেই চলবে – মহাত্মা গান্ধী এবং গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথমজন যদি ভারতের শরীর হন, তাহলে দ্বিতীয় জন ভারতের আত্মা। ভারতের এই আত্মাকে জানতে হলে আমাদের প্রাচীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে জানতে হবে। প্রাচীন ভারতীয় সমাজে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও শিক্ষকের মর্যাদার আসন ছিল। তারই ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি সম্রাট অশোক এবং বিক্রমাদিত্যের মতো নৃপতি, চাণক্যের মত কুশাগ্রবুদ্ধি প্রশাসক, চরক ও সুশ্রুত-এর মত চিকিৎসা বিশারদ, পানিনি এবং পতঞ্জলির মত বৈয়াকরণ, মহাকবি কালিদাসের মত নাট্যকার, অশ্বঘোষ, বরাহমিহির ও ভবভূতির মত চিন্তাবিদ, প্রজ্ঞাপারমিতা, গার্গী, লোপামুদ্রার মতন বিদুষী এবং আধুনিক ভারতবর্ষের যুগপুরুষ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ এবং মহাত্মা গান্ধী।
স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে
শিক্ষার অনেক পরিভাষা আছে। সবচেয়ে ভালো লাগে স্বামী বিবেকানন্দের পরিভাষা। তিনি বলেছেন, “Education is the manifestation of the perfection already in a man”. অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই সম্পূর্ণতার যে বীজ আছে তার বিকাশের নামই শিক্ষা।
শিক্ষার গুরুত্ব কম-বেশি সব সমাজেই স্বীকৃত। বিভিন্ন দেশে শিক্ষকের বিভিন্ন নাম – টিচার মাস্টার, টিউটর, কাউন্সেলর, গাইড, মেন্টর ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার কাছে শিক্ষকের অর্থবহ শব্দ মনে হয় গুরু শব্দটা। দুটি শব্দের সমষ্টি ‘গু’ এবং ‘রু’। ‘গু’ অর্থাৎ গুহ্য, গুপ্ত, রহস্যময়,অতীন্দ্রিয় আর ‘রু’ শব্দের অর্থ প্রকাশিত করা, আলোকিত করা, আলোকপাত করা। জীবনে অতীন্দ্রিয় রহস্যে যিনি আলোকপাত করেন তিনি গুরু। আমরা সবাই জানি যে, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ এবং মহাত্মা গান্ধী এই যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষক।
সার্থক শিক্ষা
শিক্ষাকে সার্থক হতে হবে। খন্ডিত শিক্ষা শিক্ষার উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করে। ইংরেজ কবি আলেকজান্ডার পোপের কথায়,
A little learning is a dangerous thing,
Drink deep or taste not the fiery spring,
A shallow draught intoxicates the brain,
And drinking largely sobers it again .
কেবল পুঁথিগত শিক্ষার কুফল কবিগুরু তাঁর তোতা কাহিনীতে দেখিয়েছেন। শান্তিনিকেতনে তিনি যে শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন তাতে পুঁথিগত শিক্ষার সাথে মানসিক,বৌদ্ধিক, আধ্যাত্মিক, তাত্ত্বিক, শারীরিক, সামাজিক, কার্মিক শিক্ষাকেও মর্যাদা দিয়েছিলেন।
প্রকৃতির প্রভাব
কবিগুরু বিশ্বাস করতেন যে প্রকৃতির সান্নিধ্য ছাড়া মানুষের শিক্ষা অসম্পূর্ণ। আমাদের দুই মহাকাব্য – রামায়ণ আর মহাভারতের নায়কেরা দীর্ঘ বছর অরণ্যে কাটিয়েছেন। তবেই তাদের শিক্ষা পূর্ণতা পেয়েছে। কবিগুরু বলতে বাধ্য হয়েছিলেন,
দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর
লহ যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর, হে নিষ্ঠুর সভ্যতা।
আমাদের জীবনের প্রথম পাঠশালাই তো প্রকৃতি। তাইতো কবি বলেছেন, “আকাশ আমায় শিক্ষা দিল উদার হতে ভাইরে, কর্মী হবার মন্ত্র আমি বায়ুর কাছে পাইরে।”
কবিগুরুর ৮১ বছর আগে ইংল্যান্ডে জন্মে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ একইভাবে মানব জীবনে প্রকৃতির অপরিসীম মূল্য অনুধাবন করেছিলেন। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘Let nature be your preacher’ কারণ ‘Nature never did betray the heart that loved her.’ কবি ওখানে থামেননি।
তিনি আরো বলেছেন –
One impulse from a vernal wood,
May teach you more of man,
Of moral evil and of good,
Than all the sages can.
শিক্ষার দিশা
শুধু জ্ঞান অর্জনই যথেষ্ট নয়, সেই জ্ঞানকে যথার্থভাবে মানবকল্যাণে জীবনের উন্নতি সাধনে লাগাতে হবে। নাহলে সেই জ্ঞান অভিশাপ হয়ে যাবে।
জ্ঞানের বিপরীত অভিমুখ কতটা অকল্যাণকারী হতে পারে সেটা আমরা আণবিক শক্তির আবিষ্কারের পরে দেখেছি। যে অনুশক্তি মানব কল্যাণে লেগে পৃথিবীকে স্বর্গ রাজ্য বানাতে পারতো ভুল অভিমুখের জন্য সেটা মানব সমাজের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। আণবিক বোমার অকল্পনীয় ধ্বংসলীলা দেখে বৈজ্ঞানিক আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন,
What a dream it was,
what a nightmare it has been.
শিক্ষার্থীর মর্যাদা
গুরুর মর্যাদা সর্বজন স্বীকৃত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে শিক্ষার্থীর মর্যাদা ভিন্ন গুরুর মর্যাদা অসম্পূর্ণ। গুরু এবং শিষ্য একে অপরের পরিপূরক। একজন অপূর্ণ হলে অপরের অঙ্গহানি ঘটবে। সঙ্গীত অনুষ্ঠানে গায়কের মর্যাদা আমরা সকলেই মানি। কবিগুরুর মতে শ্রোতারও সমান মর্যাদা। তাই কবিগুরু বলেছেন –
একাকী গায়কের নহে তো গান,
গাইতে হবে দুইজনে,
একজনে গাবে খুলিয়া গলা,
একজন গাবে মনে।
কবিগুরু তার এই মতকে সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যান যখন দেখান যে ভক্তের যেমন ভগবানকে প্রয়োজন ভগবানেরও সেইরকম ভক্তের প্রয়োজন। তাইতো ভক্ত ভগবানের উদ্দেশে বলতে পারে –
তাই তোমার আনন্দ আমার ‘পর,
তুমি তাই এসেছ নীচে,
আমায় নইলে ত্রিভুবনেরশ্বর,
তোমার প্রেম হতো যে মিছে।
সহজ ভাব
কবিগুরু বিশ্বাস করতেন সবচেয়ে শক্ত হচ্ছে সহজ হওয়া। যিনি সহজ তাঁর মনে কোনও অহংভাব বা হীনমন্য ভাব থাকে না। তিনি সবার সাথে মানিয়ে চলতে পারেন। কবিগুরু সব সময় বলতেন – “ওরে মন সহজ হবি।” তাই তিনি বলেছিলেন –
যাবার বেলায় সহজেরে,
যাই যেন মোর প্রণাম সেরে।
বিপরীতের অবস্থান
কবির ভাষায়,
বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়,
অহংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময়,
লভিব মুক্তির স্বাদ।
আমরা মুক্তি চাই কিন্তু সেই মুক্তি বন্ধনহীন নয়।
বন্ধনের মাঝেই তার অবস্থান। বিশ্ববিধাতা যিনি সংসারের একমাত্র মুক্ত পুরুষ তিনি নিজেই তো জাগতিক বন্ধনে আবদ্ধ। অন্ধকারের মধ্যে যে আলোর উপস্থিতি, নৈঃশব্দের মধ্যে যে শব্দের পদচারণা, বলতে গেলে – “To see light in darkness and to hear sound in silence”। সেটাই তো জীবনের দ্যোতক। জীবনের মধ্যে যে মৃত্যু , মৃত্যুর মধ্যে যে জীবন-মরণোত্তর জীবন, সেই জীবনই প্রাণময়।
জীবনের আসল স্বরূপকে বুঝতে হলে জীবনের সীমা পার করে তাকে বুঝতে হবে। কার্ল মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ আমরা এই পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করতে পারি। কবিগুরুর কথাতেই শুনি,
ধূপ আপনারে মিলাইতে চাহে গন্ধে,
গন্ধ সে চাহে ধূপেরে রহিতে জুড়ে,
সুর আপনারে ধরা দিতে চায় ছন্দে,
ছন্দ ছুটিয়া ফিরে যেতে চায় সুরে।
এখানেই না থেমে গুরুদেব আরো সার্বিক অভিজ্ঞতার নিরিখে বললেন,
প্রলয়ে, সৃজনে না জানি এ কার যুক্তি,
ভাব হতে রূপে অবিরাম যাওয়া আসা,
বন্ধ ফিরিছে খুঁজিয়া আপন মুক্তি,
মুক্তি মাগিছে বাঁধনের মাঝে বাসা।
প্রতি কাজের প্রেরণা যদি আনন্দ হয় তবে কোনও কাজই অর্থহীন একঘেয়ে নিরানন্দময় লাগবে না। একঘেয়ে জীবনের ক্লান্তি এবং ক্লান্ত জীবনের একঘেয়েমি আনন্দের ছোঁয়ায় নতুন দ্যোতনা লাভ করবে। জগতের স্রষ্টা নিজেই যখন আনন্দ স্বরূপ, তখন তাঁর সৃষ্ট জগত সংসার তো আনন্দময়ই হবে। কবিগুরুর উদাত্ত আহ্বান –
দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে,
বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে মারতে হবে।
কবি এখানে থামলেন না। তাঁর আকুল আবেদন –
মরতে মরতে মরণটারে
শেষ করে দে একেবারে
তার পরে সেই জীবন এসে
আপন আসন আপনি লবে।
আমরা বিশ্বাস করি সেই জনশ্রুতি –
জীবন মরণ পা ফেলা
আর পা তোলা তোর
ওরে পথিক
নয়রে শুরু আঁতুড় ঘরে,
শেষ নয়রে চিতার পরে,
আগেও আছে পরেও আছে,
এই কথাটা বুঝে নে রে।
মৃত্যু জীবনের সমাপ্তি নয়। জীবনের বিস্তার। জীবনের ব্যাপ্তি কবিগুরুর কথায়, “জীবনে ফুল ফোটা হলে মরণে ফল ফলবে।”
যার দেহে আনন্দ, মনে ভুমানন্দ সেইতো বলতে পারে “আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ”, কারণ সে উপলব্ধি করে আনন্দেরই সাগর থেকে এসেছে আজ বান। তাই সে তৈরি হয়, নৌকার দাঁড় ধরে বসার এবং সবার সাথে দাঁড় টানার জন্য।