গ্রন্থালোচনা: একজন রনি রয়

ফজলুল হক সৈকত

মায়া ওয়াহেদ সম্পাদিত ‘শাশ্বতিক : রনি প্রেন্টিস রয় সন্দর্ভ’ (২০২৩, কবিমঞ্চ প্রকাশনী, মৌলভীবাজার, বাংলাদেশ; প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ) গ্রন্থটি পড়তে বসে একজন রনি রয়কে গভীরভাবে জানা গেল। বইটি কেবল রনি রয়ের পরিচিতিমূলক সংকলন নয়; এটি গতানুগতিক স্মারকগ্রন্থ বা সংকলিত গ্রন্থের কাঠামো পেরিয়ে সত্যি সত্যি একটি অভিসন্দর্ভের মর্যাদায় উন্নীত হতে পেরেছে। তার কারণ এই সংকলনেই চিহ্নিত হয়ে আছে। বইটিতে বাঙালির সবচেয়ে বড়ো অহংকার মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-বিষয়ক নানান ইঙ্গিত ও ছবি যেমন অঙ্কিত হয়েছে, তেমনই বাঙালির বিশুদ্ধ সঙ্গীত ও নির্মল সংস্কৃতি চর্চার বিচিত্র-কৌণিক ধারণাও যুক্ত হয়েছে খুব সহজ-বিবরণে।

‘গান আর সঙ্গীত এককথা নয়। মঞ্চে গোটা কয়েক গান করাকে সঙ্গীত বলে না; সঙ্গীতটা চর্চা করতে হয় এটা সাধনার ব্যাপার।’ সঙ্গীত আর গানের মধ্যে বিভেদটাকে ঠিক এভাবেই ব্যাখ্যা করতে চান টরন্টো প্রবাসী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী ও গিটারবাদক রনি প্রেন্টিস রয় (জন্ম: ১৯৫২ চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ) রনি রয় একজন সঙ্গীতসাধক; সঙ্গীতের প্রশিক্ষক। রনি রয় একজন মুক্তিযোদ্ধা। প্রায় ৬ দশকের সঙ্গীতসাধনায় তিনি ধারণ করেছেন উচ্চাঙ্গ-সঙ্গীতের মাহাত্ম্য; প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছেন সঙ্গীতের সৌন্দর্য-কথা। এ-প্রসঙ্গে ‘শাশ্বতিক’ গ্রন্থে গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরায়েজী লিখেছেন: ‘সঙ্গীত সাধনা এবং চর্চাকে তিনি নৈতিক প্রয়োজন হিসাবে গ্রহণ করেছেন। সঙ্গীতের চেয়ে মহত্তর কোনো জীবন তাঁর কাছে নেই। সঙ্গীতের অমূল্য হিরকের ফেরিওয়ালা হয়ে দেশে দেশে অন্তহীন ছুটে সঙ্গীতের হিরন্ময়ী দ্যুতি ছড়িয়েছেন রনি রয়।’ রনির কাছে পাঠ-নেওয়া শিক্ষার্থী জয়ীতা দেবরায় তাঁর শিক্ষক সম্বন্ধে লিখেছেন: ‘মৌলভীবাজার থেকে এই রকম সঙ্গীতের তালিম নেয়া সত্যিই সৌভাগ্য ছিল আমার। গুরুজির কাছে গিয়ে জেনেছিলাম যে, ভরা অনুষ্ঠানে দুচারটে গান গাওয়াই সঙ্গীতচর্চা নয়, জেনেছিলাম সঙ্গীতচর্চার প্রকৃত মানে। গুরুজি সবসময় বলতেন ভালো করে গান গাইতে হলে প্রথমে বুঝতে হবে সঙ্গীতচর্চা- যা শ্রবণ, মনন ও চিন্তনের সংমিশ্রণ’। গানের কথার ভাব ও তাৎপর্য না বুঝে গাইতে যাওয়া যে বোকামি মাত্র, তা তিনি বহুভাবে, অনেককে বলার চেষ্টা করেছেন। তিনি চেয়েছেন অর্থময় সঙ্গীত-সাধনা; ব্যঞ্জনাযুক্ত সঙ্গীত-পরিবেশনার জন্য তাঁর আকুলতা যেন এখনো ফুরায়নি। রমরমা গানের আয়োজন নিয়ে রনি রয়ের দুঃখ আছে। তিনি চান সঙ্গীতের চর্চা হোক – তবে, এটা যে শিল্প, তা যেন মাথায় রেখে অনুশীলন ও উপস্থাপন করা হয়।

রনি রয়ের জন্ম চট্টগ্রামে হলেও শৈশব-কৈশোরের বেশিরভাগ সময় কেটেছে নিজ শহর মৌলভীবাজার আর বরিশালে (লেখাপড়াসূত্রে)। তিনি ১৯৭১ সালে যোগ দেন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে। প্রিয় গিটার ফেলে হাতে তুলে নিয়েছিলেন হাতিয়ার। সঙ্গীতের সুর ও শক্তি নিশ্চয়ই তাঁকে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে, প্রশিক্ষণে এবং লড়াইয়ে প্রেরণা যুগিয়েছে। যুদ্ধশেষে পুনরায় হাতিয়ারের জায়গায় স্থান করে নেয় গিটার – সঙ্গীতমুগ্ধ বালক ফিরলেন যেন তাঁর নিজস্ব ভুবনে। জানা যায়, তৎকালীন সিলেট জেলার মহকুমা শহর মৌলভীবাজারে ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আর নির্মল সংস্কৃতিচর্চার আবহ; পাবলিক লাইব্রেরি-কেন্দ্রিক একধরনের মুক্তবুদ্ধির চর্চাও চলতো সেখানে। মৌলভীবাজারে লাল টিনের চারতলা গির্জায় সাপ্তাহিক প্রার্থনা ঘিরে খিস্টান সম্প্রদায়ের যে-মিলনমেলা হতো, তার অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন মি. প্যারসিভাল প্রেন্টিস; তাঁর স্ত্রীর নাম দীপ্তিকণা দত্ত, তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বেতারের তালিকাভুক্ত অভিনয়শিল্পী। এই সংস্কৃতিমনা দম্পতির পুত্র রোল্যান্ড প্রেন্টিস রনি – যিনি রনি প্রেন্টিস রয় নামে সমধিক পরিচিত। মায়ের ‘সুললিত কণ্ঠের সুর মুর্ছনা ছোট্ট রনির অন্তর্লোক বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।’ রনি রয়ের সহধর্মিনী ব্যারিস্টার চয়নিকা দত্ত ‘শাশ্বতিক’-সংকলনে Ronnie prentice Roy: An artist in his own right’ শিরোনামের নিবন্ধে লিখেছেন শিল্পীর সঙ্গীতলগ্নতার কথা: `From the day I meet Ronnie, I came to know about his passion for music and his passion only increased to a point that he lives and breathes music.`

রনি রয় কৈশোরে, ১৯৬৮ সালে সিলেট বেতারের গীটার বাদক হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। তখন তিনি রেডিওর পাশাপাশি স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছেন। সেই সময়ে রনির সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের খবর পাওয়া যায় তাঁর বন্ধু বিদ্যুতের ছোড়দি মায়া করের স্মৃতি-কথায়: ‘১৯৭০-এ মদন মোহন কলেজে ভর্তি হয়। সাথে জুটে একদল সমমনা যুবক। অঞ্জন পালের সূত্র ধরে বিদ্যুৎ কর, অঞ্জন দাস, সুপ্রিয় সিনহা, কৃষ্ণপদ সেন, নিজামুদ্দিন লষ্কর (ময়না) এদের সাথে ওর পরিচয় ঘটে। এদের সান্নিধ্যে থেকে রনি সিলেটের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। তখন সারা দেশ জুড়ে চলছিল অসহেযোগ আন্দোলন। গণসঙ্গীত পরিবেশনা, পথনাটকে, মিছিলে মিছিলে ওরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতো। ১৯৭০-এর নভেম্বরের মধ্যভাগে (১২ নভেম্বর) বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে সারাদেশে যখন মৃত্যুর হাহাকার, বিদ্যুৎ ও কৃষ্ণদার লেখা, অঞ্জন দাস ও দ্বীজেন সিং-এর সুর করা গান গেয়ে মদন মোহন কলেজের ভিক্ষা মিছিলে ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহ করে ওই যুবকদল। এখানেই রনিরা থেমে থাকেনি। কলেজের আরো ছাত্ররা মিলে নোয়াখালির প্রত্যন্ত চর অঞ্চলে গিয়ে ত্রাণ বিতরণ করে এসেছে।’ সেই যে আরম্ভ, তাঁর পর থেকে আজও তিনি বিচরণ করছেন এই মোহমুগ্ধতার জগতে। মানবিকতা, সামাজিকতা আর শিল্প-সমাচার রনির পেছন ছাড়েনি। পারিবারিক সাংস্কৃতিক আবহ এবং সামাজিক-সম্পৃক্তি তাঁকে দেশপ্রেমিক হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল হয়তো। শিল্পের সৌন্দর্যকে মনে ও মননে ধারণ করে তিনি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছিলেন নিজস্ব আবেগে। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিতে রনি আরো অনেকের সাথে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে প্রবেশ করেন। সেখানে ভদ্রপল্লী গ্রামের শোভারাণী দে মুক্তিযোদ্ধা-সংগঠক আলাউদ্দিন খাঁর অনুরোধে, প্রতিবেশিদের নিষেধ উপেক্ষা করে, বাড়িতে ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দেন; রনি রয় তাঁদের মধ্যে একজন। তখন তাঁরা সেখানে থেকে বাংলাদেশের সিলেট সীমান্তের অভ্যন্তরে পাকবাহিনির আক্রমণ প্রতিহত করতে ভারতীয় সেনাবাহিনির সাথে একযোগে কাজ করছিলেন। শোভারাণীর সেই সময়ের কিশোরী কন্যা চপলা দেবরায় তার ‘আবছা স্মৃতির সংলাপ’ শিরোনামের রচনায় লিখেছেন: ‘একদিন আপারেশনে গিয়ে একটি হারমোনিয়াম নিয়ে আসে মুক্তিযোদ্ধারা, সেটা এখনও অক্ষত রয়েছে বাড়িতে, মুক্তিযোদ্ধা ইসলাইলসহ অনেকেই তো ছিলেন, তার মধ্যে রনি প্রেন্টিস নামের যোদ্ধার প্রতি মায়ের স্নেহটা বেড়ে যায়। তার চালচলন অনেকটাই ছিল বড় ভাইয়ের মতো। মায়ের স্নেহের ভাগ বসাতে রনি যে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিল সে সময়। ধর্মে খ্রীস্টান, প্রচণ্ড উঁচু মনের ছিল রনি।’

মুক্তিযুদ্ধ যেমন বাঙালির এক বিরাট অর্জন; তেমনই এর ইতিহাসচর্চায় এখনও রয়ে গেছে অনেক শূন্যতা ও ফারাক। মুক্তিযুদ্ধের সব সত্য প্রকাশ হয়নি আজও। রনি রয়দের প্রবাস-যাপনের অন্তরালে লুকিয়ে-থাকা সত্য – স্বাধীন দেশে, স্বপ্নের দেশে থাকতে না পারার যে যন্ত্রণা, তা আজও প্রায় অনুদঘাটিত। আবার সাধারণভাবেও মানুষের মনে মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ে রয়েছে নানান ক্ষোভ ও দুঃখ। রনি রয় সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মৌলভীবাজারের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক, সাংবাদিক ও আইনজীবী মুজিবুর রহমান মুজিব এভাবে খানিকটা খেদ প্রকাশ করেছেন: ‘সাংস্কৃতিক সংগঠক ও সমাজকর্মী রনি প্রেন্টিস ছাত্রাবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে চার নম্বর সেক্টরের মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরব উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন। দুঃখ ও দুর্ভাগ্যজনকভাবে অবহিত হলাম মুক্তিযোদ্ধা রনি প্রেন্টিস মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট প্রাপ্ত হননি।’ প্রসঙ্গত, ১৯৭১-এর কিশোর যোদ্ধা রনি পরবর্তীকালে তাঁর সেক্টরের কমান্ডার সি আর দত্তের জামাতা হয়েছেন। সি আর দত্ত স্বাধীন বাংলাদেশে বর্ডার গার্ডের প্রথম মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর কন্যা ব্যারিস্টার চয়নিকা দত্ত বর্তমানে সপরিবারে কানাডা-প্রবাসী। রনি রয়ের মতো আরো কতো বীর মুক্তিযোদ্ধা আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সম্মাননা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন, তা স্বাধীনতালাভের পাঁচদশক পরেও এক বিরাট প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সংকলনে রনির সহযোদ্ধা সুলায়মান আলী লিখেছেন: ‘সহ-মুক্তিযোদ্ধাদের সত্যায়িতপত্রসহ কয়েক দফায় দরখাস্ত দাখিলসহ সমস্ত প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের পরও রনি প্রেন্টিসকে তার প্রকৃত স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, এটা অত্যন্ত পরিতাপের। সহ-মুক্তিযোদ্ধ হিসাবে আমার জন্য খুবই লজ্জার এবং বিব্রতকর একটি বিষয়।’ অবশ্য, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে কখনো ভাবেন না রনি রয়। ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্রী তাপস দেবনাথের কথা থেকে খানিকটা উদ্ধৃত করলে একজন রনি রয়কে কিছুটা উপলব্ধি করা যেতে পারে: ‘শেখার আগ্রহ তাঁকে আজীবন শীর্ষস্থানে থেকে গুরুসান্নিধ্য পাওয়ার চেষ্টা আর আরো ভালো সঙ্গীত, আরো ভালো শিল্প সংগ্রহের জন্য তাঁর নিজের জীবনকে তিনি সমর্পিত করেছেন।… সুদূর কানাডায় বসে আমাদের উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় এবং উপ-শাস্ত্রীয় সঙ্গীত প্রচারের জন্য বছরের পর বছর ধরে সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি, শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য অনেকের জন্যেই প্ল্যাটফর্ম তৈরী করে দিয়েছেন। আর তাঁকে এই সকল কাজে সাহায্য ও সমর্থন করেন তাঁর স্ত্রী ও পুত্র-সন্তান।’

১৯৭৪ সালে এক বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাজনিত কারণে, পরিবারের একপ্রকারের কঠিন চাপে, সিলেটে কলেজের পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে কানাডায় পাড়ি জমান তিনি। রনির ছোট ভাই ডাডলি ডেরিক প্রেন্টিস লিখেছেন: ‘স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪-এর মাঝামাঝি, এই আড়াইটি বছর একটা ব্যস্ত সময় কেটেছে। পাশাপাশি মৌলভীবাজার এবং সিলেট মিলিয়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে সে। নবরাত সঙ্গীত বিদ্যালয়, প্রান্তিক নাট্যগোষ্ঠী, সমস্বর পাশাপাশি রেডিও অনুষ্ঠান এবং সিলেট বিভাগের বিভিন্ন প্রান্তে অনুষ্ঠান করে বেড়ানো। ঠিক সেই সময়ই দেশান্তরী হওয়াটা তার জন্য ছিল ভীষণ কষ্ঠের এবং বেদনাদায়ক। ভাবতে অবাক লাগে, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্যও তাঁর স্বাধীন দেশ নিরাপদ হতে পারেনি। দূর দেশে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে করতে আজও হয়তো সে-কথাই ভাবেন একজন রনি রয়। তবে, রনি দেশ ছাড়লেও ত্যাগ করেননি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি প্রবল আকর্ষণ; বিদেশেও খুঁজে বেরিয়েছেন বাঙালির সঙ্গীত ও সংস্কৃতি চর্চার পথ আর পাথেয়। ১৯৭৬ সালে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ভ্যানকুভার শহর থেকে কানাডার প্রথম বাংলা বেতার অনুষ্ঠান তাঁর কণ্ঠেই প্রচারিত হয়। ফরাসি ভাষায় ভারতীয় আধ্যাত্মিক দর্শন-বিষয়ক প্রামাণ্যচিত্রের আবহ নির্মাণ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে-সভায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও গজল পরিবেশনা, কানাডা সরকারের বৃত্তি নিয়ে ভারতে সঙ্গীতশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে রনি রয় নিজের প্রতিভাকে শাণিত করেছেন প্রতিনিয়ত। কানাডা, আমেরিকা, ইউরোপ, ভারত, বাংলাদেশ জুড়ে তাঁর সঙ্গীতের সুর ও সাধনা আলোকশিখা জ্বালিয়ে চলেছে নিরন্তর। সঙ্গীতচর্চার জন্য ১৯৯৬ সালে কানাডার টরন্টোতে এবং ২০১০ সালে বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘রাগ রঙ সঙ্গীত আকাডেমি’। লোভ আর লাভের মোহে যখন বিপুল মানুষ আবদ্ধ, তখন নির্মোহ জীবন, সঙ্গীতমগ্নতা এবং মানুষ ও সমাজের কল্যাণ-কামনায় নিরন্তর সময়-যাপনে রনি রয় সত্যিই এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। টরন্টোতে বাংলাদেশ সেন্টারের জন্য তহবিল সংগ্রহের জন্য তিনি বিনাপারিশ্রমিকে দুটি সঙ্গীতানুষ্ঠান করেন। সঙ্গীত ও শিল্পকলার প্রচার-প্রসারে তাঁর আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা অসাধারণ। খুরশিদ শাম্মীর ‘আমার দেখা একজন শঙ্খমানব রনি প্রেন্টিস রয়’ স্মুতিকথায় জানাচ্ছেন রনি রয়ের সঙ্গীতপ্রিয়তা সম্বন্ধে: ‘জীবনের প্রতিটি ধাপেই তিনি অর্থ উপার্জনের থেকে সঙ্গীত ও সঙ্গীতের মান নিয়ে অধিক ভেবেছেন, তা প্রমাণিত হয় তাঁর বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসংখ্যা ও তাদের পারদর্শিতায়। একজন প্রকৃত গুরু সাধারণত নিজের প্রচার ও প্রসারের থেকে তাঁর শিষ্যদের সঠিক ও শুদ্ধভাবে তালিম দিয়ে সম্মুখের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াতেই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন; রনি প্রেন্টিস রয় ঠিক সেটাই করার চেষ্টা করেন।’

একজন রনি রয় মানুষ হিসেবে কেমন, তা জানা যায় তাঁর পরিজন-বন্ধুদের মন্তব্য থেকে। ‘পুষ্পিত অনুরাগে সিক্ত যে জীবন’ শিরোনামের লেখায় কিশোরী পদ দেব শ্যামল তুলে ধরেছেন রনির সাধারণ জীবনবোধের পরিচয়। খানিকটা পাঠ নিচ্ছি: ‘রনি প্রেন্টিস একজন সর্বতো ভদ্রলোক। তিনি মার্জিত, ভদ্র এবং সদালাপি ব্যক্তি। তিনি কারো সাথে কথা বলার সময় এমন সুন্দর একটি স্মিত হাসি দ্বারা অন্যজনকে বরণ করেন যা তাঁর পরিচিতজন সকলেই জানেন। রনি প্রেন্টিস একটি বিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারী। যার চিত্ত পরিশুদ্ধ। কারো প্রতি যার কোনো বিদ্বেষ নেই। তিনি যখন কারো সাথে কথা বলেন তখন মনে হয় তিনি তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠ।’ একজন সঙ্গীত-সাধকের বাড়ির আবহ কেমন হতে পারে, তা তুলে ধরেছেন রনি রয়ের পুত্র যশ প্রেন্টিস: `I Will say this: growing up as a kid, being the son of musician, your house is always buzzing with something artsy’

‘শাশ্বতিক : রনি প্রেন্টিস রয় সন্দর্ভ’ সংকলনটিতে বাংলাদেশ থেকে ১৪জন স্মৃতিকথা-নিবন্ধ, ২জন নিবেদিত কবিতা (১টি বাংলা ১টি ইংরেজি); ভারত থেকে ১০জন স্মৃতিগদ্য এবং প্রবাস থেকে ২০জন (বাংলায় ১২জন ও ইংরেজিতে ৮জন) ব্যক্তিগত-আলাপন লিখেছেন। গ্রন্থের শেষের দিকে রয়েছে ৪টি শুভেচ্ছাপত্র, ৮পৃষ্ঠা প্রচার-প্রকাশনার বিভিন্ন খবর-তথ্য, ২৩ পৃষ্ঠার অ্যালবাম (১১পৃষ্ঠা সাদাকালো, ১২ পৃষ্ঠা রঙিন)। বইটির কলেবর ও সজ্জা চমৎকার। তবে, স্মৃতিকথা ও সঙ্গীত-বিষয়ক নিবন্ধগুলোকে আলাদাভাবে পরিবেশন করা যেতে পারতো। এছাড়া ভাষা-সম্পাদনা করে এর দ্বিতীয় সংকরণ করা গেলে ভবিষ্যতের জন্য এটি একটি ভালো সংগ্রহ হতে পারে।

রনি রয় কি অনেকের চেয়ে আলাদা? তাঁকে কি আমাদের প্রয়োজন? – এসব প্রশ্ন সামনে রেখে বলা চলে, বর্তমান অবক্ষয়মান সমাজে একজন রনি রয়ের মতো নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক, শিল্পবোধা ও সাধকের খুব দরকার। কারণ, সমাজ ও রাষ্ট্র এগোয় পরিশুদ্ধ মানুষদের প্রতিনিধিত্বে, নেতৃত্বে ও অভিভাবকত্বে। বাংলাদেশ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যেভাবে অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ছে, তাতে রনি রয়দের মতো সিনিয়র রেসিডেন্সকে সামনে রাখতে পারলে সকলেরই মঙ্গল। আর শুধু দেশে নয়, প্রবাসেও রনি রয়রা ছড়িয়ে দিতে পারেন নিজ দেশের সমস্ত শোভা ও সম্ভাবনা।