চলচ্চিত্রের জন্য মনিস রফিকের ভালোবাসা
সামিনা চৌধুরী
অসীম সম্ভবনার অধিকারী মানুষের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় হাজারো গুণাবলীর সন্ধান। মানুষের গুণাবলী বিকশিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন যথাযথ পরিবেশ এবং পরিচর্যা যেটা অনেক সময় দুর্লভ। তারপরও দুর্গম পথে হেঁটে হেঁটে কোনো কোনো মানুষ একই সাথে লেখক, গায়ক, নায়ক হয়ে ওঠেন। হয়ে ওঠেন অনন্য, হয়ে ওঠেন আরাধ্য। তেমনি একজন মানুষ মনিস রফিক। তিনি একজন শিক্ষক, একজন ক্যামেরাম্যান, একজন সাহিত্য-বোদ্ধা, একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, একজন গবেষক, একজন সম্পাদক এবং একজন লেখক। আজকের প্রবন্ধে মনিস রফিকের লেখকসত্তা নিয়ে সামান্য কিছু আলোচনা করব। এই আলোচনায় মনিস রফিকের লেখা ‘তারেক মাসুদ-চলচ্চিত্রের আদম সুরত’, ‘গৌতম ঘোষের চলচ্চিত্র’, ‘ক্যামেরার পেছনের সারথি’ এবং ‘চলচ্চিত্র বিশ্বের সারথি’ গ্রন্থের উপর মূলত আলোকপাত করা হয়েছে। গ্রন্থগুলোতে চলচ্চিত্র আবিষ্কার, যারা চলচ্চিত্রকে একটি জনপ্রিয় শিল্পমাধ্যম হিসেবে তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন এবং যারা কালোত্তীর্ণ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তাদের কথা এবং কিছু বিখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচনা স্থান পেয়েছে।
চলচ্চিত্র বিষয়ে মনিস রফিকের প্রথম গ্রন্থ ‘ক্যামেরার পেছনের সারথি’। এই গ্রন্থে ইরান, কানাডা, ভারত, বাংলাদেশ, হংকং ও জাপানের মোট নয়জন চলচ্চিত্র পরিচালকের সাক্ষাৎকার উপস্থাপন করা হয়েছে যেখানে এই বিখ্যাত পরিচালকদের চলচ্চিত্র বিষয়ে ভাবনা এবং শুদ্ধ চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতিকূলতাসমূহ আলোচনায় এসেছে। গ্রন্থটি ২০০৯ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যেই প্রথম মুদ্রণ শেষ হয়ে যায়। বিষয়টিতে আপ্লুত হয়ে মনিস রফিক দ্বিতীয় মুদ্রণের ভূমিকায় লিখেছিলেন,”সম্ভবত এই গ্রন্থটি যাদের নিয়ে হয়েছে, তাঁদের সম্পর্কে জানার প্রবল আগ্রহ আছে পাঠকের।“ এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে প্রকাশিত হয় ‘চলচ্চিত্র বিশ্বের সারথি’ গ্রন্থটি। এই গ্রন্থে ১৮৯৪ সালে চলচ্চিত্র আবিষ্কারের মাহেন্দ্রক্ষণ থেকে শুরু করে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত রাশিয়া, আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ভারত ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ক্রমবিকাশকে তুলে ধরা হয়েছে। গ্রন্থটিকে চলচ্চিত্রের ইতিহাস গ্রন্থ বললেও খুব বেশী বলা হয় না।
ভারতের বরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষের দশটি চলচ্চিত্র সমালোচনা করে মনিস রফিক ২০১১ সালে রচনা করেছেন ‘গৌতম ঘোষের চলচ্চিত্র’ গ্রন্থটি। এই গ্রন্থে গৌতম ঘোষ পরিচালিত মোট দশটি সিনেমা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আলোচিত দশটি চলচ্চিত্রে ফুটে ওঠা মানব জীবন, জীবনের আকাঙ্ক্ষা, ত্যাগ, সংগ্রাম আর স্বপ্নের গল্প নিয়ে মনিসের লেখায় উঠে এসেছে গৌতম ঘোষের ভাবনা, শুদ্ধ চলচ্চিত্রের জন্য ভালোবাসা এবং চলচ্চিত্রের জন্য সংগ্রামের আখ্যান।
বাংলাদেশের নন্দিত চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদের স্মৃতি, তার চলচ্চিত্র বিষয়ক স্বপ্ন আর তার পরিচালিত মোট ছয়টি সিনেমার পর্যালোচনা সমন্বয়ে মনিস রফিক ২০১৩ সালে পাঠকদের উপহার দিয়েছেন ‘তারেক মাসুদ- চলচ্চিত্রের আদম সুরত’ গ্রন্থটি। এই গ্রন্থটি তারেক মাসুদের জীবন, দর্শন, চলচ্চিত্র নির্মানের পথে হেঁটে যাওয়ার একটি প্রামাণ্য দলিল।
চলচ্চিত্র শিল্পের বয়স এখনো ১৫০ বছর হয়নি। মঞ্চে পরিবেশিত অভিনয়, বিভিন্ন ধরনের তথ্যাবলী, সংগীত, কবিতা, গল্প, উপন্যাস এবং আরো বিভিন্ন ধরনের পরিবেশনা বা তথ্যচিত্র চলচ্চিত্রের কারিগরি নির্দেশনার মাধ্যমে দর্শকের কাছে পৌঁছায়। চলচ্চিত্র শিল্পকলার এমন একটি শাখা যেখানে শিল্পীর প্রত্যক্ষ উপস্থিতি প্রয়োজন হয় না এবং সম্পাদনার মাধ্যমে সরাসরি উপস্থাপনের দুর্বলতাসমূহ সংশোধন করা যায়। ফলে চলচ্চিত্র নামক শিল্পের বয়স বেশী না হলেও, দর্শকের কাছে এটি খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়েছে। জনপ্রিয় এই ধারাটি ক্রমশ আমাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে এবং আমাদের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে এবং আমদেরকে ঋদ্ধ করছে। বর্তমান সময়ে ভিডিওগ্রাফি এবং সিনেমাগ্রাফি সমকালীন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহের ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে আমাদের অজান্তেই সংরক্ষিত হয়ে আসছে। চলচ্চিত্রের এই সূদুর-প্রসারী দিগন্তের সম্ভাবনার গল্পটি মনিস বলেছেন তার গ্রন্থে। মনিস পরম যত্নে ১৮৯৪ সালে চলচ্চিত্রের প্রথম আবিষ্কার থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রের ক্রমবিকাশ এবং বিভিন্ন দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ বিষয়ে গবেষণা করেছেন এবং লিখেছেন।
‘চলচ্চিত্র বিশ্বের সারথি’ গ্রন্থে মনিস পাঠকদের জন্য লিখেছেন ফ্রান্সের চিত্রকর আঁতোয়া লুমিয়েরের দুই ছেলে অগস্ত এবং লুই সাধারণ ক্যামেরার ফিল্ম ও প্রোজেক্টরের সংমিশ্রনে কীভাবে চলচ্চিত্র সৃষ্টি করেছিলেন। একই সাথে গ্রন্থটি থেকে পাঠক জানতে পারবেন বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্রের নাম ‘ওয়ার্কার্স লিভিং দ্যা লুমিয়ার ফ্যাক্টরি’। এটি মাত্র ৪৬ সেকেন্ডের একটি নির্বাক ছবি যেখানে দেখা যায় লুমিয়েরদের কারখানা থেকে শ্রমিকরা বের হচ্ছেন। লুই আর অগস্তের করা অন্যান্য রেকর্ডিংগুলো সম্পর্কেও পাঠক জানতে পারবেন। এছাড়াও তিনি গ্রন্থটিতে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি, প্রথম প্রামাণ্য চলচ্চিত্র, প্রথম সবাক ছবি নির্মাণের ইতিহাস লিখেছেন এবং চলচ্চিত্রকে যারা এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তাদের জীবনের ওপর আলোকপাত করেছেন। কমেডি ছবির জনক চার্লি চ্যাপলিন, শিশুতোষ ছবির উদ্ভাবক ওয়াল্ট ডিজনি, বাংলা ছবির নেতা সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, জহির রায়হান প্রমুখের জীবন থেকেও মনিস পাঠকের জন্য তুলে এনেছেন ইতিহাস।
পৃথিবীর কনিষ্ঠতম শিল্প মাধ্যম চলচ্চিত্র বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী শিল্প ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে মূল্যায়িত হচ্ছে। এই মাধ্যম প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আমাদের ব্যক্তিগত আচরণ, সামাজিক সচেতনতা, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক আলোচনাকে প্রভাবিত করছে। আমাদের জীবন-দর্শন, আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের ভবিষ্যত ভাবনাও এই প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাচ্ছে। কাজেই সুস্থ সংস্কৃতি, নৈতিক মূল্যবোধ, সরল জীবনবোধ এবং দূরদর্শী চেতনা প্রদানকারী চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকেই সচেতন হতে হবে। একারণেই মনিস শুদ্ধ চলচ্চিত্রের জন্য অপরিসীম ভালোবাসা দেখিয়েছেন। তার লেখা বইগুলো পড়লে দেখা যায় যে তিনি শুদ্ধ চলচ্চিত্র বিশ্লেষণ করেছেন এবং শুদ্ধ চলচ্চিত্র নির্মাণে জড়িত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন, তাদের মতামত শুনতে চেয়েছেন এবং সেগুলো পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন। একইসাথে মনিস দেখিয়েছেন শুদ্ধ চলচ্চিত্র নির্মাণে কী পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। মনিসের এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে জীবনধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণে পরিচালকদেরকে উৎসাহিত করবে। এ প্রসঙ্গে রবার্ট ফ্লহার্টির কথা উল্লেখ করা যায়। চলচ্চিত্রের জন্য নিবেদিত প্রাণ এই মহাপুরুষ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তৈরির জন্য কানাডার ঝুঁকিপূর্ণ অনেকগুলো অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৯১৩ থেকে ১৯১৫ সালের মধ্যে দুটি অভিযান বিশ্বের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাফিন দ্বীপ থেকে বেলচের দ্বীপপুঞ্জের পথে এই যাত্রায় প্রচন্ড ঠান্ডা উপেক্ষা করে শুধুমাত্র এস্কিমোদের যাপিত জীবন তুলে ধরার জন্য তিনি প্রায় ৭০ হাজার ফিট ছবি শুট করেছিলেন। একইভাবে বলা যেতে পারে তারেক মাসুদের কথা যিনি চার বছর সময় ব্যয় করে চিত্রকর এস এম সুলতানকে নিয়ে পরম মমতায় নির্মাণ করেছেন ‘আদম সুরত’ নামের ছবি। উল্লেখ করা যেতে পারে ফরাসি চলচ্চিত্রকার রেনোয়ার কথা। ভারত প্রবাসী একটি ইংরেজ পরিবারের কাহিনী নিয়ে ‘দ্যা রিভার’ ছবিটি বানানোর জন্য শুটিং স্পটের খোঁজে যিনি ছুটে এসেছিলেন সুদূর ভারতবর্ষের বাংলায় গঙ্গানদী দেখতে। এমনি আরো অনেক নিবেদিতপ্রাণ চলচ্চিত্রের মানুষ, যারা শুধু ক্যামেরার পেছনে নিরলস শ্রম দিয়েছেন, ঘাম ঝরিয়েছেন, জীবনের আনন্দ বিসর্জন দিয়েছেন, সেইসব মানুষদের কথা পাঠক জানবেন মনিসের লেখায়।
কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদান রেখেছেন। তার নির্মিত ছবির মধ্যে রয়েছে ‘আদম সুরত’, ‘মাটির ময়না’ ‘কাগজের ফুল, ‘মুক্তির গান’, ‘রানওয়ে’ ইত্যাদি। সিনেমার মধ্য দিয়ে দর্শকদের সাথে যোগাযোগ সৃষ্টি করে তাদের মাঝে একটি বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার অসামান্য কুশলতার কারণেই তারেক মাসুদ ছিলেন একজন ব্যতিক্রমধর্মী পরিচালক। তারেকের সহকারি পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন মনিস। ২০১১ সালের ১৩ই আগস্ট এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক নিহত হন। সেইসময় মনিস একই মাইক্রোবাসে তারেকের সহযাত্রী ছিলেন। নয়জন মাইক্রোবাস আরোহীর মধ্যে পাঁচজনই নিহত হয়েছিলেন কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান মনিস। সেদিনের সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর বরেণ্য এই পরিচালককে শ্রদ্ধা জানিয়ে মনিস লিখেছেন ‘তারেক মাসুদ: চলচ্চিত্রের আদম সুরত’ নামে আরেকটি বই। এই বইটিতে বিভিন্ন চলচ্চিত্র নির্মাণের সময়ে তারেকের ভাবনা, অধ্যবসায়, সংগ্রাম, আর্থিক কষ্ট, বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া সহযোগিতা, চলচ্চিত্র নির্মাণের জ্ঞান অর্জনের অদম্য স্পৃহা আর অসীম ধৈর্য পাঠক দেখতে পাবেন। অসামান্য মেধাবী এই পরিচালক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করেছেন ‘মুক্তির গান’ ছবিটি বানাতে গিয়ে।
১৯৭১ সালে ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামে একটি সাংস্কৃতিক দলের কার্যক্রমকে সেলুলয়েডে ধরে রাখেন এক মার্কিন চলচ্চিত্র শিল্পী লিয়ার লেভিন। এই দলের শিল্পীরা ট্রাকে করে ছুটে বেড়াতেন ভারতীয় অঞ্চলের রিফিউজি ক্যাম্পগুলোতে, গান গেয়ে উজ্জীবিত করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। সেই সময়ের ভিডিওগুলো ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন লেভিন। পরবর্তীকালে তাকে গুপ্তচর সন্দেহে ভারত থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু তিনি এই ভিডিও রেকর্ডিংগুলো ব্যাক্তিগতভাবে সংরক্ষণ করেছিলেন। ১৯৯০ সালে তারেক পড়াশোনার জন্য নিউইয়র্কে গেলে ফুটেজগুলোর সন্ধান পান এবং তার সাথে বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দৃশ্যসমূহের সংযোজনে তৈরি করেন ‘মুক্তির গান’। ছবিটিতে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংস্কৃতিকর্মীদের গান মুক্তিযোদ্ধাদের কিভাবে অনুপ্রেরণা দিয়েছে, সেই ছবি উঠে এসেছে। এই ছবিটা তারেককে দিয়েছে মানুষের ভালোবাসা। গ্রাম ও শহরের হাজারো মানুষ লাইন ধরে টিকিট কেটে দেখেছেন এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। ছবিটি দেখতে দেখতে নিজেদের বিস্মৃতির গ্লানি ধুয়ে দেয়ার বাসনায় অনেকে ডুকরে কেঁদেছেন। যেখানে আলো নেই, তারেক সেখানে আলো ফেলেছেন। যেসময় বাংলা সিনেমা মানেই ছিল মূলত রোমান্টিক সিনেমা, সেই সময়ে বক্তব্যধর্মী, বাস্তব জীবনের ছবি পাঠককে উপহার দিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশের আরেকজন কিংবদন্তী এস এম সুলতানের জীবন ও জগত নিয়ে তিনি তৈরী করেছেন ‘আদম সুরত’ নামে একটি ছবি। তারেক মাসুদকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখা এই গ্রন্থে উঠে এসেছে তারেকের সাথে মনিসের স্মৃতি, তারেক নির্মিত কয়েকটি সিনেমার পর্যালোচনা, এবং তারেকের কয়েকটি সাক্ষাৎকার। গ্রন্থের প্রাক-কথনে মনিস নিজেই লিখেছেন, “আমার এই লেখাগুলো তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রের সমালোচনা, মূল্যায়ন বা বিশ্লেষণ নয়। এই লেখাগুলো তারেক মাসুদ ও তার চলচ্চিত্র নিয়ে আমার প্রাণের সরল অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। আসলে এগুলো হচ্ছে, দ্য সলেম ট্রিবিউট টু মাই ক্যাপ্টেন।” একজন গুণী মানুষকে শ্রদ্ধা জানানোর এই মায়াভরা ভালবাসা নিঃসন্দেহে শ্রদ্ধার।
সভ্যতার বিস্ময়কর আবিষ্কার চলচ্চিত্র আলোছায়ার খেলার মাধ্যমে আধুনিক মানুষের শিক্ষা ও সংস্কৃতির অন্যতম সেরা ধারক ও বাহক হিসেবে সমাদৃত। সমাজ-সংগঠনে ও মানুষের জীবনবোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের অসামান্য ভূমিকা প্রসঙ্গে ব্রিটিশ ফিল্ম একাডেমির ডিরেক্টর রোজার মেনভেল বলেছেন, ‘সিনেমা এমন একটি মাধ্যম যা আমাদের মনোভাবের উপর প্রভাব ফেলে (The cinema is only one element which brings some measure of influence to bear on our attitude to life)।” কাজেই সিনেমা সমাজ বদলের চেতনা জাগ্রত করতে ভূমিকা রাখে। একারণেই সম্ভবত মনিস বেছে নিয়েছেন ভারতীয় পরিচালক গৌতম ঘোষকে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালক গৌতম ঘোষ জীবনমুখী চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য দর্শক নন্দিত। আনন্দআলো পত্রিকায় এক সাক্ষাতকারে গৌতম তার জীবন দর্শন সম্পর্কে বলেছিলেন, “…এই পৃথিবীতে আমরা যে বাস করি যে প্রকৃতি আমাদের আশ্রয় দেয় তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটা সুন্দর জীবন যাপন করা, আনন্দে সময় কাটানো…।” আর তাই গৌতমের ছবি মানে শ্রেণি-বিভক্তিহীন, সুন্দর জীবনের আহ্ববান। মনিস এই মহান মানুষকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন, ‘গৌতম ঘোষের চলচ্চিত্র’ গ্রন্থটি। কিষণ চন্দরের উপন্যাস ‘যব ক্ষেত জাগে’ অবলম্বনে গৌতম নির্মাণ করেছিলেন ‘মা-ভূমি’ নামের চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটিতে তেলেঙ্গানার নালগোন্দা জেলার শ্রীরামপুর গ্রামের কৃষক বিদ্রোহের গল্প দেখানো হয়েছে। শোষিত যখন জেগে ওঠে এবং নিজের দাবীর কথা বলে, তখন পৃথিবী ন্যায় বিচারের রঙে সেজে ওঠে।
মনিস তার গ্রন্থে গৌতমকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে লিখেছেন, “তিনি যখন এই ছবিটি বানানো শেষ করেন তখন তিনি উনত্রিশ বছরের এক যুবক। তার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায় যখন উপলব্ধি করি একজন কি অসাধারণ একটি ছবি বানিয়েছেন।” একইভাবে গৌতম ঘোষের ‘দখল’ ছবিটি নিয়েও পাঠকদের জানিয়েছেন মনিস। এই সিনেমাটি একটি শ্রেনীহীন সমাজ তৈরির গল্প। ছবিটি মূলত কাকমারাদের জীবনের উপর নির্মিত। সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত কাকমারা সম্প্রদায় যাযাবর জীবন যাপনে বাধ্য হয়। ছবিটিতে দেখানো হয় কাকমারা সম্প্রদায়ের একজন নারী কীভাবে এই অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে নিজের সন্তানদের নিয়ে নিজের মাটিতে শক্ত করে দাঁড়াতে চেয়েছে। আলোচনায় মনিস লিখেছেন, “শুরুতেই যে মানুষদের দেখা যায় দূর থেকে এগিয়ে আসছে অসহায়, ঘাড় নুয়ে, তারাই আবার ফিরে যায় ঠিক অমনিভাবে ছবির শেষে। কিন্তু তাদের এই আসা-যাওয়ার মাঝে আমাদের পরিচয় ঘটে আন্দির সাথে, যে তাদের মতো নুয়ে পড়ে জীবন পার করতে চায়না।” জীবনে পরিবর্তন আসে ধীরে, আর তাই, যারা প্রতি ধাপে পরিবর্তন আনে, তারা নমস্য। দর্শক সেভাবেই গ্রহণ করে আন্দিকে – একজন মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টাকে যে বপন করে মুক্তির বীজ। গ্রন্থটিতে লালনের জীবন নিয়ে করা ‘মনের মানুষ’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস-ভিত্তিক ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে নির্মিত ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ সহ মোট দশটি চলচ্চিত্র সমালোচনা রয়েছে, যা পাঠকে সমৃদ্ধ করবে।
সংস্কৃতির সপ্তম কলা হিসেবে স্বীকৃত চলচ্চিত্র পৃথিবীর অন্যতম বড় অর্থ উপার্জনকারী ইন্ডাস্ট্রি। ২০২৩ সালে শুধুমাত্র আমেরিকাতে সিনেমার টিকিট বিক্রির অর্থমূল্য ছিল ৯.০৭ বিলিয়ন ডলার। অন্যান্য শিল্পের তুলনায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ প্রতক্ষ্য বা পরোক্ষভাবে চলচিত্রের সাথে জড়িত। আমেরিকার মোশন পিকচার এসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে আমেরিকা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ১২২ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২.৩২ মিলিয়ন মানুষের কর্মসংস্থান করে থাকে যাদের মোট বাৎসরিক বেতন ২২৯ বিলিয়ন ডলার। এই তথ্য নির্দেশ করে চলচ্চিত্র কত বড় একটি ইন্ডাস্ট্রি। বর্তমান এই প্রযুক্তির যুগে সবার হাতেই স্ক্রীন। হাতের মুঠোর স্ক্রীনে যে কোনো সময় সিনেমা দেখা যায়। তাই বেড়েছে দর্শক, বেড়েছে সিনেমা নির্মাতাও। সেই ১৮৯৪ সালের ৪৬ সেকেন্ডের সিনেমার দৈর্ঘ্য যেমন বেড়েছে, তেমন বেড়েছে এর বিষয়বস্তু।
যেহেতু সিনেমার মাধ্যমে একটি জাতিকে উজ্জীবিত করা যায়, তাই ভালো সিনেমা বিনির্মাণ খুব গুরুত্বপুর্ণ। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মনিস রফিকের চেষ্টা করেছেন চলচ্চিত্র অঙ্গনের গুণীদের সম্মান দিতে। গুণের কদর গুণীরাই করতে পারেন। মনিস রফিকের একজন সামান্য পাঠক হিসেবে আশা করবো পাঠকদের জন্য মনিস আরো লিখবেন এবং সুস্থ সমাজ নির্মাণে ভূমিকা রাখবেন।