জাতিসংঘ কি অকার্যকর সংস্থা হতে চলেছে

নিরঞ্জন রায়

আমরা যারা লেখালেখির চেষ্টা করি, তাদের অনেকেই ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা পাঠকদের সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্যে লেখায় উল্লেখ করে থাকি। বিষয়টি অনেক পাঠকের কাছে পছন্দ নাও হতে পারে। কেননা তাঁরা ভাবতে পারেন যে ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা সবাইকে জানানোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু ব্যাক্তিগত ঘটনা যখন অনেকের সাথে মিলে যায়, তখন সেটি আর ব্যাক্তিগত থাকে না এবং ঘটনাটি সকলরই জানা প্রয়োজন। তাছাড়া লেখার প্রাসঙ্গিকতায় যখন ব্যাক্তিগত ঘটনা চলে আসে, তখন সেটি উল্লেখ না করে উপায় থাকে না। এরকমই একটি ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে আজকের লেখা শুরু করব।

সময়টা গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকুরি খুঁজছি হন্যে হয়ে। এমনিতেই এরশাদ ভ্যাকেশনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছরের শিক্ষাজীবন শেষ করতে লেগে গেছে আট বছর। তাই অতিস্বত্বর একটি চাকুরি যোগার করা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। সে সময় চাকুরির বাজারে বিসিএস (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) ছিল সবার কাঙ্ক্ষিত চাকুরি। আমিও এর ব্যাতিক্রম ছিলাম না। তাই সরকারি চাকুরীর প্রত্যাশায় বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম। প্রিলিমিনারি, লিখিত এবং মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার বাধা পেরিয়ে ডাক পেয়েছিলাম সাখ্যাতকারের জন্য। যেহেতু সব পরীক্ষা বেশ ভাল দিতে পেরেছিলাম, তাই প্রত্যাশা ছিল যে স্বপ্নের বিসিএস চাকুরীটা হয়ত পেয়ে যাব।

পিএসসির সাখ্যাতকার বোর্ডে প্রবেশ করেই এমন এক বিরুপ পরিবেশ আচ করতে পারলাম তাতে মনে হচ্ছিল যে আমি এখানে এশে এক অপরাধ করে ফেলেছি। অবশ্য বাংলাদেশে সব চাকুরির মৌখিক পরীক্ষাই এরকম, সেখানে গেলে মনে হবে যে যারা সাখ্যাতকার গ্রহণ করছেন তারা হচ্ছেন জমিদার বা লর্ড, আর যারা সাখ্যাতকার দিতে এসেছেন, তারা হচ্ছেন স্লেভ বা দাস। যা-হোক সেই মৌখিক পরীক্ষায় পিএসসির একজন সদস্য আমার কাছে জানতে চাইলেন যে জাতিসঙ্ঘের কার্যাবলী অর্থাৎ কাজ কি। আমি বই পড়ে যতটুকু শিখেছি তা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তিনি কোনভাবেই সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। বলতে দ্বিধা নেই যে আমি সেই বিসিএস মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারিনি।

যেহেতু দ্বিতীয়বার আর বিসিএস পরীক্ষার চেষ্টা করিনি, তাই জীবনে বিসিএস ক্যাডার জব করার সুযোগ হয়নি। তখন খারাপ লাগলেও পরে বুঝেছি যে বিসিএস চাকুরি না হয়ে বেশ ভালই হয়েছে। আর আজকের অবস্থানে দাঁড়িয়ে তো নিশ্চিত করেই বলতে পারি যে সেসময় বিসিএস চাকুরি না হওয়া ছিল আমার জন্য বড় আশীর্বাদ। যা-হোক সেটি একটি ভিন্ন আলোচনা। তবে সেদিন বই পড়ে জাতিসংঘের কার্যাবলী জানার চেষ্টা করলেও আমি সত্যিকার অর্থেই জানতাম না যে আসলে জাতিসংঘের কাজটা কি। আমি জানি না যে আমার সাখ্যাতকার নেয়া পিএসসির সেই কমিশনার মহোদয় এখনও বেঁচে আছেন কিনা। থাকলে তাঁর কাছে জানতে চাইতাম যে আসলে জাতিসংঘের কাজটা কি। কেননা আমি গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে বিএসএস পরীক্ষা দেয়ার সময়ও জানতে পারিনি যে জাতিসংঘের কাজ কি এবং আজও জানি না যে জাতিসংঘের আসল কাজটা কি?

জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার প্রায় আশি বছর পার হয়ে গেছে কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কোনরকম ভুমিকা রাখতে পেরেছে এমন দাবি করার সুযোগ নেই। জাতিসংঘের আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জাতিপুঞ্জ বা লিগ অব নেশনস। সেই প্রতিষ্ঠানও কোনরকম ভুমিকা রাখতে পারেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর ১৯২০ সালে গঠিত হয়েছিল জাতিপুঞ্জ। উদ্দেশ্য ধিল বিশ্বে শান্তি রক্ষা এবং যুদ্ধ এড়াতে এই সংস্থা ভুমিকা রাখবে। জাতিপুঞ্জ গঠিত হবার পর ২৬ বছর কার্যকর থাকলেও সেরকম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রখতে পারেনি। অবশ্য সেসময় ভুমিকা রখার সুযোগও সেভাবে ছিল না। কেননা তখন বিশ্বে অর্থনৈতিক মহামন্দা এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির উত্থানের বিষয় নিয়ে সমগ্র বিশ্ব এক ধরণের উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়। ১৯৩০ সাল আমেরিকাসহ ধনতান্ত্রিক বিশ্বে যে মহামন্দা (গ্রেট ডিপ্রেশন) দেখা দিয়েছিল, সেটা সামাল দিতে পশ্চিমা বিশ্বকে যথেষ্ট হিমসিম খেতে হয়। এরকম অবস্থায় জাতিপুঞ্জ নিজেদের সক্ষমতা প্রমানের সুযোগ সেভাবে পায়নি। মহাম্নদার প্রভাব কেটে যাবার পর যখন সক্ষমতা প্রমানের সুযোগ এসেছিল, তখনও জাতিপুঞ্জ একটি চরম ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানের মত নিরবে দাঁড়িয়ে থেকেছে মাত্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসের উপর দাঁড়িয়ে এই জাতিপুঞ্জ সৃষ্টি হয়েছিল যাতে এই সংস্থা বিশ্বে যুদ্ধ বন্ধে ভাল ভুমিকা রাখতে পারে। বিশ্বে আর যেন কোনো প্রকার ভয়াবহ যুদ্ধ দেখা না দেয়, তা নিশ্চিত করাই ছিল জাতিপুঞ্জের উদ্দেশ্য। কিন্তু সেই জাতিপুঞ্জই দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধ এড়াতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালে জাতিপুঞ্জের সমাপ্তি টেনে অধিকতর ক্ষমতা দিয়ে গঠিত হয় জাতিসঙ্ঘ (ইউনাইটেড নেশনস)।

বিশ্বে যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যায় নিয়ে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হলেও এই সংস্থা বিশ্বে যুদ্ধ, দ্বন্দসংঘাত, হানাহানি বন্ধ করতে সক্ষম হয়নি। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর আশি বছর অতিবাহিত হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয়নি ঠিকই। কিন্তু যুদ্ধ তো থেমে নেই। ছোটছোট দেশের সাথে যেমন অনেক যুদ্ধ হয়েছে, তেমনি বৃহৎ রাষ্ট্রের সাথেও যুদ্ধ থেমে নেই। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, কোরিয়া যুদ্ধ, ইরাক-ইরান যুদ্ধসহ অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে বিভিন্ন দেশের মধ্যে। এরকম ছোটছোট দেশের মধ্যকার যুদ্ধ ছাড়াও বৃহৎ দেশ, বিশেষ করে জাতিসংঘে ভেটো পাওয়ার আছে এমন দেশও যুদ্ধ লিপ্ত হয়েছে। ভারতের সাথে চীনের জুদ্ধ, রাশিয়ার আফগানিস্তান আক্রমণ, আমেরিকার ইরাক আক্রমণ এবং ইংল্যান্ডের ফকল্যান্ড যুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আমেরিকা, যুক্তরাজ্য।, চীন এবং রাশিয়া কোনো না কোনো যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে এবং এই চারটি দেশেরই আছে ভেটো পাওয়ার। এসব যুদ্ধ থেকে সংশ্লিষ্ট দেশকে বিরত রাখতে বা যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘ কোনরকম ভুমিকা রাখতে পারেনি। যুদ্ধ বেধেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ আর জাতিসঙ্ঘ যাদের যুদ্ধ বন্ধে ভুমিকা রখার কথা ছিল, তারা নিরব দর্শকের ভুমিকা পালন করেছে।

জাতিসংঘের নির্লিপ্ততার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হচ্ছে সাম্প্রতিক যুদ্ধ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে একটি সুন্দর দেশ, ইউক্রেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের নামে ইসরাইল সমগ্র গাজা ধ্বংস করে দিল। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এক ভয়াবহ রুপ নেওয়ার পর্যায় চলে গিয়েচিল। সবচেয়ে ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল ইসরাইল-ইরান যুদ্ধ। আমেরিকা আকস্মিক ইরান আক্রমণ করে বসলে তার প্রতিশোধ হিসেবে ইরান যখন মধ্যপ্রাচ্যের ইউএস সামরিক ঘাটিতে আক্রমণ করে, তখন তো বিশ্ব তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। সমগ্র বিশ্ব এক উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিল। সৌভাগ্যক্রমে সংশ্লিষ্ট পক্ষের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদায় হওয়ায় উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছে এবং বিশ্ব কিছুটা সস্তির নিশ্বাস ফেলতে পেরেছে। এই রকম ভয়াবহ অবস্থাতেও জাতিসংঘ কোনরকম ভুমিকা রাখতে পারেনি।

যুদ্ধ ছাড়াও বিশ্বে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে অহরহ। সেসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা রোধেও জাতিসংঘ কোন ভুমিকা রাখতে পারেনা। আসলে বিশ্বে শান্তি বজায় রাখতে যা কিছু করা প্রয়োজন তার কিছুই জাতিসংঘ এখন পর্যন্ত করতে পারেনি। অবশ্য জাতিসংঘের মত আন্তর্জাতিক সংস্থা থাকায় অনেক ভাগ্যবানের এখানে চাকুরী করে আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ হয়েছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের অনেকেই জাতিসংঘে চাকুরীর সুযোগ পেয়ে নিজেদের গর্বিত করে তুলতে পেরেছেন। তাঁদের অনেকেই বেশ গর্বের সাথে বলে থাকেন যে তাঁরা জাতিসংঘে চাকুরি করেছেন। বিষয়টা কিছুটা আমার লেখার শুরুর উপমার মতই, অর্থাৎ বিসিএস চাকুরির মত। আমাদের সমাজে কিছু মানুষের কাছে বিসিএস চাকুরি যেমন বেশ গর্বের, তেমনি বিশ্বের কিছু মানুষের কাছে জাতিসংঘের চাকরিও অহংকার করার মতই। 

জাতিসঙ্ঘ বিশ্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে না পারলেও কিছু উন্নয়নশীল দেশের উপর খবরদারি করতে যথেষ্ট পারদর্শী। কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে কখনো ন্যায়ের বীরুধ সোচ্চার হওয়া, আবার কখনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীরব থাকা ছাড়া এই সংস্থা মানুষের কল্যাণে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকার মত কিছু করেছে এমন দাবি করা যাবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অথচ কয়েক বিলিয়ন ডলারের বাজেট নিয়ে এই সংস্থা পরিচালিত হচ্ছে বছরের পর বছর। সদস্য দেশগুলোকে গুনতে হচ্ছে চাঁদার টাকা। ধনি দেশগুলোর জন্য সমস্যা না হলেও, গরীব দেশগুলোর জন্য এই প্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক চাঁদা অবশ্যই একটি সমস্যা।

যে জাতিসংঘ বিশ্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে কোনরকম ভূমিকা রাখতে পারেনা, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধ করতে পারে না, সেই প্রতিষ্ঠানের আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কিনা সেটাই এখন ভাবার বিষয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের মত অতি সাধারণ মানুষ বিষয় নিয়ে ভাবলে তো আর কোনো কাজে আসবে না। ভাবতে হবে বৃহৎ এবং ক্ষমতাধর দ্বেষগুলোকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে বৃহৎ রাষ্ট্রের কাছে বিষয়টির কোনো গুরুত্বই নেই। একেবারে যে নেই তেমন নয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই জাতিসংঘের ভুমিকা নিয়ে ইতমধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন।

নিরঞ্জন রায়, CPA, CMA, CAMS
সার্টিফাইড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিষ্ট ও ব্যাংকার।
টরনটো, কানাডা
Nironjankumar_roy@yahoo.com