জাপানের অভিজ্ঞতা নিয়ে নতুন বই

ড. দিলীপ চক্রবর্তী

ষোড়শ শতাব্দীর ইংরেজ লেখক ফ্রান্সিস বেকনের মতে একটা ভালো বই একই সঙ্গে পাঠকের জ্ঞানবর্ধন এবং আনন্দবর্ধন করে (Studies are for delight, for ornament, and for ability)। সুশীল কুমার পোদ্দারের লেখা ‘জাপানে যাপিত জীবন’ বইটি একটি ভালো বই হিসেবে গণ্য হবার দাবী রাখে। বইটি এতোটা তথ্যসমৃদ্ধ যে এক কথায় একে ‘মনিপূর্ণ  খনি’ বলা যায় । দ্বিতীয়ত, জাপানে যাপিত জীবনের অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা লেখক এমন  সাবলীল ভঙ্গিতে, এমন প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করেছেন, যে সেটা সহজেই পাঠক প্রীতি লাভ করে। আর সে প্রীতি এতো গভীর ও মধুর যে একজন মহোদয় পাঠক বইটি একবার পড়তে আরম্ভ করলে শেষ না করে ছাড়তে পারবেন না।  

বইটা পড়তে পড়তে পাঠক এতটা আত্মমগ্ন হয়ে যান, যে তিনি ভুলে যান যে আসলে তিনি সাদা কাগজে কিছু কালির অক্ষর পড়ছেন। যে কথা মার্কিন লেখক রিক ইয়ানসি প্রাঞ্জল ভাষায় বলেছেন – one of the joys of a really good book is that you are so into the world of the book, you forget what you’re looking at is words on a page.’

আলোচ্য বইটি পড়তে গিয়ে আমাদের মনে হয় “journey down memory lane” এর লেখক যেন টাইম মেসিনে চড়ে বর্তমান থেকে অনতিঅতীতে যাত্রা করছেন, তার এ যাত্রায় লেখক একা নন, তার পাঠকদেরও সঙ্গে নিয়ে চলেছেন, বইটি পড়ার সময় আমরা মনে করি যেন আমরা নিজেরাই জাপানে জীবন যাপন করছি এবং জাপানি সভ্যতার অঙ্গীভূত হয়ে যাচ্ছি।

বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র সুশীল কুমার পোদ্দার বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে উচ্চ পদে কর্মরত হওয়ার পর জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে জাপানে যান এবং  সেদেশে জীবন সংগ্রামের বিভিন্ন স্তর পার করে কৃতিত্বের সাথে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। জাপান প্রবাসকালে লেখক জাপানকে দেখেছেন নির্মোহ দৃষ্টিতে, তার চোখে জাপানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য  এবং তার মনে ও চিন্তনে জাপানীদের নৈতিক, আত্মিক এবং বৌদ্ধিক সৌন্দর্যের পরিচয় পেয়েছেন। সঙ্গত কারণেই লেখকের চোখে ধরা পড়েছে জাপানিদের কঠোর নিয়মানুবর্তিতা এবং সময়ানুবর্তিতা, জাপানীদের ব্যবহারিক সৌন্দর্য, এবং তাদের অপরিসীম দেশপ্রেম এবং জাতীয় অভিমান। সেই সঙ্গে জাপানিদের কায়িক শ্রম করার ক্ষমতা, সময়কে জাপানিরা কতটা মূল্য দেয় সেই অভিজ্ঞতা লেখকের প্রথমেই হয়েছে যখন ওর গাইডের কাছে প্রথম দিন পৌছতে মাত্র সাত মিনিট দেরি হওয়াতে যে বিড়ম্বনার মধ্যে ওকে পড়তে হয়েছিল।

জাপানিরা নিজের দেশকে প্রচন্ড ভালবাসে এবং দেশের সম্মান রক্ষার্থে ওরা হাসিমুখে নিজের পেটে ছুড়ি মেরে হারিকিরি করে আত্ম-বলিদান করতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটি কথা প্রচলিত ছিল যে কোনো সৈনিক যদি বলে যে সে মরতে ভয় পায় না, তবে হয় সে মিথ্যেবাদী, না হলে সে জাপানি। জাপানিদের ব্যবহারিক ভদ্রতা – কাউকে সামনের দিকে অনেকখানি ঝুঁকে পড়ে সম্বর্ধনা জানানোর প্রথা লেখকের কাছে প্রথম দিকে মনে হয়েছে বাড়াবাড়ি। মনে হয়েছে আদিখ্যেতা। কিন্তু জাপানে থাকার পর লেখক বুঝেছেন যে জাপানিদের এই আচরণ আন্তরিক, কোন আদিখ্যেতা না।

লেখক প্রমাণ করেছেন যে জাপানিরা অতীত অভিজ্ঞতায়, বর্তমানে দাঁড়িয়ে  ভবিষ্যৎ গড়ায় বিশ্বাস করে, জাপানীরা বিশ্বাস করে let not the repentance over the past spoil the present. তাই তারা পারমানবিক বোমার ভয়াবহ অভিজ্ঞতাকে  ভুলে গিয়ে আধুনিক জাপান  গড়ার কাজে মেতে উঠতে পারে।

লেখকের আর একটা বড় গুণ –  তিনি অকপটে নিজের কষ্টের এবং ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছেন, আর্থিক অনাটনের সময় লেখক এত উচ্চ শিক্ষিত হওয়া সত্বেও রেস্তোরাঁর সামান্য বেয়ারার চাকুরি করেছেন। ইংরেজ কবি আলেক্সজান্ডার পোপের মতো লেখকও বিশ্বাস করেন –  “Honour and shame from no condition arise. Act well your part, there all the honour lies.”   

কোন কাজ অসম্মানের না। কাজে ফাঁকি দেওয়াটা অসম্মানের। এই শিক্ষা লেখককেও সাহায্য করেছে কানাডায় এসে যোগ্যতার সঙ্গে কর্মজীবন পালন করতে।