জিপিএস
তখন কানাডাতে আমি একদমই নতুন। আমি ক্রাইসলার জীপের একটি গাড়ির ডিলার অফিসে সেলসের কাজ করছি। অনেকের সাথে পরিচয় হলো। ভিন্ন পেশার অনেক নতুন বন্ধু হলো। হাসি ঠাট্টা তামাসা গল্প খাওয়া দাওয়া সব মিলে খুব আনন্দেই চলছিল। এর মধ্যে আমাদের পরিচিত একজনের একটি বাস্তব ঘটনা যা কিনা আনন্দও দিয়েছিল এবং কিছুটা কষ্টও দিয়েছিল।
গল্পটা একটি জিপিএস’কে নিয়ে। আমরা কোথাও কাজে বা বেড়াতে গেলে জিপিএস একটি অতীব চমৎকার আবিস্কার। এর ব্যবহার দিন দিন ভীষণভাবে বেড়েই চলেছে এবং এর সাথে সাথে মানুষ দিনদিন জিপিএস-এর উপর অনেক নির্ভরশীল হয়ে পরছে। তার মানে দিন দিন জিপিএস মানুষ’কে অনেকটা অলস করে দিচ্ছে। আকাশের বিমান থেকে শুরু করে জলযান, মোটরযান, সাবমেরিন, পুলিশ, এম্বুলেন্স – এই যুগের নুতুন সব গাড়িতে আর মুঠো ফোনে জিপিএস যেন একটি অতি সাধারণ ফিচার।
জিপিএস সব চেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে মোটর গাড়িতে; বিশেষ করে পুলিশ, এম্বুলেন্স, লিমোজিন, ট্যাক্সি ক্যাব ইন্ডাস্ট্রিতে। সেই সময় আলাদা জিপিএস-এর দাম ছিল অনেক বেশি। তখন গাড়ি থেকে অনেক জিপিএস চুরি হতো খুব বেশি। শহরের কিছু ছিচকে চোর, বাম, ড্রাগ এডিক্ট’রা গাড়ি থেকে জিপিএস চুরি করে অনেক কম দামে খোলা বাজারে বিক্রি করতো। একদিন মধ্যরাতে একটা প্রোগ্রাম শেষ করে পার্কিং লটে এসে দেখি আমার গাড়ির একটা জানালা ভাঙ্গা। গাড়ির জানালা ভেঙ্গে জিপিএস চুরি করে নিয়ে গেছে। এখন জিপিএস অনেক সহজলভ্য হলেও বিল্ট ইন জিপিএস এবং মোবাইল ফোনে সেই সুবিধা থাকাতে কেউ আর আলাদা জিপিএস ব্যাবহার করে না।
এবার আসি সেই ঘটনাতে যা আপনাদের বলতে চাচ্ছিলাম। সেদিন এক ফ্যামিলি পার্টিতে অনেক দিন পর আমার এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা। দেখে মনে হলো মনটা খারাপ। জিজ্ঞেস করতেই হরহর করে সব ঘটনা এক নিঃশ্বাসে বলে দিল। আমি হাসবো না সহানুভূতি দেখাবো বুঝতে পারলাম না। নাম তার সাবের, বেশ চটপটে, চালাক চতুর। পেশায় একজন ট্যাক্সি চালক। তার কয়েকদিন আগের ঘটনা। ডাউন টাউনে ট্যাক্সি স্টান্ডে পার্ক করে বসে আছে। এক সময় নোংরা গোছের অল্প বয়সী এক যুবক – বয়স ২২ থেকে ২৫ বছর হবে হয়তো – সাবেরে’র গাড়ির কাছে এসে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো “ব্রো, ডু ইয়ু নিড এ জিপিএস? অলমোস্ট নিউ, ব্রান্ড নিউ” ইস ২৫০ ডলারস”। সাবের বলল – হাউ মাচ ? ছেলেটি বলল, গিভ মি ১০০ ডলারস। সাবের বলল – ৩০। ছেলেটি বাজে একটা চেহারা করে বলল – নিউ প্রাইস ইস ২৫০ ডলার্স ম্যান। সাবের বলল, ৩০ ডলার্স ফাইনাল প্রাইস। ছেলেটি বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলে। মনে হলো বকা দিতে দিতে চলে গেল। সাবের মিরর দিয়ে দেখলে ছেলেটি পিছনের গাড়ির ড্রাইভার’কে একইভাবে জিজ্ঞেস করছে।
কিছুক্ষণ পর সেই ছেলেটি আবারো সাবেরের গাড়িতে জানালায় টোকা দিল। সাবের বসে বসে বাংলা সংবাদপত্র পড়ছিল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল সেই ছেলেটি আবারও এসেছে। মনে হলো অন্য কারো কাছে জিপিএস’টা বিক্রি করতে পারেনি। ছেলেটি বলল, হেই ম্যান গিভ মি ৫০ ডলার্স। সাবের বলল, ৩০ ডলার্স ফাইনাল প্রাইস। ছেলেটি বেজায় মেজাজ করে বলল, ওকে গিভ মি থার্টি। এই বলে ছেলেটি পকেটের ভিতর থেকে জিপিএস-টা বের করে সাবের’র হাতে দিল। সাবের জিপিএস টা হাতে নিয়ে ভাল করে দেখল। ছেলেটি রেগে গিয়ে বলল, হেই ম্যান ২৫০ ডলার্স জিপিএস ইউ আর বাইং ফর ৩০ ডলার্স, হোয়াট আর ইয়ু চেকিং? সাবের পকেট থেকে ৩০ ডলার বের করে দিতেই ছেলেটি বলল, বস আই বেগ ইয়ু এনাদার ৫ ডলার্স, প্লিজ গিভ মি। সাবের ভাবলো জিপিএস’টা দামিই হবে। পকেট থেকে আরো ৫ ডলার ছেলেটিকে দিতেই ছেলেটি মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেল।
সাবের মনে মনে খুব খুশি যে ২৫০ ডলারের জিপিএস মাত্র ৩৫ ডলারের কিনতে পেরে। এতদিন তার একটা জিপিএস ছিল যেটা প্রাইভেট কার আর ট্যাক্সি দু’টোতেই ব্যবহার করতো। এবার দু’টো জিপিএস হওয়া’তে ভাবছে একটা ট্যাক্সি ক্যাবে আর একটা প্রাইভেট গাড়িতে সব সময়ের জন্য ব্যবহার করতে পারবে এবং পরিশেষে তাই হলো।
এবার আসি মূল গল্পে। আগস্টের শেষ লং উইকেন্ড। কয়েক দিন পর ছেলেমেয়েদের স্কুল খুলে যাবে। প্ল্যান হলো স্কুল খোলার আগে আমেরিকার কানেক্টিকাট’এ সাবের’র ছোট বেলার বন্ধু রাহুলের বাসায় বেড়াতে যাবে ২/৩ দিনের জন্য। যা প্ল্যান তাই হলো। সাবের সবাইকে নিয়ে চলে গেল বন্ধুর বাড়ি কানেক্টিকাট। প্রসংগ যখন জিপিএস তখন অবশ্যই নতুন জিপিএস সাথে আছে। দুইদিন খুব আনন্দ করে বেড়ালো বন্ধুর বাড়ি। ছেলে-মেয়েদের স্কুল খুলে যাবে অল্প দিনের মধ্যে। তাই বাড়ি ফেরার পালা। বন্ধুর বাড়ি এত আদর আপ্যায়ন তাই দুপুরের খাবার না খাইয়ে আসতে দিলো না। তার মানে বন্ধুর বাড়ি থেকে যাত্রা শুরু করতে করতে দুপুর পেরিয়ে গেল। সাবের মোটেও চিন্তিত নয়। বাচ্চাদের স্কুল এখনো বন্ধ, তা’ছাড়া জিপিএস তো আছেই, পথ হারাবার ভয় নাই। শুভ শুভ বলে রওনা করলো কানেক্টিকাট থেকে টরন্টোর উদ্দেশে।
গাড়িতে উঠেই জিপিএস-এ বাড়ী ফেরার জন্য হোম বাটনে চাপ দিল। তারপর ছেলে মেয়েদের সাথে গল্পগুজবে মত্ত হয়ে গেল সবাই। জিপিএসে পরবর্তি এক্সিট কখন এই দেখে গাড়ি চালাতে লাগলো। আলবানি পার হবার পর বাফেলো পর্যন্ত প্রায় ৫ ঘন্টার রাস্তা। লম্বা সফর। এইভাবে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা চালাবার পর হঠাৎ দেখলো ব্রিজ টু মন্ট্রিয়েল। হাইওয়ে ৯০ ইস্ট থেকে কখন যে ৮৭ নর্থ এ চলে এসেছে টের’ই পায়’নি। মনে করল এটা হয়ত অন্য কোন এক সহজ রাস্তা। জিপিএস অনুসরন করতে লাগলো। স্মার্ট সাবেরের যে ভুল হতে পারে সেটা কাউকে বুঝতেই দেয়নি। টেনশনে টেনশনে জিপিএস অনুসরন করতে করতে চলল। কেমন যেন অজান পথ। অনেকটা ধোঁকা ধোঁকা লাগছে। সাবেরের স্ত্রী একবার বলেই ফেলল, আমরা কি অন্য পথে যাচ্ছি? সাবের বলল হ্যাঁ, অন্য একটা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। হাইওয়ে থেকে এক্সিট নিয়ে অনেকটা আঁকা বাকা পথ নিয়ে শেষ পর্যন্ত একটি বাসার সামনে থামল। জিপিএস এ মধুর কন্ঠির গলায় ভেসে এলো ‘ইয়উ হ্যাভ রিচড ইয়র ডেস্টিনেশন “সাথে সাথে সাবের এর বৌ বলল, এটা কোথায় নিয়ে এলে? “১১ রু রেডপাথ, মন্ত্রিয়েল”।
সাবের চিন্তায় পরে গেল যে জিপিএস এখানে নিয়ে এলো কেন। এর মধ্যে রাত ৯ টা বেজে গেছে। পিছনে থেকে সাবেরের মেয়ে বলল, হুইচ এড্রেস ডিড ইয়ু পুট ড্যাডী? সাবের বলল, আমি তো হোম বাটন প্রেস করেছি। মেয়ে আবারো বলল, চেক দ্যা এড্রেস ইফ ইউ হ্যাভ ইট রাইট। সাবের জিপিএস এড্রেস মেন্যুতে যেয়ে দেখে ও’মা, এ’তো দেখি ১১ রু রেডপাথ, মন্ট্রিয়েল’ই লেখা আছে। মেয়ে পেছনে থেকে আবারো বলল, হাউ ডিড ইউ গেট দিস এড্রেস ? সাবের কথা বলছে না। সাবেরের এর এবার টনক নড়লো। এটা তো চোরের কাছে থেকে কেনা জিপিএস। মনে হয় জিপিএস-টা এই বাসার কারোই হবে। চোরের মন পুলিশ পুলিশ, এই ভেবে কোন কথা না বলে দ্রুত ঐ এলাকা ত্যাগ করল।
ততক্ষণে রাত প্রায় সাড়ে ৯টা বাজে। মেজাজ তখন তুঙ্গে। নিজের বোকামির কথা বাচ্চাদের বলতে পারছে না। এদিকে অনেক রাত হয়ে গেছে। এতক্ষণ গাড়ি চালিয়ে টায়ার্ড হয়ে গেছে। তারপর মন্ট্রিয়েল থেকে টরন্টো আরো প্রায় সাড়ে ৫ থেকে ৬ ঘন্টা ড্রাইভ ভাবতেই সাবেরের মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল। নির্জন এলাকা থেকে তাড়াতাড়ি বের হবার জন্য বেপরোয়া গাড়ি চালাচ্ছিল। সাবেরের মাথায়’ই ছিল না যে টরন্টো’র মত মন্ট্রিয়েলে রেড লাইটে ডানে বা বামে মোড় নেয়া যায় না। এর মধ্যে অনেকগুলো রেড লাইটে ডানে বামে মোর নিয়ে দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছিল। সড়কের স্পিড লিমিট কত সেটাও দেখার মত চিন্তা ভাবনাও মাথায় কাজ করছিল না। কপাল মন্দ হলে যা হয়। কিছু দূর যেতেই পিছন থেকে পুলিশের বাতি জ্বলে উঠলো। এবার সাবের এর হাত-পা কাপাকাপি শুরু হতে লাগলো। বিনা দ্বিধায় গাড়ি সাইডে পার্ক করলো।
গাড়ি শুদ্ধ সবাই চুপ চাপ বসে আছে। পুলিশ অফিসার সাবেরের পাশে এসে গাড়ির কাগজপত্র আর ড্রাইভার্স লাইসেন্স দেখতে চাইলো। নিরুপায় সাবের পুলিশ অফিসার’কে শুধু বলল, কানেক্টিকাট থেকে টরন্টো যাবে কিন্তু ভুল করে এই রাস্তায় এসে পরেছি। কয়েকটা রেড লাইট সিগন্যালে মোর নেয়া আর স্পিডিং করার জন্য তাকে দু’টো টিকিট দেয়া হল। জরিমানা সর্বমোট ৬৫০ ডলার আর ৬ পয়েন্টস। এমন বিপদে সাবেরে’র স্ত্রী আর ছেলেমেয়েরা চুপ করে রইল। কোন কথা বলে সাবের’কে আরো চটাবার সাহস কেহ আর রাখলো না।
তখন রাত বাজে সাড়ে ১১টা। এ সময় টরন্টো’তে বাসায় থাকবার কথা ছিল কিন্তু এখন সে মন্ট্রিয়েলে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার দূরে। হাতে দুই’টা টিকিট। একটা স্পিডিং আর একটা রেড লাইট অমান্য করার জন্য মাত্র ৩৫ ডলারে কিনেছিল জিপিএস’টা যার বাজার মুল্য ২৫০ ডলার হবে হয়তো। জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার জন্য আর সামান্য কিছু ডলার বাঁচাবার জন্য এক চোরকে প্রশ্রয় দিয়েছিল সাবের। ২৫০ ডলারের জিপিএস মাত্র ৩৫ ডলারে কেনার লোভে পরে বিনিময়ে দুটো টিকেট, জরিমানা ৬৫০ ডলার, ৬ পয়েন্টস, মানষিক যন্ত্রনা, অতিরিক্ত সময় ব্যয়, গাড়ির জ্বালানী সব মিলিয়ে জিপিএস-এর দাম একটু বেশিই পরে গিয়েছিল।