টরন্টোর গুলিস্তান এখন বেশ জমজমাট

নিরঞ্জন রায়

কানাডার বৃহত্তম বাণিজ্যিক শহর টরন্টোর কিছু এলাকা আছে যেখানে অধিক সংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করে। এর মধ্যে ড্যানফোর্থ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি বসবাস করে। এর অনেক কারণও আছে। যারা প্রথম এখানে আসে, তাদের জন্য এলাকাটি খুবই সুবিধাজনক। অধিক সংখ্যাক বাংলাদেশীদের বসবাস থাকায় খুব সহজে একটি বাসা যেমন ভাড়া পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি বাসাটি গুছিয়ে নিতে কোনো অসুবিধা হয় না। এই বৃহৎ শহরে ব্যাক্তিগত গাড়ি ছাড়া চলাচল করা বেশ কঠিন। অথচ এই এলাকায় থাকলে খুব সহজেই পাবলিক পরিবহণে সমগ্র টরন্টো শহর চষে বেড়ানো যায়। তাছাড়া দেশ থেকে এত দুরে এসেও দেশের খাদ্যাভ্যাস, অর্থাৎ মাছভাতের স্বাদ নেয়া যায়। কেননা এই এলাকায় দেশীয় খাবারদাবারসহ বাঙ্গালি জীবনযাপনের সবকিছু খুব সহজে পাওয়া যায়।

সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে যে যারা প্রথম এই শহরে আসে তাঁরা এই এলাকায় বসবাস করলে খুব সহজে হতাশ হবে না। অন্যান্য এলাকা মূলত তাঁদের জন্য, যারা এসে তিন/চার বছর সংগ্রাম করে গুছিয়ে নিয়েছে। অর্থাৎ যাদের মোটামুটি একটা চাকুরি আছে, বাড়ি আছে এবং চলাচলের জন্য একটা গাড়িও আছে, যা তাঁরা প্রথম আসার পর তিন/চার বছর কষ্ট করে অর্জন করেছে, তারাই সেসব এলাকায় থাকতে পারেন। কেও যদি প্রথম এসেই এসব ম্যাচিউরড অঞ্চলে থাকতে শুরু করে, তাহলে প্রথম দিন থেকেই তাঁর মধ্যে হতাশা দেখা দিবে। সবসময় ভাবতে থাকবে যে সে এদেশে এসে ভুল করেছে। কবে তার চাকুরি, গাড়ি, বাড়ি হবে, তা ভেবেই সে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়বে, যা এখানে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। পক্ষান্তরে কানাডায় প্রথম আসা ব্যাক্তি যদি বাঙ্গালি অধ্যুষিত ড্যানফোর্থ অঞ্চলে বসবাস শুরু করে, তখন সে তাঁর চারপাশে তাঁর মত আরও অনেককে দেখতে পাবে। ফলে হাতাশ হওয়ার পরিবর্তে খুব সহজে মেনে নিতে চেষ্টা করবে যে এখানকার ব্যবস্থাই এরকম যে তিন থেকে চার বছরের একটা সংগ্রামি অধ্যায় পার করেই প্রতিষ্ঠা পেতে হয়।

এসব সুবিধার জন্য এই ড্যানফোর্থ অঞ্চলে অধিকাংশ বাংলাদেশি বসবাস করে। সেকারণে এই অঞ্চলকে বাঙ্গালি পাড়া বলে আখ্যায়িত করা হয়। আমি নিজেও বাঙ্গালি পাড়াই বলতাম। এখন অবশ্য এই ড্যানফোর্থ এলাকা আমার কাছে টরন্টোর বিয়ানিবাজার বলেই মনে হয়। এখানকার পরিবেশ এখন বাংলাদেশের বিয়ানিবাজারের মত। সেখানে লোকজন অনর্গল সিলেটী ভাষায় কথা বলে। পোশাকআশাকও একেবারে সিলেটীদের মতই। যদি কেও বাংলাদেশ থেকে প্রথমবার কানাডা বেড়াতে আসে, তখন যদি তাঁকে টরন্টোর বিমানবন্দর থেকে সরাসরি ড্যানফোর্থ অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তিনি বুঝতে পারবেন না যে তিনি সিলেটের বিয়ানিবাজার, নাকি টরন্টো শহরের কোনো একটি এলাকায় আছেন।

বিগত দুই বছরে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি কানাডা আসার সুযোগ পেয়েছে। তাঁরা এসে এই ড্যানফোর্থ অঞ্চলে বসবাস করায় পুরো এলাকা তাদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠেছে। কৌতূহলবশত আমি অনেকের কাছেই জানতে চেয়েছি যে তাঁরা কিভাবে এখানে এসেছে। তাঁরা সবাই জনিয়েছে যে প্রথমে কানাডার ভিজিট ভিসা সংগ্রহ করে কানাডা এসেছে এবং পরে রিফিউজির জন্য আবেদন করেছে। যাদের সাথে কথা হয়েছে তাদের দু একজনের রিফিউজি আবেদেন গৃহীত হয়ে এখন প্রটেকটেড নাগরিক হিসেবে অভিবাসন পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। আবার দু একজনের রিফিউজি আবেদন প্রত্যাখ্যান হয়েছে। ফলে নানারকম ফন্দিফিকির করে থেকে যাবে, নাকি দেশে ফিরে যাবে, সেই চিন্তায় উদ্বিগ্ন আছে। বাকিদের রিজিউজি আবেদন এখনও প্রক্রিয়াধিন আছে। ফলে এভাবে যারা কানাডা এসেছেন তাদের মধ্যে দুএকজন ভাগ্যবানদের কথা বাদ দিলে, বাকিদের অবস্থা বেশ অনিশ্চিত এবং উদ্বেগজনক।

এত বিপুল সংখ্যাক বাংলাদেশি কিভাবে কানাডার ভিসা পেয়ে গেল, তা আমার কাছে এক বড় রহস্য। কেননা কানাডার ভিসা পাওয়া মোটেই সহজ কাজ নয়। অবশ্য শুধু কানাডার ভিসা কেন, এখানে এমন কিছু বিষয় আছে, যা আমার কাছে এক রহস্য হিসেবেই থেকে গেল। এখানে সেরকম মানসম্পন্ন চাকুরি না করেও, মিলিয়ন ডলারের বাড়ির মালিক হওয়া যায়, দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি চালানো যায় এবং বছর বছর কিউবা, মেক্সিকোসহ বিভিন্ন দ্বীপদেশে ভ্যাকেশনেও যাওয়া যায়। আমরা একটা মানসম্পন্ন চাকুরি করেও সাধারণ মানের একটি গাড়ি চালাতে এবং পুরনো আমলের একটি বাড়ি রাখতেই হিমসিম খাই। এক পয়সা সঞ্চয় তো হয়ই না, উল্টো প্রতি বছর ক্রেডিট কার্ডের বিল বাড়তে থাকে। যেদেশে বাৎসরিক গড় আয় এখনও ৬৭ হাজার ডলার, সেখানে এরকম হবে এটাই স্বাভাবিক। অথচ অনেকেই, এমনকি আমার পরিচিত কেও কেও বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে অনায়াসে। কিভাবে এটা সম্ভব, তা আমার কাছে আজও এক বড় রহস্য। কেননা বাংলাদেশ হলে ভাবতে পারতাম যে অবৈধ উপার্জন, যেমন – ঘুষ, চাঁদাবাজি বা ব্যাংক ঋণ আত্মসাতের সুযোগ আছে। কিন্তু এখানে তো আর সেটা সম্ভব নয়। যা-হোক এটি একটি ভিন্ন এবং স্পর্শকাতর বিষয়, তাই এ বিষয়ে আর বেশি কিছু লিখে প্রবাসি বাংলাদেশিদের বিরাগভাজন হতে চাই না।   

যে মানুষগুলো বাঙ্গালি অধ্যুসিত ড্যানফোর্থ অঞ্চলে অকারণে লক্ষ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করে, আড্ডা দেয় এবং সময় কাটায়, তাদের মুখে কোনরকম উদ্বেগ উৎকণ্ঠার ছাপ নেই। দেখে মনে হয় তাঁরা বেশ ভালই আছে। অথচ তাঁদের অধিকাংশ ভিজিট ভিসা নিয়ে কানাডা এসে রিফিউজির জন্য আবেদন করে বসে আছে। তাদের রিজিউজি আবেদন গৃহীত হবে কিনা, তা নিয়ে আছে এক অনিশ্চয়তা। যারা রিফিউজি হিসেবে স্থায়িভাবে থাকার সুযোগ পাবেন, তাদেরও যেতে হবে এক লম্বা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। এরকম একটি দীর্ঘ অনিশ্চিত পথের যাত্রী হয়েও তারা কত স্বতঃস্ফূর্ত এবং হাসিখুশি। অথচ আমরা প্রায় দুই যুগ ধরে এখানে স্থায়িভাবে বসবাস করলেও সবসময় উদ্বেগের মধ্যে থাকতে হয় এই ভেবে যে কখন চাকুরি চলে যায়, মর্টগেজ ঋণের কিস্তি পরিশোধের ব্যর্থতায় বাড়ি হাতছাড়া হয় বা অপর্যাপ্ত সঞ্চয়ের কারণে অবসর জীবনে আর্থিক সংকট দেখা দেয়।  

আমি গত সপ্তাহে বাঙ্গালিঅধ্যুশিত ড্যানফোর্থ অঞ্চলে যেয়ে যে রমরমা অবস্থা দেখলাম, তাতে এই এলাকাকে আর বিয়ানিবাজার বলার সুযোগ নেই। এখন মনে হয় টরন্টোর গুলিস্তান বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত। গুলিস্তানের মতই এখানে লোকে লোকারণ্য। গুলিস্তানে যেমন অসংখ্য মানুষ নির্দিষ্ট কাজকর্ম ছাড়াই লক্ষ্যহীন ভাবে ঘোরাঘুরি করে, ঠিক তেমনি ড্যানফোর্থ এলাকায় অনেক বাংলাদেশী কাজকর্ম ছাড়াই লক্ষ্যহীনভাবে ঘোরাফেরা করে। ড্যানফোর্থ এভিনিউয়ের ফুটপাতে বসেছে ফুসকার দোকান, ঝালমুড়ির দোকান, চায়ের দোকান এবং অন্যান্য কিছু খাবারের দোকান। আরও আছ ফুটপাতে টি-শার্টের দোকান, জুতার দোকান এবং সবজির চারা বিক্রির দোকান। ড্যানফোর্থ অঞ্চলের ফুটপাতের খাবারের দোকানের পাশে লোকজন দল বেঁধে দাঁড়িয়ে ফুসকা, ঝালমুড়ি খায় এবং চা পান করে। এসব খাবার খেয়ে গুলিস্তানের মতই আবর্জনা রাস্তায়ই ফেলে দিচ্ছে। ফলে এক সময়ের পরিচ্ছন্ন এলাকা নোংরা হয়ে গেছে। এক সময় সিটি কর্পোরেশন থেকে প্রতিদিন রাস্তা পরিষ্কার করতো এবং বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে দৃষ্টিনন্দন ঝুলন্ত ফুলের বাগান তৈরি করা হতো। এখন আর সেসব দেখা যায় না। সিটি কর্তৃপক্ষও হয়ত হাল ছেড়ে দিয়েছে। তাঁরা হয়ত বুঝে গেছে যে এই এলাকা আর পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব নয়।

দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে যখন অধিক সংখ্যাক বাংলাদেশিদের দেখতে পাই, তখন বেশ ভালই লাগে। কেননা এতে কমিউনিটি অনেক বড় হয়। আর কমিউনিটি বড় হলে নিজেদের অবস্থানও বেশ শক্ত হয়। যেমন, ভারত এবং চীনের কমিউনিটি অনেক বড়। ফলে এদেশে তাদের অবস্থান বেশ শক্ত। রাজনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য, চাকুরিবাকুরি; সব স্থানেই তাদের বেশ ভাল অবস্থান। আমাদের কমিউনিটি বড় হওয়ায় আমাদের অবস্থান শক্ত হবার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের অবস্থান সেভাবে শক্ত হচ্ছে না। এর অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে আমরা এই উন্নত দেশে আসার সময় আমাদের খারাপ অভ্যাসগুলো দেশে রেখে আসতে পারিনি। আমাদের সব খারাপ অভ্যাস ও আচরণ সাথে করে নিয়ে এসেছি এবং দৈনন্দিন জীবনে সেসব খারাপ অভ্যাস অব্যাহতও রেখেছি। উল্টো এখানকার যে নাগরিক দায়িত্ব কর্তব্যের স্বাধীনতা আছে, তার অপব্যবহার করে বেশি পরিমাণে খারাপ অভ্যাস চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের অনেকের ধারণা যে এখানকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব কিছু জানে না। বিষয়টা মোটেই তেমন নয়। এরা সবকিছু জানে, কিন্তু একটা পর্যায় পর্যন্ত তারা কিছু বলে না। আর আমরাও সেই সুযোগ নিতে থাকি। ফলশ্রুতিতে কমিউনিটি বড় হলেও অবস্থান সেভাবে শক্ত হয় না।

এতকিছুর পরেও বলতে হয় যে অবস্থান যেমনই হোক না কেন, কমিউনিটি বড় হবার কিছু সুবিধা আছে। অধিক সংখ্যাক বাংলাদেশিদের বসবাসের কারণে এখন আর মনে হয় না যে বিদেশে আছি। মনে হয় যেন দেশেই আছি। কমিউনিটি-ভিত্তিক ব্যবসাবাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। দেশের মত সবকিছুই খুব সহজে পাওয়া যায়। এমনকি ফুটপাতের ঝালমুড়ি, ফুসকা, চা এবং আরও কতকিছু। যখনই মনে হয় যে দেশের আমেজ উপভোগ করবো, তখনই ছুটে যাই ড্যানফোর্থ এলাকায়, যেখানে টরন্টোর গুলিস্থান  এখন বেশ জমজমাট। #

নিরঞ্জন রায়, CPA, CMA, CAMS
সার্টিফাইড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিষ্ট ও ব্যাংকার।
টরনটো, কানাডা
Nironjankumar_roy@yahoo.com