টরন্টোর মঙ্গল শোভাযাত্রা: ফিরে দেখা
সেদিন ছিল ২০ এপ্রিল। সকালে ব্রাম্পটন শহরে পার্কে বসে আছি। পার্কে আমার সাথী দুটি কুকুর। দ্বিতীয় কোন ভদ্রলোক পার্কে উপস্থিত নেই। অবশ্য আমাকে যদি ভদ্রলোক হিসেবে মানতে আপনাদের অসুবিধা থাকে তবে আমি নাচার।
সকালে এবং বিকেলে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করা আমার বহু বছরের অভ্যাস। যদিও আমার এই অভ্যাসকে আড়ালে কেউ কেউ বলেন পাগলামি, কেউ বলেন বাড়াবাড়ি, আবার কেউ বলেন আদিখ্যেতা। হাঁটার কথা মনে হতেই আমার দুজনের কথা মনে পড়ছে – ৭৫ বছর আগে প্রয়াত আমার বাল্যবন্ধু খোকন শিকদার – যে বলতো যে সে সকাল এবং বিকাল দুবেলাতে মর্নিং ওয়াক করে। কারণ ওর ধারণা ছিল হাঁটার ইংরেজি মর্নিং ওয়াক। কাজেই বিকেলে হাঁটলেও সেটা ওর কাছে মর্নিং ওয়াকই ছিল। আর দ্বিতীয় জন টরন্টো শহরের বাঙালি অঞ্চলের বাসিন্দা আমার মানস-কন্যা শ্রীমতি নীলিমা দত্ত যার কাছে টরন্টো শহরের জনবহুল ফুটপাতে (এদেশের ভাষায় সাইড ওয়াক) ৮-১০ কিলোমিটার হাঁটা জলভাত।
ব্যক্তিজীবনে নীলিমা লব্ধ প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক মননশীল গবেষক এবং মরমীয়া ভাষ্যকার সুব্রত কুমার দাসের সহধর্মিনী। নীলিমা আমাকে পিতৃব্য হিসেবে মানে এবং সেই রকম শ্রদ্ধা ভক্তি করে যদিও ওর বাবা-কাকা হবার মত কোন গুণ আমার নেই।
পার্কে বসে আছি কিন্তু আমার তখন মন খুব খারাপ কারণ আমার মন পড়ে ছিল টরন্টো শহরের বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রায়। ১লা বৈশাখ নববর্ষ উপলক্ষে বর্ষবরণ উৎসবে টরন্টোর ভারত সেবাশ্রম মন্দিরে গিয়েছিলাম। সেখানে শিউলি শিকদার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে আমি ২০ এপ্রিল টরন্টোর মঙ্গল শোভাযাত্রায় যাব কি না। আমি বলেছিলাম যে অনেক সাধ থাকলেও সাধ্য নাই, কারণ আমার ৮৮ বছর বয়স এবং আমি গাড়ি চালাই না। কাজেই কোথাও যাওয়া আসা আমার ইচ্ছা-নির্ভর নয় বরং অন্যের কৃপা-নির্ভর। যেমন সেদিন আমি ভারত সেবাশ্রম যেতে পেরেছিলাম খ্যাতিমান সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আলোক ব্যানার্জির সৌজন্যে। আলোকের বদান্যতায় গাড়িতে চড়ে অনেক জায়গায় যেতে পারি। দ্বাপর যুগে অর্জুনকে রথে ঘুরিয়েছেন সারথি রূপী শ্রীকৃষ্ণ, কলিযুগে আমাকে ঘোরান সারথি রূপী শ্রীমান আলোক।
মন খুব দ্রুতগামী আলোর চেয়েও বেশি। উইলিয়াম কুপার রচিত আলেক্সান্ডার শেলকার্ক কবিতার মতো টাইম মেশিনে চড়ে ছ বছর পিছিয়ে পৌঁছে গেলাম ২০১৯ সাল বা ১৪২৬ বঙ্গাব্দে নববর্ষ বরণের শোভাযাত্রায়। সকাল সেদিন ছিল আকাশের মুখ ভার, কিন্তু শোভাযাত্রীদের মুখ ছিল উজ্জ্বল। অনেক পুরুষ এবং নারী সুন্দর পোশাক এবং উৎসাহে সমবেত হয়েছিলেন। আমিও সেখানে ছিলাম। জায়গাটা ছিল ড্যানফোর্থ এভিনিউ আর ভিক্টোরিয়া পার্কের সংযোগস্থলের মেট্রো পার্কিং লট। যাত্রার আগে এসে গেল বাংলাদেশ কানাডা হিন্দু মন্দির থেকে পাঠানো বড় বড় পাত্র ভর্তি কফি-চা মন্দিরের কর্তাব্যক্তিরা। সুভাষ রায়, বিমলেন্দু চৌধুরী, নির্মল কর, শ্যামল ভট্টাচার্য, শিবু চৌধুরী, বিজিত রায়, শুভ্রা শিউলি সাহা, অনিল নাথ অন্যান্যরা জানেন যে সাধারণ বাঙালিরা শৈশবে মা ভরসা আর যৌবনের চা ভরসা।
সমবেত কন্ঠে গান গাইতে গাইতে রাস্তা পরিক্রমা করে বাঙালিরা মঙ্গল শোভাযাত্রায় মাধ্যমে বর্ষবরণ করল। তারপর শুরু হলো বক্তৃতামালা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং অন্যান্য বিভিন্ন অনুষঙ্গ অনুষ্ঠানকে মনোগ্য করে তুলল। এনআরবি টেলিভিশনের পক্ষে সুব্রত কুমার দাসের অনুষ্ঠান ধরে রাখা প্রয়াস অনুষ্ঠানটিকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিল।