ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে ধনাঢ্যের দুষ্টচক্র

নিরঞ্জন রায়

আমরা যারা অর্থনীতি বা বাণিজ্য বিভাগে পড়াশোনা করেছি, তাদের উন্নয়ন অর্থনীতি বা ডেভোলপমেন্ট ইকোনমিক্স নামের একটি বিষয় পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই পাঠ্যসূচীর মধ্যে একটি অর্থনৈতিক তত্ত্ব ছিলো, তা হচ্ছে দারিদ্রের দুষ্টচক্র। এই তত্ত্বটি বেশ গুরুত্ত্ব দিয়ে পড়ানো হতো এবং প্রায় প্রতিবছরই প্রশ্নপত্রে দারিদ্রের দুষ্টচক্রের উপর একটা প্রশ্ন থাকত। ফলে আমরাও বেশ মনোযোগ দিয়ে দারিদ্রের দুষ্টচক্রের বিষয়টি পড়েছি। পড়েছি বললে ভুল বলা হবে। মূলত না বুঝেই মুখস্ত করেছি যাতে পরীক্ষার খাতায় লিখতে পারি। ছাত্রজীবনে বিষয়টি গুরুত্ত্ব সহকারে পড়ানো হলেও, বিষয়টি সেভাবে বুঝতে পারিনি। ছাত্রজীবন শেষ করে যখন কর্মজীবনে প্রবেস করলাম, তখন এই বিষয় নিয়ে ভালভাবে পড়াশোনা করে এই দারিদ্রের দুষ্টচক্র সম্পর্কে জানার চেষ্টা করলাম। বিষয়টি যে খুব ভালভাবে বুঝতে পেরেছি তেমন দাবি করা না গেলেও ধারনাটা অন্তত পেরেছি।

দারিদ্রের দুষ্টচক্র মূলত এমন একটি অবস্থা, যা দারিদ্রের ফাদে আটকে থাকার মত। যে দেশ বা জাতি দরিদ্র, তাদের সঞ্চয় বা মূলধন থাকে না বা খুবই অল্প পরিমাণে থাকে। আর এই সঞ্চয় বা মূলধনের অভাবে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ হয় না। বিনিয়োগের অভাবে অবকাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব হয় না, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় না। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি না পাওয়ায় সামষ্ঠিক চাহিদাও বৃদ্ধি পায় না। আবার চাহিদা বৃদ্ধি না পাওয়ায়, বিনিয়োগও বৃদ্ধি পায় না। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে স্বল্প উপার্জন বা সঞ্চয়ের কারণে, স্বল্প বিনিয়োগ। স্বল্প বিনিয়োগের কারণে স্বল্প কর্মসংস্থান, যার কারণে স্বল্প চাহিদা এবং অবশেষে স্বল্প চাহিদার কারণে আবার সেই স্বল্প বিনিয়োগ। স্বল্প বিনিয়োগের কারণে স্বল্প উপার্জন বা সঞ্চয়, যা অপর্যাপ্ত মূলধন তৈরি করে। এই স্বল্পের চক্রে অর্থনীতির সবকিছু আটকে থাকাকেই উন্নয়ন অর্থনীতিবিদরা দারিদ্রের দুষ্টচক্র বলে আখ্যায়িত করেছেন।

এই দারিদ্রের দুষ্টচক্র সম্পর্কে জানতে যেয়ে উন্নত বিশ্বের একজন উন্নয়ন অর্থনীতিবিদের লেখা পড়েছিলাম। পাঠকরা ক্ষমা করবেন কেননা লেখকের নামটা স্মরণ করতে পারছি না, কারণ অনেক আগে লেখাটা পড়েছিলাম। সেই অর্থনীতিবিদ তাঁর লেখার স্বার্থে বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশ ভ্রমণ করেছেন। সেসব দেশের অর্থনীতি এবং দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছেন। সেই উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ তাঁর লেখার এক স্থানে উল্লেখ করেছেন এমন ভাবে “তৃতীয় বিশ্বের মানুষ গরীব, কারণ তারা গরীব”। গরিব মানুষের আয় উপার্জন কম, ফলে তারা ছেলেমেয়েদেরকে সুশিক্ষার মাধ্যমে মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে না। স্বল্প উপার্জনের কারণে থাকে না কোনো সঞ্চয় বা বিনিয়োগযোগ্য অর্থ। ফলে সংসারে দারিদ্রতা লেগেই থাকে এবং সেই সাথে থাকে অপুষ্টি এবং অশিক্ষা। এই দরিদ্র পরিবেশে বেড়ে উঠা ছেলেমেয়েরাও বাব-দাদার মত স্বল্প উপার্জনের কাজে নিয়োজিত হয়। ফলে গরিব ঘরে জন্ম নেয়ার কারণে তারাও গরিব থেকে যায়। একারণেই সেই লেখক মন্তব্য করেছেন যে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ গরিব, কারণ তারা গরিব। 

গত শতাব্দীর শেষের দিকে, বিশেষ করে সত্তর এবং আশির দশকে এই দারিদ্রের দুষ্টচক্র তত্ত্বটি বেশ জনপ্রিয় ছিল। কেননা সেই সময় উন্নয়নশীল বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এই দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আটকে ছিল। আর সেসব দেশকে এই দুষ্টচক্র থেকে বেড় করে আনতে আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিশেষ করে জাতিসঙ্ঘ, বিশ্বব্যাংক এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার চেষ্টার কমতি ছিল না। বিভিন্ন ঋণ সুবিধা প্রদান এবং এই সুবিধার অন্তরালে বিদেশি বিশেষজ্ঞ নিয়োগের মাধ্যমে বেশির ভাগ ঋণের অর্থ বেড় করে নিয়ে অনেক বিদেশি বিশেষজ্ঞকে বড়লোক বানানোর চেষ্টাও অনেক হয়েছে। এই ঋণ সুবিধার মাধ্যমে কিছু নামমাত্র অবকাঠামো গড়ে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু এর অন্তরালে দুর্নীতিও হয়েছে যথেষ্ট। বলা যেতে পারে যে আজ অনেক উন্নয়নশীল দেশে যে বিশাল বিশাল দুর্নীতির ঘটনা ঘটে, তার সূত্রপাত কিন্তু সেই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঋণ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমেই হয়েছে। যা-হোক পরবর্তীতে অনেক উন্নয়নশীল দেশই এই দারিদ্রের দুষ্টচক্র থেকে বেড় হয়ে আসতে পেরেছে। কিছু দেশ তো মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছে গেছে, অনেক দেশ স্বল্প উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নিত হয়েছে। অনেক দেশ অবস্থান পরিবর্তন করতে না পেরে এখনও স্বল্পউন্নত দেশের অবস্থানে থাকলেও দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রটা ভাংগতে শুরু করেছে। ফলে এক সময়ের উন্নয়ন অর্থনীতির খুবই গুরুত্বপূর্ণ দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ধারনাটি তার গুরুত্ত্ব হারিয়ে ফেলেছে।

এখন আর অর্থনীতির এই তত্ত্বটি সেভাবে আলোচনাই হয় না। এমনকি উন্নত বিশ্ব, যারা আগে অর্থনীতির এই তত্ত্বটি নিয়ে বেশ উচ্চস্বরে কথা বলেছে, তারও এখন আর এবিষয়ে কিছু বলে না। উন্নত বিশ্বের মিডিয়া, অর্থনীতিবিদ এবং থিংকট্যাংক, কেওই আর এই বিষয়টি নিয়ে সেভাবে আলোচনা করে না। তবে দারিদ্রের দুষ্টচক্র আলোচনা থেকে পিছনে পরে গেলেও, আরেকটি দুষ্টচক্র এখন আলচনায় চলে এসেছে, সেটি হচ্ছে “ধনাঢ্যের দুষ্টচক্র”। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ছিল উন্নয়নশীল বিশ্বের বিষয়, আর “ধনাঢ্যের দুষ্টচক্র” হচ্ছে উন্নত বিশ্বের বিষয়। মূলত ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির এক অনিবার্য বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই “ধনাঢ্যের দুষ্টচক্র”। এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে যে ধনি, সে আরও বেশি ধনি হবে। যার বেশি সম্পদ আছে, সেই আরও বেশি সম্পদের মালিক হবে।

বর্তমান অর্থনীতির কাঠামোই এমনভাবে গড়ে উঠেছে যেখানে বিত্তশিলদের আরও বেশি বিত্তবান হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে আছে। উন্নত বিশ্বে যার একশত বিলিয়ন ডলার আছে, সে যদি দশ শতাংশ সুদে জমা রাখে, বছরে তাঁর দশ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পাবে। এখান থেকে যদি এক বিলিয়ন ডলার নিজের জন্য খরচ করে, তাহলেও একবছর পর তার সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে এক শত নয় বিলিয়ন ডলারে উন্নিত হবে। এভাবে পাঁচ বছরে তার সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় দুই শত বিলিয়ন ডলারে এবং পরবর্তী পাঁচ বছরে চার শত বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। অর্থাৎ এক সময়ের এক শত বিলিয়ন ডলারের মালিক মাত্র দশ বছরের ব্যবধানে চার শত বিলিয়ন ডলারের মালিক বনে যাবে। মার্ক জাকারবাগ, এলন মাস্ক, ওয়ারেন বাফেটের মত বিশ্বের সেরা ধনি ব্যাক্তিরা এভাবেই শতশত বিলিয়ন ডলারের মালিক হয়েছেন। পক্ষান্তরে যার মাত্র দশ লাখ ডলার আছে, সে একই সুদের হারে বিনিয়োগ করে বছরে উপার্জন করতে পারবে মাত্র এক লাখ ডলার। অথচ তার জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন হবে দের লাখ ডলার। ফলে দেখা যাবে এক বছর পর দশ লাখ ডলার হ্রাস পেয়ে নয় লাখ পঞ্চাশ হাজার ডলারে নেমে এসেছে। এভাবে দশ বছর পর সেই ব্যাক্তির সম্পদের পরিমাণ হ্রাস পেয়ে পাচ লাখ ডলারে নেমে আসবে। অর্থাৎ এক সময়ের দশ লাখ ডলারের মালিক মাত্র দশ বছরের ব্যবধানে পাচ লাখ ডলারের মালিকে নেমে আসবে।

বিষয়টি নিয়ে যে একেবারে আলোচনা হচ্ছে না তেমন নয়। আলোচনা ঠিকই চলছে, তবে “ধনাঢ্যের দুষ্টচক্র” হিসেবে আলোচনা না হয়ে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আলোচনা চলছে। অনেকে এই অবস্থাকে বলার চেষ্টা করেছেন যে বর্তমান অর্থ ব্যবস্থায় ধনি আরও ধনি হচ্ছে এবং গরিব আরও গরিব হচ্ছে। আমাদের দেশে “ধনির আরও ধনি হওয়া এবং গরিবের আরও গরিব হওয়ার” বিষয়টিই সবচেয়ে বেশি আলোচিত। আমাদের চতুর্দিকে দৃষ্টি দিলে এই অবস্থাই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। কিন্তু উন্নত বিশ্বে বিষয়টি একটু ভিন্নভাবে আলোচনা হয়ে থাকে। আজ থেকে প্রায় বিশ/পচিশ বছর আগে উন্নত বিশ্বের আর্থিক অবস্থা ছিল “পাচ শতাংশ বনাম পচানব্বই শতাংশ” এর মত। এর অর্থ হচ্ছে পাচ শতাংশ মানুসের হাতে যে পরিমাণ সম্পদ ছিল, তার সমপরিমাণ সম্পদ ছিল বাকি পচানব্বই শতাংশ মানুষের হাতে। এর পনের বছর পরে, অর্থাৎ মাত্র দশ বছর আগে এই সমীকরণ এসে দাঁড়ায় “এক শতাংশ বনাম নিরানব্বই শতাংশ”। অর্থাৎ উন্নত বিশ্বের আর্থসামাজিক কাঠামো এমন দাঁড়িয়েছিল যেখানে নিরানব্বই শতাংশ মানুষের হাতে যে পরিমাণ সম্পদ, তা মাত্র এক শতাংশ ধনি মানুসের হাতে আছে।

অবস্থা যেভাবে এগোচ্ছে তাতে সেদিন আর বেশি দুরে নয় যখন ধনাঢ্যের দুষ্টচক্রের সমীকরণটা দাঁড়াবে শুন্য দশমিক এক শতাংশ বনাম নিরানব্বই দশমিক নয় শতাংশ (০.১% বনাম ৯৯.৯%)। অর্থাৎ ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে আর্থসামাজিক কাঠামো এমন হবে যেখানে মাত্র ০.১% ধনি মানুষের হাতে যে পরিমাণ সম্পদ থাকবে, তার চেয়ে কম পরিমাণ সম্পদ থাকবে ৯৯,৯% মানুষের কাছে। ধনাঢ্যের দুষ্টচক্র সমাজে ব্যাপক আকারে প্রসারিত হলেও, বিষয়টি নিয়ে যেভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করার বা সমালোচনা হবার কথা, তা হচ্ছে না। দারিদ্রের দুষ্টচক্র নিয়ে যেভাবে আলোচনা হয়েছে, সে তুলনায় ধনাঢ্যের দুষ্টচক্র নিয়ে সেই মাত্রার আলোচনা নেই বললেই চলে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে ধনাঢ্যের দুষ্টচক্র মুলত উন্নত বিশ্বের বিষয়। তাছাড়া যারা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির এই কুফল নিয়ে আলোচনা করবে, তাঁরাও এই দুষ্টচক্রের পকেট বন্দি হয়ে গেছে। তবে অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না। তাই এই অব্যবস্থা এক পর্যায়ে হয়ত বিস্ফোরিত হবে এবং তখন অবস্থা কি দাঁড়াবে, তা কেও বলতে পারবে না। আর সেই সময় পর্যন্ত ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি ধনাঢ্যের দুষ্টচক্রের মধ্যেই আটকে থাকবে।

নিরঞ্জন রায়, CPA, CMA, CAMS
সার্টিফাইড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিষ্ট ও ব্যাংকার।
টরনটো, কানাডা
Nironjankumar_roy@yahoo.com