প্রজ্ঞার আলোকিত ভুবনে সুধীর সাহা

সামিনা চৌধুরী

জীবন মানে অনেকগুলো দিন, মাস আর বছর অতিক্রম করে যাওয়া। এই যাওয়ার পথের গল্পে থাকে দর্শন আর প্রজ্ঞা। প্রতিটি মানুষ যেমন আলাদা, তেমনি আলাদা তাদের জীবনবোধ। সেইজন্যই একজন মানুষের জীবনের গল্প বা দর্শন আরেকজন মানুষকে দিতে পারে অন্য জীবনবোধ, যেখানে এক জীবনে অনেক জীবন যাপন করার আনন্দ থাকলেও যাপিত জীবনের বেদনা থাকে না। সেই আনন্দদান করার জন্য জীবন দর্শনের গল্প যারা করেন, লেখক সুধীর সাহা তাদের একজন। অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার অধিকারী, মেধাবী এবং সংবেদনশীল সুধীর সাহা পাঠকদের জন্য কথার মালায় সাজিয়ে তোলেন তার পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ আর দর্শন। প্রাক্তন চৌকস সেনা কর্মকর্তা লেখক সুধীর বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক, কুটনৈতিক ও দ্বিপাক্ষিক বিষয়াবলি নিপুণ দক্ষতায় কিন্তু সহজ ভাষায় পাঠকের জন্য তুলে ধরেন। সামাজিক পরিবর্তন ও অসংগতিগুলোও তার লেখায় উঠে আসে উপন্যাসের মত। এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৬। এই প্রবন্ধে তার লেখা ‘দায়মুক্তির বাংলাদেশ’, ‘বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস’, ‘ধর্ম উত্থানের ইতিহাস’, এবং ‘কান্না’ গ্রন্থ নিয়ে সামান্য কিছু আলোচনা করা হয়েছে।  

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা রাজনৈতিক ঘটনা, নীতি এবং কার্যাবলী বিশ্লেষণের মাধ্যমে  নির্বাচন, দলীয় রাজনীতি, সরকার গঠন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে মানুষকে সচেতন করেন এবং দলীয় সম্পর্ক, জনমত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট আলোচনার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নীতি পরিবর্তন এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলির পূর্বাভাস দিয়ে থাকেন। কাজেই একজন দক্ষ, নিরপেক্ষ এবং বিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষক দেশের সম্পদ। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ঘোষিত দায়মুক্তি বা ইনডেমনিটি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে ‘দায়মুক্তির বাংলাদেশ’ গ্রন্থে। বংগবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৭২ সালের ৩১ শে জানুয়ারি পর্যন্ত দায়মুক্তি দিয়েছিলেন। এর অর্থ ছিল – ওই সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা সংঘটিত কোনো কাজ অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না। নব্য স্বাধীন দেশে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এ ধরনের ইনডেমনিটির গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও অনেকেই বৈধ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। দায়মুক্তির এই উদাহরণ বাংলাদেশের একটি ধারাবাহিক ঘটনায় পরিণত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের জন্যও দায়মুক্তি দেয়া হয়েছিল। ২০০৪ সালে বিএনপি সরকার ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’-এর জন্য যৌথবাহিনীকে দায়মুক্তি দিয়েছিল। ২০০৯ সাল হাসিনা সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাতাদের দায়মুক্তি দিয়েছিল। এই ধারাবাহিকতায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত কর্মকাণ্ডকেও এক ধরনের দায়মুক্তি দিয়েছে। অথচ এই সময়ে অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে যেমন হত্যা করা হয়েছে, তেমনি ২৪ জন পুলিশ সদস্যও দায়িত্বকালীন সময়ে নিহত হয়েছেন। ছাত্র-জনতার হত্যা বিচারের জন্য অনেকগুলো মামলা করা হলেও দায়মুক্তি দেয়াতে পুলিশহত্যা মামলা হয়নি। লেখকের ভাষায়, “ছাত্রহত্যার বিচার চাই, কিন্তু পুলিশহত্যার দায়মুক্তি চাই” (পৃষ্ঠা ১৫) – বলে ন্যায়বিচার সম্ভব নয়। কাজেই বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে করা এসব দায়মুক্তি ন্যায় বিচার প্রতিহত করছে। জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে লেখক আরো কিছু বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ লিখেছেন এই গ্রন্থটিতে যা পাঠকের সমসাময়িক ভাবনাকে সমৃদ্ধ করবে।  

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রেসিডেন্ট এরশাদ সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়টি বাদ দেন। ২০১৩ সালে সংবিধানে আবারও ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জিয়াউর রহমানের সময়ে রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী বানানো এবং গোলাম আযমকে দেশে প্রবেশাধিকার দিয়ে জামাত-শিবিরের রাজনীতিকে বৈধতা প্রদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদের যে বীজ অংকুরিত হয়েছিল, সেই বীজ ‘সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা কখনো আছে – কখনো নেই’ পরিবেশে ডালপালা ছড়িয়ে এখন বৃক্ষ। বাংলাদেশের অন্তর্বতীকালীন সরকার এই বৃক্ষটি নির্মূল করতে পারবে নাকি এটি একদিন মহীরুহ হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে, সেটাই এখন সমাজ বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণের বিষয়। একইভাবে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ক্রমশ জেগে উঠছে হিন্দুত্ববাদ। সুধীর সাহা লিখেছেন পাঁচশো বছর আগে সম্রাট বাবরের সেনাপতি সত্যিই  হিন্দু মন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কি না তার কোন বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ না মিললেও বাবরি মসজিদ ভেঙে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রাম মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং অসম্পূর্ণ মন্দির উদ্বোধন করেছেন মোদী (পৃষ্ঠা ৬৯)। ধর্ম নিয়ে এই নির্লজ্জ রাজনীতি দেখে সুধীর আরো লিখেছেন, “ধর্ম কোনো রাজনীতির আধার হতে পারে না। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে, ধর্মই রাজনীতি হয়ে যাচ্ছে।“ (পৃষ্ঠা ৭০) শুধু ভারত বাংলাদেশ নয়, ধর্মীয় উগ্রতা পাওয়া যায় আরো বিভিন্ন দেশে। এতে লুন্ঠিত হচ্ছে মানবতা, নষ্ট হচ্ছে সম্প্রতি আর লাভবান হচ্ছে রাজনীতিবিদরা। এসব বিষয়ে  বিস্তারিত আলোচনা করেছেন সুধীর তার ‘দায়মুক্তির বাংলাদেশ’ গ্রন্থে। এই উগ্রতা বিষয়ে তিনি আক্ষেপ  করে আরো লিখেছেন, “সেখানে নেই রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের সম্প্রীতি শিক্ষা, বিবেকানন্দের ভ্রাতৃত্ববোধ, ঠাকুর রামকৃষ্ণের সর্বধর্ম সমন্বয়তা।“ (পৃষ্ঠা ৭২)  

ধর্মীয় উগ্রতা বৃদ্ধি পেলে সংখ্যালঘুদের জীবনে নেমে আসে সংশয়। নিজের দেশেই তারা তখন পরবাসী। প্রতিটা অপ্রাপ্তির কারণ হিসেবে সংখ্যালঘু পরিচয়টি তখন বড় হয়ে ওঠে। বুকে বাসা বাধে অভিমান। এই অনুভূতির গল্প নিয়ে লেখক সুধীর লিখেছেন উপন্যাস ‘কান্না’। উপন্যাসে বাংলাদেশের একটি হিন্দু পরিবারে জন্ম নেয়া এবং বেড়ে ওঠা যুবক অমরের গল্প পাবেন পাঠক। বিত্তবান হিন্দু পরিবারের সন্তান অমরের বাবা দেশ বিভাগের সময় ভারতে পাড়ি না দিয়ে শেকড়ের টানে বাংলাদেশে  রয়ে গিয়েছেন। বাংলাদেশকে অমর নিজের দেশ বলে জেনেছে এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে  অংশ নিয়েছে। মেধাবী অমর স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেও একটি ভালো চাকরি পায় না। এসময়টা ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময়, যখন ইসলামি মৌলবাদ পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চাকরি না পাওয়া অমর নিজের ব্যক্তিগত ও পারিপার্শ্বিক অবস্থাদৃষ্টে দুঃখ ভারাক্লান্ত মনে সংখ্যালঘু হওয়ার যন্ত্রণা অনুভব করে। এক পর্যায়ে দেশ ছেড়ে কানাডায় চলে আসে। কিন্তু এখানেও চাকরি সোনার হরিণ। এখানেও যেন তাড়া করে সেই পুরনো সমস্যা। লেখকের ভাষায়, “একটি পাপ বুঝি ওখানেও আমাকে তারা দিয়ে বেড়াচ্ছে। এখানে কেউ আমাকে চাকরি দিচ্ছে না। থাকো, খাও, স্বাধীনভাবে যা কিছু করো – কিন্তু আমাদের চেয়ারে বসো না। এটা তোমার জন্য নয়।“ (পৃষ্ঠা ৯৫) এই প্রশ্নের উত্তরে লেখক নিজেই লিখেছেন, “ঠিক ওই চেয়ারটি আমার জন্য ছিল না বলেই তো একদিন রাগ করে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে এসেছি।  কিন্তু এখানেও শেষ বেলায় ওই একই অনুভূতি।“ (পৃষ্ঠা ৯৫) 

 রাজনৈতিক অস্থিরতা আর ধর্মীয় উগ্রবাদের সাথে প্রতিযোগিতা করেই যেন বেড়ে যাচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। জীবনানন্দের ভাষায় এ যেন এক অদ্ভুত আধারের সময়। এ সময় যারা অন্ধ, তারাই চোখে দেখছে বেশি। যাদের হৃদয়ে আজো আস্থা আছে মানুষের প্রতি, শকুন আর শেয়ালের খাদ্য যেন আজ তাদের হৃদয়। এখন অন্যায় না করাটাই যেন বোকামি, অন্যায়ের প্রতিবাদ করাটা যেন চরম হাস্যকর।  এখন মানুষ নিজের বিবেক বিসর্জন দিয়ে দুর্নীতি করে। কারো যদি মনে হয় দুর্নীতি করলে আমি অপরাধ বোধে ভুগবো, তাহলে সেই মানুষটি দুর্নীতি করবে না। এই চিন্তাটাই এখন বিরল। সুধীরের ভাষায়, “যদি সবাই দুর্নীতিতে যুক্ত হয়, তাহলে দুর্নীতিটাই ‘আদর্শ আচরণ’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে যায়। সেই দুর্নীতিতে আর অপরাধবোধ থাকে না, কলঙ্কের ভয় থাকে না।“ (পৃষ্ঠা ৭৯) অসংখ্য তথ্যসমৃদ্ধ ‘দায়মুক্তির বাংলাদেশ’ একটি মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল।

বিজ্ঞানীদের হিসেবে পৃথিবীর বয়স ৪.৫ বিলিয়ন বছর হলেও মাত্র ৪৫০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে মানব সভ্যতার ইতিহাস জানা যায়। এসময় গড়ে উঠেছিল সুমেরীয় সভ্যতা। ৩৩০০ খ্রিস্টপূর্বে গড়ে ওঠে মেসোপটেমীয় সভ্যতা এবং সিন্ধু সভ্যতা। তারপর আরো বিভিন্ন সভ্যতার উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে আজকের এই সময়টিতে আমরা এসেছি। এত দীর্ঘ সময়ের ইতিহাস নিয়ে সুধীর লিখেছেন ‘বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস’ গ্রন্থটি। পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে শুরু করে মানুষ নামক প্রাণীর আগমণ এবং ধীরে ধীরে সভ্যতার ও ইতিহাসের বিবরণ দিয়ে তিনি বইটি শুরু করেছেন। তারপর ক্রমশ উপস্থাপন করেছেন সুমেরুয়ীয় সভ্যতা, মেসোপটেমীয় সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতা, চীনা সভ্যতাসহ গ্রীক, রোমান, আফ্রিকা, ও আমেরিকার প্রধান প্রধান সভ্যতার উত্থান ও ইতিহাস। প্রাচীনকালে সভ্যতাগুলোর টিকে থাকা এবং বিস্তারে শাসকদের বিরাট ভূমিকা ছিল। তাই তিনি সিন্ধু সভ্যতা আলোচনা করার সময় ক্রমানুযায়ী মোগল শাসকদের ভারত শাসন এবং পরবর্তীকালে ইংরেজ শাসনের সূচনাকাল পর্যন্ত আলোচনা করেছেন। একইভাবে সুমেরুয়ীয় ও মেসোপটেমীয় সভ্যতার উন্মেষকাল থেকে অটোম্যান শাসনের সময় পর্যন্ত তুলে ধরেছেন। একইভাবে কীভাবে কোরিয়া এবং জাপানে চিনা সভ্যতা বিস্তার লাভ করেছিল সে বিষয়েও আলোচনা করেছেন।  গ্রিক এবং রোমান সভ্যতা আলোচনার সময় লেখক দেখিয়েছেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, জুলিয়াস সিজার, অগাস্টাসসহ আরো অনেক শাসকের অবদান। গ্রন্থটি থেকে ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলিম সভ্যতার ইতিহাস ও বিস্তার সম্পর্কেও জানা যাবে। পাঠক জানতে পারবেন প্রাচীন আমেরিকায় গড়ে ওঠা অলমেক ও জাপটেক সভ্যতার শেষে মেক্সিকোতে গড়ে ওঠা মায়া সভ্যতার কথা। এছাড়া উত্তর মেরু ও কানাডার শীতল অঞ্চলে বাস করা এস্কিমোদের  শিকারভিত্তিক সভ্যতার কথাও পাঠক জানতে পারবেন। সভ্যতার এই দীর্ঘ ইতিহাসের তথ্যাবলী একটি বইয়ে থাকায় পাঠক কম সময়ের মধ্যে অনেক তথ্য জানতে পারবেন।

কথায় বলে ধর্মের কারণে যত মানুষ প্রাণ দিয়েছে, অন্য কোনো কারণে পৃথিবীতে তত প্রাণ নষ্ট হয়নি। সেই প্রাচীন কাল থেকেই ধর্মীয় হানাহানি মানুষের মাঝে লেগেই আছে। কেবল আমার ধর্মটাই সঠিক, অন্যসকল ধর্ম ভুল – এই যুক্তটি প্রমাণের জন্য সহিষ্ণুতার সীমা পেরিয়ে লড়াই জড়িয়ে পড়ে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব, মোল্লা-পুরুত সকলেই। এই লড়াইয়ের উত্তর দিতে গিয়ে সুধীর সাহা লিখেছেন ‘ধর্ম উত্থানের ইতিহাস’ নামে একটি গ্রন্থ। এই গ্রন্থে তিনি ১৩.৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে পৃথিবী নামক গ্রহের গঠন এবং তারপর হোমো হেবিলিস থেকে হোমো স্যাপিয়েন্স নামক মানুষের আগমন থেকে শুরু করে ১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন ধর্মের ক্রমবিকাশকে তুলে ধরেছেন। প্রকৃতপক্ষে যখন থেকে মানুষের ইতিহাস শুরু, ধর্মের ইতিহাসও ততটাই পুরানো। গ্রন্থটিতে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে প্রাচীন মিশরীয়দের ধর্মের  (পলিথিয়াস্টিক) উৎপত্তি ও চর্চা, সিন্ধু বা ইন্দাস সভ্যতার সময়ে হিন্দু ধর্মের উত্থান ও চর্চা, হিন্দু ধর্ম থেকে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের বিকাশ, চিনে কনফুসিয়াজম এবং সিন্টো মতবাদের প্রতিষ্ঠা এবং বৌদ্ধ ধর্মের অনুপ্রবেশ, দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের গড়ে ওঠা গ্রিক সভ্যতার সঙ্গে প্রাচীন গ্রিক ধর্মের প্রতিষ্ঠা, ভূমধ্যসাগরের পূর্বতীরে ইহুদী, খ্রিস্টান, মুসলিম ধর্মের উত্থান, প্রচার এবং প্রসার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রাচীনকালে ধর্মের প্রসারের সাথে যুদ্ধজয়ের সম্পর্ক ছিল বিধায় গ্রন্থটিতে সুধীর ধর্মযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করেছেন। জেরুজালেমের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা কেন্দ্র করে ইউরোপের খ্রিস্টান ও প্রাচ্যের মুসলমানদের মধ্যে ১০৯৫ সাল থেকে ১২৯১ সাল পর্যন্ত নয়টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যেগুলোকে ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড নামে আখ্যায়িত করা হয়। পোপ দ্বিতীয় উবার্নের আহবানে আনাতোলিয়াতে ইসলাম ধর্মাবলম্বী সেলজুক সাম্রাজ্যের বিস্তার রোধ করার জন্য অর্থডক্স খ্রিস্টান বাইজেনটাইন সম্রাট এই যুদ্ধ প্রথম ঘোষণা করেন। ধর্ম প্রচারের ক্রমবিকাশ লক্ষ করা যায় ভারতবর্ষে গৌতম বুদ্ধের উদ্ভাবিত বৌদ্ধ ধর্ম ধীরে ধীরে চিন এবং জাপানে প্রচারিতও হয়েছিল। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের ইসলাম ধর্ম মোঘল সাম্রাজ্য প্রসারের মাধ্যমে ভারত বর্ষে প্রচারিত হয়েছিল। এই বিষয়েগুলোও সুধীর ‘ধর্ম উত্থানের  ইতিহাস’ বইটিতে বিস্তারিত লিখেছেন যা পাঠককে ঋদ্ধ করবে বলেই লেখক মনে করেন।

মানুষ তার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কিছু একটা করে যেতে চায়; রেখে যেতে চায় তার জ্ঞান; রেখে যেতে চায় তার সম্পদ; রেখে যেতে চায় তার ভালোবাসা; যাতে পরবর্তী প্রজন্মের জীবন সুন্দরতর হয়ে ওঠে। এভাবেই ধীরে ধীরে মানুষ সভ্যতার এক স্তর পেরিয়ে অন্য স্তরে উন্নীত হয়। মানুষের অনন্য এই গুণ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কেবলমাত্র মানুষেরই আছে আর সেজন্যই মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। লেখক সুধীর সাহা তার গ্রন্থগুলোতে পরম মমতায় লিখেছেন তার অভিজ্ঞতা পরম মমতায় লিখেছেন তার অভিজ্ঞতা, তার জ্ঞান, তার প্রজ্ঞা, তার দর্শন যা পাঠককে আনন্দ দেবে, দেবে দূরদৃষ্টি, দেবে আরেকটি জ্ঞানের ভুবন। সুধীর সাহাকে তার প্রকাশনাগুলির জন্য শুভকামনা জানাই।