প্রবাসী বাংলাদেশিদের চোখে কানাডা
নারগিস দোজা
আজ বহুবছর কানাডাতে আছি। কানাডা দেশটি আর্থ-সামাজিক ডেমোগ্রাফিতে সবসময়ই উপরের দিকে অবস্থান করে। তার কারণ তারা মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু নেই এ কথায় বিশ্বাস রাখে। বাংলাদেশে বাংলাভাষায় সাহিত্যচর্চা যারা করেন তাদের অনেকের বই আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। আধফরচুনেটলি যারা কানাডায় বসে মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা করছেন সেইসব বাংলাদেশী কানাডিয়ান লেখকদের লেখা আমার পড়া হয়নি তেমন। এটা আমারই ব্যর্থতা। আমি কৃতজ্ঞ সুব্রত কুমার দাসের কাছে কারণ তিনি আমায় তাদের লেখা পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।
আচ্ছা কানাডা সম্পর্কে আমরা জানতে কতোটুকু আগ্রহী! আমরা যারা কানাডা আছি বহুবছর ধরে কতোটুকু জানি এই দেশটা সম্পর্কে? কানাডা একসময় ব্রিটিশদের কলোনী ছিল। ব্রিটিশ ডোমেইনের অন্তর্গত একটি দেশ। ১৮৬৭ সালে কয়েকটি প্রদেশ নিয়ে কানাডা নামক একটি ফেডারেশনের জন্ম হয় এইতো। হেড অফ দা স্টেট হচ্ছেন বৃটেনের রাজা। কিন্তু কানাডা তো এটুকুই নয়। এর থেকেও অনেক বেশি কিছু। আর এটা জানতে সাহায্য করবে বইটিতে অসীম ভৌমিকের লেখা কানাডার আদ্যন্ত প্রবন্ধটি। উত্তর আমেরিকা তথা কানাডায় মানুষের পর্দাপণ হাজার হাজার বছর আগে আর সেই ইতিহাসের খুটিনাটি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। বরফ যুগে জমে যাওয়া বেরিং সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আসা আদিবাসীরা ভূখন্ডটিতে প্রথম পদার্পন করে। যাদের আমরা ইনুইত বলে জানি। এদের ডিএনএতে পাওয়া গেছে এশিয়ান জিন।
লেখিকা মম কাজি তার লেখায় তুলে এনেছেন সৌন্দর্যের দেশ কানাডার সৌন্দর্যের বর্ণনা তার প্রবন্ধটিতে। অসম্ভব সুন্দর দেশটির সৌন্দর্যের নানাঝলক পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। কানাডা যেমন শরতে সুন্দর তেমনই সুন্দর তার শীতকালীন সৌন্দর্য। আর এই সৌন্দর্য তার মাল্টিকালচারিজমেও দেখা যায় প্রস্ফুটিত।
বইটিতে কাজী হেলালের লেখা কানাডার আদিবাসী জনগণ: সত্য উদঘাটন ও পুনর্মিলন প্রবন্ধটি কানাডার একটি কালো অধ্যায় উন্মোচন করেছে আমাদের কাছে। বৃটিশ অধিকৃত কানাডার আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে নিমূল করার জন্য তারা কিছু পদক্ষেপ নেয়। তাদের প্রতিষ্ঠা করা আদিবাসী শিশুদের জন্য রেসিডেন্সিয়াল স্কুল তার একটি। যেখানে আদিবাসী শিশুদের পরিবারের কাছ থেকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে এনে রাখা হতো। তাদের খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করা হতো। আর এর ফলশ্রুতিতে অসংখ্য আদিবাসী শিশু মৃত্যুবরণ করে। লেখক কাজী হেলালের প্রবন্ধটি পাঠককে সেই কালো অধ্যায় সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে।
একটি দেশ কতোটা উন্নত এবং সাকসেকফুল তা বলে দেয় সে দেশের নারীদের অধিকার রক্ষাব্যবস্থা। কানাডায় নারীদের অধিকার কতোটুকু সংরক্ষিত তা নিয়ে লিখেছেন লেখিকা প্রতিমা সরকার। তার প্রবন্ধটি তুলে ধরা হয়েছে এই দিকটা। কানাডা একটি নারীবান্ধব রাষ্ট্র। সরকার মহিলাদের সর্বোতভাবে সাহায্য করে। কানাডিয়ান চার্টার অব রাইটস এন্ড ফ্রিডমস যেটাকে কানাডার সংবিধানও বলা যায় সেখানে প্রতিটা নারীকে সুরক্ষা দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নারীর উপর নির্যাতনকে একটি বড়ো ক্রাইম হিসাবে গন্য করা হয়। সাম্প্রতিককালে কানাডা সরকার তার অভিবাসী আইন কিছুটা শিথিল করে। এর সুযোগ নিয়ে বিদেশ থেকে প্রচুর মানুষ লিগাল ইলিগাল উপায়ে দেশটিতে প্রবেশ করে। ভিজিট ভিসায় এসে রিফুজী ক্লেইম করা একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে যায়। আর এর ফলে দেশের ইকোনমি আর আবাসন ব্যবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি হয়ে যায়। সোসাল সার্ভিসের উপর চাপ তৈরি হয়ে যায়। স্বাস্থ্যখাত দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই সাথে বিদেশ থেকে আসা লোকজনও সমস্যায় পড়ে যায়। বিশেষ করে ভিজিট ভিসায় আসা মানুষজন। তাদের ওয়ার্কপারমিট না থাকায় ক্যাশে নামমাত্র বেতনে কাজ নিতে হয়। এই পরিস্থিতি নিয়ে লেখক স্বপন কুমার দেব বিশ্লেষণধর্মী একটি প্রবন্ধ লিখেছেন বইটিতে।
বইটিতে তাসমিনা খানের লেখা জটিল একটি বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ আছে। তিনি ট্রান্সজেন্ডারের মনন নিয়ে অনেক দামী একটি রচনা লিখেছেন।
কানাডা সরকার নারীবান্ধবের মতো শিশুবান্ধবও। একটি শিশুর জন্মের পর তার বেড়ে ওঠা, তার শিক্ষা নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। সরকারের প্রণীত শিক্ষার ক্যারিকুলাম তাদের মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। কানাডার শিক্ষা টুয়েলভ গ্রেড পর্যন্ত ফ্রি। পড়াশোনা দুটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। এলিমেন্টারী এবং হাইস্কুল। কেজি থেকে অষ্টম শ্রেণিকে এলিমেন্টারি লেবেল এবং নাইন থেকে দ্বাদশ শ্রেণিকে হাইস্কুল উল্লেখ করা হয়। এই বয়স থেকেই তাদের মাল্টিকালচারিজমের ধারণা দেয়া হয়। এই নিয়ে লেখক মানসী সাহার একটা চমৎকার প্রবন্ধ আছে। প্রবন্ধটি নিউ কামারদের কানাডায় শিশুদের কীভাবে শিক্ষা দেয়া হয় তার একটা ধারণা দেবে। বাংলাদেশের কালচার আর কানাডার কালচার এক নয়। কালচারাল শক থেকে বাবা-মাদের প্রবন্ধটি সাহায্য করতে পারবে।
কানাডায় একজন মানুষের নাগরিক অধিকার তার হিউম্যান রাইটসের অন্তর্গত। দেশের একজন নাগরিক ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের দেয়া অধিকার সমানভাবে ভোগ করবে। তার জেন্ডার কিংবা সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন এখানে বাধা হতে পারবে না। কানাডার চার্টার অন রাইটস এন্ড ফ্রিডমস তাকে এই অধিকার দিয়েছে। লেখক চয়ন দাসের প্রবন্ধটি সবার জন্য অবশ্য পাঠ্য আমাদের অধিকারসমূহ সম্পর্কে ধারণা রাখার জন্যে। কানাডার কৃষি ও মৎস্য-শিল্প দেশটির খাবারদাবারের চাহিদার মোটামুটি একটা অংশ পূরণ করতে পারে। উত্তর গোলার্ধের দেশ হওয়ায় কানাডাকে হার্স উইন্টার ফেস করতে হয় তারপরও গম ভুট্টা ডাল নানা তেল উৎপাদনকারি শষ্য উৎপাদন হয় এখানে। বড়োবড়ো অর্চাডে প্রচুল ফল পাকড় হয়। অটাম সামার আর স্প্রীং উৎপাদন সিজেন। এইসব জিনিসের উৎপাদন বন্টন ও উপভোগ নিয়ে জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিনের চমৎকার একটি প্রবন্ধ বইটিতে আছে। যারা শখের বসে টুকটাক গাছপালা করে তারাও হেল্প পাবেন প্রবন্ধটি থেকে। কানাডার শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ড. ঝর্ণা চ্যাটার্জি একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেখানে লেখার রসদ তিনি সংগ্রহ করেছেন নিজের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণকারী সন্তানদের লেখাপড়া করা থেকে। তার প্রবন্ধ থেকে আমরা জানতে পারি অন্টারিও, মানিতোবা এবং নিউব্রান্সউইকে বয়স আঠারো বছর না হওয়া পর্যন্ত স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক। ব্যপারটা আমার জানা ছিল না। স্কুল লেবেলে এখানে দুই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে – পাবলিক এবং ক্যাথোলিক। এছাড়া প্রাইভেট স্কুলও আছে। কমুনিটি কলেজ এবং ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া এবং বয়স্ক শিক্ষা সম্পর্কেও প্রবন্ধতে উল্লেখ করা হয়েছে।
কানাডার শিল্পী এবং শিল্পকর্ম নিয়ে একটি মুল্যবান লেখা রয়েছে এখানে। তিনি যেমন মেটিস শিল্পের উল্লেখ করেছেন তেমন শিল্পে ইউরোপীয় প্রভাবের কথাও উল্লেখ করেছেন। প্রবন্ধটির উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে একদল কানাডিয়ান শিল্পীর কথা উল্লেখ – যাদের গ্রুপ অফ সেভেন বলা হয়। এই প্রবন্ধ লেখার জন্য দেবাঞ্জনা মুখার্জি ভৌমিককে ধন্যবাদ। এছাড়াও সমসাময়িক শিল্পীদের কথাও বলা হয়েছে এখানে।
কানাডার গণমাধ্যম নিয়ে বইতে আলোকপাত করেছেন সাংবাদিক মাহবুব ওসমানী। কানাডার গনমাধ্যমকে সেন্সরহীন স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে নিউজ সেকটর – ডিজিটাল এবং প্রিন্টিং মিডিয়ায় যথেষ্ঠ স্বাধীনতা ভোগ করে। লেখক কানাডিয়ান অনুষ্ঠানগুলোর মাঝে আমেরিকার প্রভাব থাকার কথা বলেছেন। কানাডায় সরকারিভাবে চালিত একটি অ্যবরিজিন চ্যানেলও আছে।
কানাডীয় সাহিত্য বা ক্যানলিট সম্পর্কে একটা চমৎকার প্রবন্ধ আছে সম্পাদক সুব্রত কুমার দাসের। কানাডীয়ান সাহিত্য এবং সাহিত্যিক নিয়ে তার জ্ঞানের পরিধি অসীম। তিনি এই দিকটা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করেছেন। কানাডীয়ান লেখকদের নিয়ে ওর লেখা বই পড়লেই ব্যাপারটা বোঝা যায়।
এছাড়া বইতে কানাডার ফুল, ফুল উৎসব, সাহিত্য উৎসব, মৃত্যু পরবর্তী ক্রিয়াদি নিয়েও লেখা রয়েছে। সামিনা চৌধুরী, রোকসানা পারভীন শিমুল, শ্রেয়সী বোস দত্ত, সুজিত কুসুম পালের লেখা পুরো গ্রন্থটিকে অধিকতর মূল্যবান করে তুলেছে। এর বাইরেও অতনু দাশ গুপ্ত, ড. জান্নাতুল নাইম, ড. দিলীপ চক্রবর্তী, দেবাঞ্জনা মুখার্জি ভৌমিক, ননীগোপাল দেবনাথ, পূর্বাশা চৌধুরী, মনীষ পাল, রতন সাহা, রেশমা মজুমদার শম্পা, রোকসানা লেইস, শাহানা আকতার মহুয়া, শেখর ই গোমেজ, সুশীল কুমার পোদ্দার, সোনালী রায় লিখেছেন বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে।
কানাডা : বিবিধ প্রসঙ্গ বইটিতে স্থান পাওয়া প্রতিটা প্রবন্ধ আমায় কানাডাকে নুতন আলোয় দেখতে সাহায্য করেছে। আমার কাছে বইটিকে কানাডা-বিষয়ক একটি ছোটখাট এনসাইক্লোপিডিয়া মনে হয়েছে। কিছু জানতে ইচ্ছে করলে চট করে বইটি হাতে তুলে নিলেই হবে। আমার বিশ্বাস বইটি পাঠককে কানাডাকে জানতে সাহায্য করবে।
কানাডা : বিবিধ প্রসঙ্গ বইটাকে কানাডা প্রবাসীদের মনের আয়না বলা যায়। কানাডা তাদের মনে যেসব ব্যপারে দাগ কেটেছে তারা সেগুলোই তাদের প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন। কানাডায় যারা নুতন আসবেন তাদের জন্য ‘মাস্ট রিড’ বুক এটা। তাদেরকে কানাডা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা দেবে বইটা। এছাড়াও কানাডা -প্রবাসী বাংলাদেশীরাও বইটা পড়তে পারেন। যে দেশে থাকি সে দেশের আদ্যপন্ত জানাটাও জরুরী, তাই না! বইটার বহুল পাঠক প্রিয়তা কামনা করছি।
সম্পাদক সুব্রত কুমার দাস টরন্টো এবং অন্টারিওর বিভিন্ন শহর যেমন অটোয়া, কিংস্টন, ওয়াটারলু জুড়ে ছড়িয়ে থাকা লেখকদের লেখা সংগ্রহ করেই ক্ষান্ত দেন নাই, সুদূর পূর্বের হ্যালিফ্যাক্স এবং পশ্চিমের ভ্যাঙ্কুভার শহরের লেখকদেরকেও যুক্ত করেছেন এই সংকলনে। আর এভাবেই কানাডা : বিবিধ প্রসঙ্গ বইটি হয়ে উঠেছে কানাডা-বিষয়ে আগ্রহী সকল বাঙালির জন্য একটি মূল্যবান পাঠ।
কানাডা : বিবিধ প্রসঙ্গ
সম্পাদক : সুব্রত কুমার দাস
প্রকাশক: বেহুলা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
জনরা: প্রবন্ধ সংকলণ