ফ্রেমে-আঁটা ভালোবাসার আল্পনা

তসলিমা হাসান

চলার পথে এমন কিছু সময় এমন কিছু দিন আসে, যাকে অন্য সময়গুলোর সাথে তুলনা করলে পরিষ্কারভাবে আলাদা দেখায়। বিদ্বৎজনের সান্নিধ্যে এই ভিন্ন দিন বা সময়গুলো ভালোবাসায়, আনন্দে আর চমৎকারিত্বে প্রভা বিকিরণ করতে থাকে মনের ভেতরে। গত তিনদিন ধরে এমনই এক আলোকশিখার তাপ আর উত্তাপ বুকের ভেতর জমে আছে যেন!

বলছি গত ৩ এপ্রিলের কথা। ঘুম থেকে উঠে দেখি সকালের এক চিলতে সোনারোদ আমার জানালা গলিয়ে লেখার টেবিল ছুঁয়ে আছে। যেন ডাকছে আমায় কথা বলার জন্য। আমার মন দুলছিল আনন্দে-শিহরণে। সোনালি আভা মেখে নিয়ে নর্তকী মুদ্রায় যেন নেচে উঠেছিল আমার সকালবেলার মুহূর্তগুলো। প্রিয় সুজিত-মনি দম্পতির দুপুরের নেমন্তন্নের কথা মনে পড়লো। এই আনন্দ, এই আহ্বান কি তাহলে ওদের বাড়িতে যাবো বলে!

সুজিত ও মনি পাল যে আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত, তা কিন্তু নয়। গত ফেব্রুয়ারিতে টরন্টোর সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বাংলা মেইল’-এর ব্যবস্থাপনায় আমরা যোগ দিয়েছিলাম মন্ট্রিয়ল বইমেলায়। সেই ট্যুরে নয় সদস্যের মধ্যে ওরাও ছিলেন। আমার সৌভাগ্য যে এতোসব গুণীজনের সাথে মন্ট্রিয়ল বইমেলায় আমিও উপস্থিত থাকতে পেরেছিলাম। আমি তো ভেবেছিলাম শরীর খারাপ নিয়ে না গেলেই ভালো। কিন্তু আমার প্রিয় সুব্রতদা আর নীলিমার এতো ভালোবাসা-পূর্ণ অনুরোধে না করতে পারিনি। আর ‘বাংলা মেইল’ ও এনআরবির টিভির কর্ণধার শহিদুল ইসলাম মিন্টু, যাকে আমার ছোটভাই বলে হৃদয়ের গহীনে মমতা-আদর ও ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখি, তার তাগাদা তো ছিলই। আমি ওর পত্রিকায় দীর্ঘদিন ধরে লেখালিখি করছি; তাই এই টিমের সদস্য হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। মিন্টুর মহানুভবতায় সত্যি আমি আনন্দিত ও আপ্লুত।

এক ফ্রেমে সবাই। আমাদের লেখালিখির সংসার। 

আমার স্বামী কবি ইকবাল হাসান জীবিত থাকতে প্রতিবার ওই বইমেলায় অংশগ্রহণ করতো। আমি কখনও কখনও ওর সাথে মেলায় গিয়েছি। অনেকবার ওর সাথে নিউইয়র্ক-এর বইমেলায়ও গিয়েছি; ডক্টর পূরবী দিদি ও জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত দাদার বাসায় থেকেছি। সারারাত আড্ডায় তারা মেতে থাকতেন। অনেক কবি-সাহিত্যিক ওখানে এসে আড্ডা দিতেন। তখন আমার বয়স অনেক কম ছিল। আমি খুব অবাক হয়ে তাদের কথা শুনতাম। কতো বিচিত্র বিষয়ে যে আড্ডা ভরে উঠতো, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা করা যেত না। আমি উপভোগ করেছি তাদের মূল্যবান কথোপকথন।

এবারের মন্ট্রিয়ল সফর আমার জীবনে আরেক নতুন অধ্যায়। যদিও হঠাৎ হঠাৎ বুকের ভেতরে একাকিত্বের হাহাকার বেজে উঠছিল; মন নামক এক যন্ত্রদানব স্টেনগানের গুলির মতো আওয়াজ ছুড়ছিল! কিন্তু আমার সেই কষ্ট মুহূর্তে বিলীন হতে পেরেছে টিমমেট তাসমিনা খানের অকৃত্রিম ভালোবাসায়। রাত নেমে এলে আবার যখন আমার মন ভারী হয়ে উঠছিল, কী জানি কী টের পেয়ে সহযাত্রীরা আমার নিঃসঙ্গতাকে দূর করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

রাতে আমাকে একা একরুমে থাকতে দেয়নি, যদিও সবার রুম আলাদা ছিল; সুব্রতদা, সুজিতদা তাদের প্রিয় জীবনসাথী নীলিমা আর মনিকে আমার সাথে রাতে থাকতে বললেন। বন্ধুদের এই সহমর্মিতা ও আন্তরিকতা আমাকে সারাজীবনের জন্য কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছে। রাত কাটিয়েছি এক বিছানায় তিনজন। কিন্তু আমার চোখে এক বর্ষার জল নিয়ে বিনিদ্র রজনী দীর্ঘায়িত হলো! সাথে অবশ্য যুক্ত হলো ভালোবাসার একসমুদ্র জল। এমন মমতা কতোদিন পাইনি আমি।

সর্ববামে শিপ্রা বৌদি। সবচেয়ে বেশি সার্টিফিকেটের অধিকারি। এমএ, বিএড, এম ফিল, পিএইচডি। সর্ডানে সুজিতদা। বিনয়ের অবতার। 

পরদিন বিকেলে আমরা একসাথে দলবেঁধে বইমেলায় ঘুরেছি, অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি। মেলার ব্যাপকতা ও বৈচিত্র্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। দূর প্রবাসে বাঙালি লেখক-প্রকাশক-সম্পাদক-পাঠকের এই মহামিলন কানাডার বহু-সংস্কৃতির প্রবাহে বহমান¯স্রোতধারার মতো। বাঙালির পাশাপাশি অবাঙালিও যোগ দিয়েছেন এই সংস্কৃতির মেলায়। আয়োজকদের দেওয়া সম্মান ও সম্মাননা ছিল অকৃত্রিমতায় পরিপূর্ণ। সেদিনের মন্ট্রিয়ল-অভিযাত্রা আমাদেরকে এক সুতোয় বেঁধে দিয়েছিল। আমরা কয়েকজন, কয়েক পরিবার মিলে যেন এক পরিবার হয়ে উঠলাম।

মন্ট্রিয়ল টিমের সেই সদস্যদের মিলনমেলা বসছে সুজিত-মনির বাসায়। এটি একটি চক্রাকার আড্ডার ধারাবাহিকতাও বটে। এর সূচনা হয়েছিল একটি ইফতার পার্টি আয়োজনের মধ্য দিয়ে। এবার হলো তার বর্ধিত সম্মেলন। যেন এক নির্মল পরিভ্রমণ। তো, যাবার সময় জাকারিয়া ভাই ও মিতার আন্তরিক আলাপ আর মজার মজার গান-গল্প শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল সকালের রোদগুলো কেমন ঝলমল করে উঠছে!

ড. দিলীপ চক্রবর্তী ও আকবর হোসেন। হাস্যরস আর জ্ঞানগম্যির ভাণ্ডার। 

মাঝ-দুপুরে আমরা হাজির হলাম সুজিত-মনির বাসায়। দারুণ সব মজাদার খাবারের আয়োজন ছিল। ঝাল-মিষ্টির মহা-সমারোহ। স্নাকস আর লাঞ্চের সু-ব্যবস্থা। নিজের হাতে চমৎকার রান্না করেছিলেন মনি পাল। এতো রকম মিষ্টির আয়োজন সত্যি অবাক করার মতো ছিল। আর সুজিত দাদার আপ্যায়ন-আদর ছিল অভিবাদনের সুরে ভরা। চয়ন দাদা এবং তাসমিনার অসাধারণ ও মন-কাড়া গান জমায়েতের সবাইকে মুগ্ধ করেছে। জানা গেল চয়নদার সুন্দরী সহধর্মিনী লিপিকাও না-কি ভালো গান করেন; কিন্তু সময়ের অভাবে তার গান এ যাত্রায় শোনা হলো না এবার।

আকবর ভাই মজার মজার গল্প আর শ্রুতিমধুর বক্তব্য দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তার মিতভাষী-মার্জিত সঙ্গিনী হাসু ভাবী আমাদের মিলনমেলাকে প্রাণবন্ত ও সমৃদ্ধ করেছেন নীরবে-নিভৃতে; যেমন প্রকৃতি তার সৌন্দর্য ছড়িয়ে রাখে আপন সৌরভে। দিলীপ দাদার আবৃত্তি সত্যি চমৎকার; নজরুলের দীর্ঘ কবিতা তিনি অনর্গল আওড়ে গেলেন পেশাদার বাচিকশিল্পীর মতো। তিনি আরেকভাবে এই আড্ডাকে উজ্জ্বল করেছেন; উপস্থিত সবাইকে নিয়ে বক্তব্য পরিবেশনের ছলে মূলত কবিতার ছন্দে ছন্দে ইংরেজি ভাষায় ব্যক্তি-বর্ণনা করেছেন; এই বিবরণ-কবিতাটি ছিল আবেগ-ভালোবাসা আর নির্মল-অনুভবের নান্দনিক প্রকাশ। তাঁর তাৎক্ষণিক কবি-প্রতিভা, বাকশৈলী পাণ্ডিত্য আর ব্যক্তিত্ব উপচে পড়েছে মুহূর্তে মুহূর্তে। সারা বাড়িটি যেন আলোয় আলোয় ভরে উঠেছিল সেদিন, সত্যি সত্যি। জাকারিয়া ভাই মাঝে-মধ্যে যোগ করছিলেন আনন্দের রসদ; তাঁর গপ-সপের মাধুরী কেবল অনন্য নয়, প্রভাব-বিস্তারিও। কথা ও খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মিতার সাথে তাঁর খুনসুটি, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে-পড়া হৃদয়ের উত্তাপ সভার কারো নজর এড়াতে পারেনি।

মনি বৌদি আর নীলিমার সাথে আমাদের সেলফি।  

মিন্টুর উপস্থিতি বরাবরের মতোই আমাদের আড্ডায় প্রাণ সঞ্চার করেছে। সুব্রত কুমার দাস ও নীলিমা দত্ত দম্পতি সংযোগ-সুতো হিশেবে সক্রিয় ছিল পুরো আয়োজন জুড়ে। আমাদের মন্ট্রিয়ল বইমেলার সফরসঙ্গীদের এই মিলন-আড্ডায় বাড়তি শোভা নিয়ে হাজির ছিল তাসমিনার ছোট্ট দুটি মেয়ে; যেন গ্রীষ্মের দুপুরেও শীতের সকালে পদ্মপাতার শিশির বিন্দু। ড. দিলীপ চক্রবর্তী ও ড. শিপ্রা চক্রবর্তীর (অধ্যাপক দম্পতি) কন্যা পারমিতা ও জামাতা বিশ্বজিৎও এই চাঁদের হাটে জোছনা বিলিয়েছে অপার। শিপ্রাদি কী সাধারণ; উচ্চশিক্ষা ও জ্ঞানের আলোয় কী বিনত মানুষ তিনি – যেন ফলের ভারে নত কোনো বৃক্ষরাজি। সুজিত-মনির মেয়ে ও জামাতা আমাদের মিলনমেলায় অক্সিজেন বিলিয়েছে, যেমন ফুলের পাশে থাকে থরে-থরে সবুজপাতারা। কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো টরন্টো শহরে, এতো আনন্দে তা খেয়াল করার অবসরই পাইনি। বাড়ি ফিরে ঘুমের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মুহূর্তেও রয়ে গিয়েছিল সারাদিনের আনন্দ-আবেশ।

কী অদ্ভুত মায়ার টানে আমরা একে অপরের ভালোবাসায় বেঁচে থাকি; জীবনের যাবতীয় পূর্ণিমা ও আলো-আঁধারির মাঝে এই বিচরণ যেন এক অমোঘতা! জীবনে এইসব ভালোবাসা, এইসব আলোকিত মানুষের আনাগোনা ও সঙ্গ কতো যে প্রয়োজন, তা টের পেলাম আরও একবার। আনন্দ ও মিলনমেলা জীবনের পূর্ণতার এক একটি পাপড়ি যেন!

অনেক অনেক ধন্যবাদ সুজিত কুসুম পাল আর মনি পালকে এতো সুন্দর আয়োজন ও আপ্যায়ন করার জন্য। এমন দিন আবার আসুক নেমে আমার ভোরবেলার লেখার টেবিলে। আবার ভরে উঠুক কোনো এক দিন এমন জ্ঞানের আর গানের গল্পকথায়!