বিদ্রোহী কবি নজরুল: এক বিরল প্রতিভা
সময়ের হিসাবে আধুনিক বাংলা কবিতা বিশ্বযুদ্ধোত্তর এবং ভাবের দিক থেকে তা রবীন্দ্র-বিরোধী। যে ক’জন কবি সাহিত্যিক আধুনিক কবিতার ধ্বজা বহন করেছিলেন কাজী নজরুল তাদের অন্যতম। বাকিদের মধ্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, গোলাম কুদ্দুস, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু এবং আরও অনেকে। নজরুল ইসলামকে সম্যক রূপে বুঝতে হলে সেই সময়কার সাহিত্যিক সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে ধারণা থাকা সহায়ক হবে।
আক্ষরিক অর্থে রবীন্দ্রনাথের কোন ধর্মীয় গোড়ামী ছিল না। তিনি যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন। তিনি হিন্দু ধর্মের মূল সুর নিজ অন্তরে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। যদিও তিনি আজীবন ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ছিলেন। ব্রাহ্ম ধর্ম এক উদারবাদী দর্শন, যা হিন্দু ধর্মের মধ্যে যুগ-ব্যাপ্ত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জ্বলন্ত প্রতিবাদ ছিল। কিন্তু হিন্দুধর্মের সমস্ত সদগুণ ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ হওয়া সত্বেও তার উদার মনোভাবের জন্য অন্য কোন ধর্মের বিরোধী ছিলেন না। তিনি আক্ষরিক অর্থেই যুগোত্তর এবং কালোত্তর ছিলেন । তিনি সার্থক-নামা বিশ্বকবি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে নজরুল নিজে ‘সাহিত্যগুরু’ মানতেন, যদিও অনেক বিষয়েই তিনি রবীন্দ্রনাথকে অন্ধ অনুকরণ করতেন না। এবং প্রায়সই তাঁরা ভিন্নমত গ্রহণে সহমত হতেন।
কাজী নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে। আকাশে সূর্যের প্রবল উপস্থিতি যেমন আকাশের অন্যান্য তারাদের নিষ্প্রভ করে দেয় সেই রকম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের বাংলার সাহিত্যাকাশের অনেক কবি সাহিত্যিককে ম্রিয়মাণ করে দিয়েছিলেন। এমনকি তাদেরও যারা রবীন্দ্র-বিরোধিতা দিয়ে নিজেদের সাহিত্য জীবন শুরু করেছিলেন। রবীন্দ্র-বিরোধীদের অনেকেই পুরোপুরি রবীন্দ্রনাথ প্রভাবমুক্ত হতে পারেননি। একমাত্র ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুল সিদ্ধ করেছেন যে অন্য কারো সাহিত্যের অনুরাগী হওয়ার জন্য নিজের সাহিত্য সত্তাকে বিসর্জন দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।
কাজী নজরুল সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করতেন । তিনি আজীবন প্রয়াস করেছেন যে নিজ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সেবার কথার জন্যই না , জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত লাঞ্ছিত নিপীড়িত শোষিত জনগণের কল্যাণ সাধনের জন্য। কীভাবে নজরুল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু করেছিলেন সেটা বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে যদি আমরা সেই সময়কার বাংলার সাম্প্রদায়িক সমস্যার পর্যালোচনা করি। সেই সময়কার বহুল প্রচারিত হিন্দু-মুসলিম অনৈক্য খুবই অগভীর ছিল। যার কৃতিত্ব সেই সময়কার অসাম্প্রদায়িক বাঙালি রাজ-নেতাদের যাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, আবুল কাশেম ফজলুল হক প্রমূখ। তারই ফলস্বরূপ হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের মতন মুসলিম বুদ্ধিজীবীরাও বুঝতে পেরেছিলেন যে হিন্দু মুসলমানের উভয়ের প্রধান শত্রু শাসক ইংরেজ।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এই হিন্দু-মুসলিম ভ্রাতৃ বন্ধনকে দৃঢ় করেছিল । ঐক্যবদ্ধ বাঙালিদের আন্দোলনের ফলে মাত্র কিছুদিনের জন্য পরাক্রান্ত বৃটিশ সিংহকে বাংলার বাঘের কাছে মাথা নত করতে হয়েছিল এবং বিভক্ত বঙ্গভূমিকে আবার সংযুক্ত করতে হয়েছিল।
নজরুলের পূর্বপুরুষ বিহার থেকে বাংলার পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম প্রান্তে স্থায়ীভাবে চলে এসেছিলেন। ওদের উপর সুফি সম্প্রদায়ের প্রভাব ছিল। রবীন্দ্রনাথের যুক্তিবাদী মানবতাবাদ সত্যেন দত্ত, সৈয়দ ওয়াজিদ আলী প্রমুখের উৎসাহেই দেশাত্মবোধ নজরুলকে যুক্তিবাদী হতে সাহায্য করেছিল। প্রধানত শিক্ষার অভাব সত্ত্বেও দেশে বিদেশে যুদ্ধের ভয়াবহতাকে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নজরুলকে ক্ষুদ্র জাত-পাতের বিচারে উপরে উঠতে সাহায্য করেছিল। নজরুল ধর্মনিরপেক্ষভাবে প্রচার করতেন এবং তদানীন্তন অনেক রাজনেতার আচরণের বিপরীতে নজরুলের প্রচারে এবং আচরণে তফাৎ ছিল না।
নজরুল সাহিত্য প্রধানত অসাম্প্রদায়িক। যেমন সহজভাবে তিনি মুসলমানদের ধর্মীয় আবেগ নিয়ে লিখেছেন সেরকম সহজভাবেই হিন্দুদের শুদ্ধ আবেগ নিয়ে সাবলীল সাহিত্য সৃজন করেছেন। তিনি ধার্মিক মুসলমান ছিলেন কিন্তু তার মতো এত হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনেক হিন্দুও পড়েননি। ওঁর বহু শ্যামা সংগীত এবং বৈষ্ণবগীতি তার জ্বলন্ত নিদর্শন। শব্দচয়নে তিনি অনায়াসে সংস্কৃত শব্দ চয়ন করেছেন, যেমন করেছেন আরবি এবং ফার্সি শব্দ। বাংলা সাহিত্যে গজল এর আমদানি করে বাংলা সংগীতকে নজরুল এক নতুন দিগন্তে নিয়ে গেছেন এবং তাকে আরও মানবিক সর্বজনীন আরও সর্বজনীন এবং আরো অসাম্প্রদায়িক করেছেন।
প্রমিলা সেনগুপ্ত নামের এক হিন্দু মহিলাকে ভালোবাসার অপরাধে নজরুল মুসলমানদের দ্বারা নিন্দিত এবং হিন্দুদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন কিন্তু আদর্শচ্যুত না হয়ে সেই নারীকেই বিবাহ করেছেন। তিনি দেখেছিলেন যে মৌলবাদী এবং কায়েমি স্বার্থান্বেষীরা হীন স্বার্থসিদ্ধির জন্য কীভাবে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ বাড়িয়ে দিতেন। সাম্প্রদায়িকতাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করা সত্ত্বেও এবং হিন্দু-মুসলিম মিলনের আজ অন্য প্রচারক হওয়া সত্ত্বেও নজরুল কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিষকে নির্মূল করতে কোন সার্থক মন্ত্র দিয়ে যেতে পারেননি। এর কারণ সহজেই অনুমেয়। প্রথমত নজরুল মূলত একজন কবি, সমাজ-সংস্কারক নন।
আরেকটা কারণ এই যে সম্ভবত নজরুল একাগ্র চিত্তে ও একমুখী সাধনার দ্বারা কোন সমস্যার মূলে পৌঁছানোর মতন ক্ষমতাধর ছিলেন না। ওর বিশ্লেষণ ভাববাদী এবং প্রয়াস তাৎক্ষণিক। নজরুলের কবিতা আহত এবং বন্দী সিংহের প্রচন্ড গর্জন। যাতে যতটা আবেগ ছিল ততটা বেগ ছিল না। যতটা গতি ছিল ততটা দিশা ছিল না।
সম্রাট আকবরের মত নজরুলও বিশ্বাস করতেন যে হিন্দু মুসলমান এক জাতি এক প্রাণ এক মন হয়ে সোনার ভারত গড়তে পারে। তিনি বিশ্বাস করতেন, “মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান, মুসলিম তার নয়ন মনি হিন্দু তাহার প্রাণ।” অস্পৃশ্যতাকে এবং হিন্দু-মুসলিম বৈরিতাকে নজরুল আন্তরিকভাবে ঘৃণা করতেন। তাঁর উদাত্ত আহ্বান, “জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছে জুয়া।“ তাইতো তিনি বলতে পারেন,
বলতে পারিস বিশ্বপিতা ভগবানের কোন সে জাত?
কোন ছেলের তাঁর লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ?
নারায়ণের জাত যদি নাই,
তোদের কেন জাতের বালাই?
(তোরা) ছেলের মুখে থুতু দিয়ে মার বুকে দিস ধূপের ধোঁয়া।
ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলিমালা প্রভৃতি ছোটগল্প সংকলন বাঁধনহারা, মৃত্যুক্ষুধা কুহেলিকা এবং অন্যান্য উপন্যাস প্রকাশিত হলেও নজরুল মূলত বিখ্যাত অসংখ্য কবিতা ও অসাধারণ গানের জন্য। তাঁর কবিতা ‘বিদ্রোহী’ নজরুলকে বাঙালির হৃদয় মানসে প্রতিষ্ঠিত করে। এই কবিতায় কবির উদাত্ত আহ্বানে বাঙালির বুকে জাগরণের বরাভয় মন্ত্র জাগিয়েছিল। কবিতাটির প্রথম ছত্র কবিতার মর্ম প্রকাশ করে যখন কবি বলেন,
বল বীর
বল চির উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি, নতশির ওই শিখর হিমাদ্রীর।
নজরুলের জাতীয়তাবাদী অসাম্প্রদায়িকতার অমোঘ পরিচয় পাওয়া যায় ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায়। যেখানে কবি বলেন,
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরন,
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃ মুক্তিপণ।
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন
কান্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।
কবিতার শেষ ভাগে নজরুলের উদাত্ত আহ্বান,
“আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতেরে করিবে ত্রাণ?
“সঞ্চিতা” কাব্যগ্রন্থের হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ নজরুলের কবিতার এক মাইলফলক। ওর মতন প্রতিভাধরের পক্ষেই সম্ভব হিন্দু-মুসলিম বীভৎস দাঙ্গার মত ভয়াবহ ও হৃদয়বিদারক শোকগাথার উপর হালকা মেজাজে লিখতে। যাতে হিন্দু মুসলমান নরখাদকদের সুপ্ত এবং লুপ্ত বিবেক জাগ্রত হয়। আপাত দৃষ্টিতে নির্মম এবং মানবিক বিষয়কে অনুপম ব্যবস্থাপনার গুণে সুন্দরের আহ্বায়কে রূপান্তরিত করতে পারে। উনিশ শতকের ইংরেজ কবি শেলীর মত নজরুল বিশ্বাস করতেন ধ্বংসের পরই আসে সৃষ্টি।
নজরুলের মতে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার অন্যতম কারণ উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দূরত্ব। যার ফলে কাছাকাছি বা পাশাপাশি দীর্ঘদিন বাস করার পরেও একই সম্বন্ধে অপরের অবিশ্বাস। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর “রাশিয়ার চিঠি”তে আক্ষেপের সঙ্গে বলেছিলেন যে প্রকৃত শিক্ষার অভাব হিন্দু মুসলমানদের বৈরীর অন্যতম কারণ। ধর্মের তথাকথিত পাণ্ডাদের প্রতি নজরুল খড়্গহস্ত ছিলেন। ওঁ বলতেন যে, মন্দিরে এবং মসজিদে সাধারণ মানুষের প্রবেশ অধিকার নাই, মৌলবী এবং পুরুত দেবালয়ের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে ভগবানকে আলাদা করে দিয়েছেন। ওঁ বিশ্বাস করতেন হৃদয়ের চেয়ে পবিত্র কোন মন্দির কাবা নাই।
নজরুলের আমার কৈফিয়ত কবিতা আমাদের সময় যেকোন সুস্থ মানুষের বিবেকের আয়না কবিতার শেষের অংশে যেন আমাদের হৃদয়ের স্পন্দন প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায় ৩৩ কোটি মুখের গ্রাস ,যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ। নজরুল আক্ষেপ করে বলেছেন “নর ভাবে আমি বড় নারী ঘেঁষা, নারী ভাবে নারী বিদ্বেষী।“ বাস্তবে নজরুল নারী বিদ্বেষী ছিলেন না। তিনি নারীকে যেমন দেবী রূপে কল্পনা করেননি, আবার দাসী রূপেও না। নারীকে সত্যিকারের মর্যাদা দিয়ে মানবী রূপে দেখেছেন । তাই তিনি গেয়েছেন –
সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষে নারীতে কোন ভেদাভেদ নাই।
আরো বলেছেন বিশ্বে যা কিছু মানুষ সৃষ্টি চিরকল্যাণকর ,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।
নজরুল দেখেছেন যে নারীর ত্যাগ নারীর ব্যথার ব্যাপারে ইতিহাস উদাসীন। তিনি লিখেছেন,
কত বীর দিল … সমরে লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর লেখা নাই তার পাশে।
তাইতো নজরুলের উদাত্ত ভবিষ্যৎ বাণী সেদিন সুদূর নয় যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীর জয়। পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যত্র বসবাসকারী ২৭ কোটির বেশি বাঙালির অন্তরে কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে বিদ্রোহী কবি নজরুলের স্থান বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি হিসেবে কাজী নজরুলে ইসলাম আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
বিদ্রোহী তকমা নজরুলের গায়ে এমন ভাবে লেগে গিয়েছিল যে জনশ্রুতি- একবার নজরুল কিছু প্রেমের কবিতা লিখে মতামতের জন্য কবিগুরুর রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ তার স্বভাব সিদ্ধ রসিকতায় মন্তব্য করেছিলেন, নজরুল, ভগবান তোমাকে তরবারি দিয়েছেন, তুমি তা দিয়ে দাড়ি কামাচ্ছ?
আমরা কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের সাথে সুর মিলিয়ে এই অমর বিদ্রোহী কবি নজরুলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শেষ করছি,
ভুল হয়ে গেছে বিলকুল,
আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে,
ভাগ হয়নিকো নজরুল।
এই ভুল টুকু বেঁচে থাক।
দুর্গতি তার ঘুচে যাক।