বিলে-নরেন-বিবেকানন্দ
‘বিলে’ নামের যে দুরন্ত বালক নিজের দুরন্তপনায় বাড়ির সকল আত্মীয়, নিজের বন্ধু-বান্ধবদের এবং পাড়াপড়শিদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখত সেই বিলে যুবক বয়সে রামকৃষ্ণদেবের ভাবশিষ্য হিসেবে যুবক নরেন্দ্রনাথ রূপে ভারতীয় সমাজকে আলোড়িত করেছিল। তিনিই আবার স্বামী বিবেকানন্দ রূপে শিকাগোর মহাধর্ম সম্মেলনের শ্রেষ্ঠ বক্তা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে সারা বিশ্বের চিন্তাবিদদের নজর কেড়েছিলেন।
আধুনিক ভারতের তিন মহান – মহাত্মা গান্ধী, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও স্বামী বিবেকানন্দ। মহাত্মা গান্ধী যদি ভারতের শরীর হন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যদি ভারতের আত্মা হন, তবে স্বামী বিবেকানন্দ ভারতের বিবেক।
স্বামীজি বিশ্ব শিক্ষক ছিলেন। তিনি বিদ্যালয়ের গণ্ডির ভিতরে অল্প সংখ্যক বিদ্যার্থীর শিক্ষাদান করেননি, তিনি উন্মুক্ত বিশ্বের সমস্ত মানবজাতিকে শিক্ষাদান করেছেন। তিনি কোন একটি বিষয় শিক্ষা দেননি, সম্পূর্ণ মানবধর্মের শিক্ষা দিয়েছেন। স্বামীজীর শিক্ষায় এবং আচরণে কোন পার্থক্য ছিল না । ওর শিক্ষায় শিক্ষার সমস্ত অনুভাগ উপস্থিত ছিল – শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, বৌদ্ধিক, সামাজিক এবং আত্মিক। তিনি সুস্থ মন, সবল শরীর গঠনের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি চাইতেন প্রত্যেকের মাংসপেশী লোহার মতো মজবুত ও স্নায়ুতন্ত্র ইস্পাতের মত সহনশীল হোক। তিনি চাইতেন muscles of iron and nerves of steel.
স্বামীজীর বক্তৃতা শ্রোতাকে উদ্বেলিত করত। স্বামীজি ছিলেন আকর্ষণীয় বক্তা, রসিক কথক, প্রচন্ড জ্ঞানী এবং অসাধারণ বাগ্মী। ওর বক্তৃতায় আকাশের ব্যাপ্তি, সাগরের গভীরতা এবং পর্বতের উচ্চতা ছিল।
স্বামীজী উপলব্ধি করেছিলেন যে প্রচুর সম্ভাবনাময় হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয়রা বিশ্ব সভায় দরিদ্র এবং দয়নীয় ছিল। তার কারণ ভারতীয়দের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং আধুনিক শিক্ষার অভাব ছিল । ইংরেজ শাসন ভারতীয়দের অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু এবং মানসিকভাবে অক্ষম করে দিয়েছিল। ভারতের অর্থে ইংরাজদের শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছিল এবং ইংরাজের শোষণের ফলে ভারতবাসী আত্মমর্যাদাহীন হয়ে পড়ছিল। ভারতবর্ষের আত্মিক সম্পদের পরিচয় স্বামীজীর ছিল। তাই তিনি ভারতীয়দের লুপ্ত মর্যাদা ফিরিয়ে আনার প্রয়াস করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে ভারতীয় হয়ে জন্মানো লজ্জার না , গর্বের বিষয়। তিনি আপামর ভারতবাসীকে অন্তর থেকে ভালবাসতেন। ওর গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কথামতো উনি শিব জ্ঞানে জীবের সেবা করতেন। উনি গর্বের সঙ্গে বলতেন দরিদ্র ভারতবাসী মূর্খ ভারতবাসী অজ্ঞান ভারতবাসী আমার ভাই। প্রকৃত অর্থেই উনি ছিলেন জাতির জনক।
অনেক বাধা পেরিয়ে, রাজস্থানের ক্ষেত্রীর মহারাজা এবং অন্যান্যদের আর্থিক সাহায্যে, গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণের দৈবিক ইশারায় এবং শ্রী শ্রী মায়ের আশীর্বাদ পাথেয় করে স্বামীজী শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে হিন্দুধর্মের উপর বলার জন্য আমেরিকা যাত্রা করেন। ওর কাছে না ছিল কোন পরিচয়পত্র, না ছিল ধর্ম মহাসভার জন্য কোন নিমন্ত্রণ। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জন হেনরি রাইটকে অনুরোধ করা হয় স্বামীজীকে ধর্ম মহাসভার জন্য পরিচয় পত্র দেবার জন্য। উনি হার্ভার্ডে স্বামীজীর বক্তৃতা শুনে এতই মোহিত হন, যে উনি বলেন স্বামী বিবেকানন্দের থেকে পরিচয়পত্র চাওয়া আর সূর্যকে কিরণ দানের অধিকার জিজ্ঞেস করা একই ব্যাপার। উনি বলতেন আমেরিকার সমস্ত জ্ঞানীর সামগ্রিক জ্ঞানের চেয়েও স্বামীজী বেশি জ্ঞানী- Swami Vivekananda is more learned than all the scholars of America put together.
আমরা জানি ওই ধর্মসভার সময় ভারতীয়দের সম্বন্ধে বিশ্ববাসীর কী নিদারুণ অবজ্ঞা এবং অশ্রদ্ধা ছিল। ভারতবর্ষকে বলা হতো ভিক্ষুক এবং সাপুড়েদের দেশ। যেই স্বামীজি ভাষণ দিতে উঠে “আমেরিকাবাসি আমার ভগিনী এবং ভ্রাতাগন” বলে সম্বোধন করলেন, সভাগৃহ হাততালিতে ফেটে পড়লো এবং সভাস্থ সাত সহস্রাধিক শ্রোতা দাঁড়িয়ে উঠে দু মিনিটের বেশি করতালি ধ্বনি দিয়ে স্বামীজীকে অভিনন্দন জানালেন। এক অভূতপূর্ব, অবিস্মরণীয় দৃশ্য। স্বামীজী সোজা আমেরিকাবাসীর হৃদয় তন্ত্র স্পর্শ করলেন , যখন তিনি বললেন যে তিনি বিশ্বের প্রাচীনতম সন্ন্যাসীদের তরফ থেকে বিশ্বের নবীনতম রাষ্ট্রের অধিবাসীদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন।
সেই প্রাচীন বৈদিক সভ্যতার সাধকবৃন্দ বিশ্বের সমস্ত মানবজাতিকে সহিষ্ণুতা, উদারতা এবং সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা শিখিয়েছেন। কী অপূর্ব দৃশ্য ! গতকালের অজ্ঞাত, অখ্যাত গেরুয়াধারী হিন্দু ফকির আজ সম্মানের নিরিখে রাজরাজেশ্বর। ধর্ম মহাসভার সভাপতি ডক্টর বারোস মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন।
“এক গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করলেন যিনি শ্রোতামন্ডলীর উপর সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করলেন”। নিউইয়র্কের বিদগ্ধ সমালোচক লিখলেন- “স্বামী বিবেকানন্দ ঈশ্বর দত্ত ক্ষমতার অধিকারী এক বাগ্মী।“ নিউইয়র্ক হেরল্ড লিখল “স্বামী বিবেকানন্দ এই ধর্ম সভার সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। স্বামীজীর বক্তৃতা শোনবার পরে আমরা বুঝতে পারছি এই সুমহান দেশ ভারতবর্ষে খ্রিস্টান মিশনারি পাঠানো মূর্খতা। আমেরিকার সংবাদ মাধ্যম এক বাক্যে স্বীকার করল যে ধর্ম মহাসভার সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সর্ব উৎকৃষ্ট ব্যক্তির নাম স্বামী বিবেকানন্দ।“
একটি সামান্য ঘটনা উল্লেখ করব যার মাধ্যমে স্বামীজীর দৃঢ় চরিত্রের এক ঝলক আমরা দেখতে পাবো। ধর্ম মহাসভা সমাপ্ত হবার পর উদ্যোক্তারা স্বামীজিকে বললেন – আপনি এমন অপরূপ কান্তির মানুষ, এমন অপূর্ব বাগ্মী এবং আত্মিক বলে বলিয়ান মানুষ, কিন্তু আপনার ওই পোশাক , গৈরিক আল-খাল্লা, আপনার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানায় না । আপনি অনুমতি করলে ধর্ম মহাসভা নিজেদের খরচে আপনাকে দামি স্যুট উপহার দিতে চান। স্বামীজি হেসে উত্তর দিলেন আপনাদের দেশে একজন দর্জি মানুষকে বানায়, আমাদের দেশে চরিত্র মানুষকে বানায় (In your country a tailor makes a man and in our country character makes a man.)
আধুনিক ভারতের এই তিন মহাপুরুষ উনবিংশ শতাব্দীর ষষ্ঠ দশকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন -১৮৬১ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, ১৮৬৩ সালে স্বামী বিবেকানন্দ এবং ১৮৬৯ সালে মহাত্মা গান্ধী। গৃহী জীবনে স্বামী বিবেকানন্দের নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণের দীক্ষিত নরেন্দ্রনাথ সন্ন্যাস জীবনে কখনো সচ্চিদানন্দ কখনও বিবিদিশানন্দ কখনো বিবেকানন্দ নাম ব্যবহার করতেন । ক্ষেত্রীর মহারাজ স্বামীজিকে বললেন, “বিবিদিশানন্দ মানে যার বিবেক জাগ্রত হওয়ার মুখে, কিন্তু স্বামীজীর বিবেক তো পূর্ণরূপে জাগ্রত। তাই এখন থেকে স্বামী বিবেকানন্দ রূপে জগত আপনাকে জানবে। শ্রীরামকৃষ্ণ বুঝতে পেরেছিলেন যে নরেন মানবরূপে ভগবান শিব। উনি বলতেন যে, যেদিন নরেন জানবে যে আসলে ও কে, সেই দিনই ও শরীর ত্যাগ করে অমর লোকে চলে যাবে।
১৯০২ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সেই এই মহামানবের অকাল প্রয়াণ।