ভাষা সচেতনতা দিবসে নিজের ভাষার ভালোবাসা
কোনো ভাষা ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারা মানে কি কেবলই সেই ভাষায় সুললিতভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারা? অনেকের তেমনই ধারণা। কিন্তু ভাষার পরিচয় শুধু মাত্র সাহিত্যে নয় ; তার পরিচয় সাধারণ জীবন যাপনের অংশ হিসেবে দৈনন্দিন ব্যবহারে। শহুরে কথিত বাংলা অল্পবিস্তর ইংরেজি মিশ্রিত। বিশুদ্ধতাবাদীদের ভ্রুকুটি সত্বেও এটাই এখন বাস্তব। মজাটা হয় তখন যখন কোনও কারণে আপনি পুরো বাংলায় কথা বলতে বাধ্য।
ধন্যবাদের প্রত্যুত্তরে আমরা বাংলায় কী বলি? ভেবে দেখলাম বাংলায় কেউ ধন্যবাদ বললে আমরা সাধারণত ঘাড় কাত করে হেসেই উত্তরের কাজ চালাই বা ‘আরে কোনও ব্যাপার না’ বা ‘আরে ঠিক আছে ঠিক আছে’ বা খুব বেশী হলে ‘ধন্যবাদ জানানোর প্রয়োজন নেই’ বলি। ‘ইয়ু আর ওয়েলকাম’ এর যথার্থ বঙ্গানুবাদ কী, এবং তা কি আমরা বাস্তবে ব্যবহার করি? ‘হ্যাপী ফ্রাইডে’র বাংলা কী? টি টি ওয়াই বা টেলিটাইপরাইটার, যা প্রধানত বধিরদের জন্য তৈরী বা তাদের সুবিদার্থে ব্যবহৃত, তার বাংলা যে পাঠ্যফোন, তা কে জানত? মানে আমি অন্তত জানতাম না।
টরন্টো শহরে বাংলা ভাষার অনুবাদকের কাজ করতে গিয়ে বেশ কিছুবার এমন থমকে থমকে যেতে হয়েছে। এখানে আমি যে ধরনের অনুবাদের কাজ করি তার সাথে সাহিত্যের বিশেষ সম্পর্ক নেই। এখানে এই পেশাটিকে বলে কম্যুনিটি ইন্টারপ্রেটিং অর্থাৎ সামাজিক পরিষেবা প্রদানের প্রেক্ষাপটে বা তার প্রয়োজনে অনুবাদ। আইনি পরামর্শ চাই কিন্তু আইনজীবির সাথে সারাক্ষণ ধরে ইংরেজিতে কথাবার্তা চালানো কঠিন? বা ডাক্তারকে সঠিকভাবে ইংরেজিতে বলতে পারছেন না যে ঠিক কী অসুবিধে হচ্ছে বা ডাক্তার ঝড়ের গতিতে ইংরেজিতে কী পরামর্শ দিচ্ছেন তার মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারছেন না? বা কোর্টে সাক্ষ্য দিতে হবে কিন্তু ইংরেজিতে ঠিক করে গুছিয়ে বলতে পারবেন না? সরকারি খরচায় আপনার জন্য অনুবাদক হাজির।
কানাডা আক্ষরিক অর্থে একটি বহুজাতিক, বহুভাষী দেশ। স্প্যানিশ চাইনিজ জাপানিজ ইটালিয়ান হিন্দি পাঞ্জাবি উর্দু আরবি ফার্সি এসব তো আছেই, আজেরবাইজানি, আমহারিক, স্বাহিলিও কম নেই। কিন্তু সরকারি ভাষা যেহেতু ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ, আর সরকার যেহেতু চান না যে কেউ শুধু মাত্র ইংরেজি ভাষার ওপর দখল না থাকার কারণে সরকারি সুযোগ সুবিধে বা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হোক, তাই তাঁরা নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে অনুবাদের ব্যবস্থা করে দেন।
লিখিত অনুবাদ বা ট্রান্সলেশন তাও সামলে দেওয়া যায়, কারণ সময় নিজের হাতে। একটু ইন্টারনেটে রিসার্চ, একটু অভিধান ঘাঁটা, একটু গুগল বুকস থেকে বিষয়ের ওপর বই ডাউনলোড করে ঘেঁটে দেখা, এসব করলে পরে সরকারি চিঠি, নথি বা প্রচারপত্রের মোটামুটি গ্রহণযোগ্য অনুবাদ করে ফেলা যায়। যদিও আমার অভিজ্ঞতা বলে ইন্টারনেটে সাহিত্য নয়। যেমন বিভিন্ন বীমা/ভাতা/আয়কর/বানিজ্যিক চুক্তি – এমন জিনিস বাংলা ভাষায় বিশেষ পাওয়া যায় না। বেশ কষ্ট করে খুঁজে বার করতে হয় অনুবাদ শাস্ত্রে যাকে বলে ‘প্যারালাল টেক্সট’।

কিন্তু অপ্রস্তুত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে কথ্য অনুবাদের ক্ষেত্রে কারণ সেই ক্ষেত্রে ‘রিসার্চ বা নিদেনপক্ষে ‘ভেবে নেওয়ার’ সময়টুকুও থাকে না। কথোপকথনের তাৎক্ষণিক অনুবাদে যা বলার তা তখনই বলতে হবে আর মুখ থেকে একবার যা বেরিয়ে যাবে তা আর ফেরত নেওয়ার উপায় নেই। তাই প্রথম যেদিন ‘হ্যাভ আ হ্যাপী উইকএন্ডের’ এর বাংলা বলতে হয়েছিল, আমি ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে বলেছিলাম ‘ভালো থাকবেন’। ভেবেছিলাম সঠিক অনুবাদ না হলেও বার্তাটা মোটামুটি ঠিকই ব্যক্ত করতে পেরেছি – অন্তত তখনকার মত পরিস্থিতি সামলানো গেছে। তারপর বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে পড়েছিল কাছাকাছি একটা অনুবাদ – সপ্তাহশেষের বা সপ্তাহান্তের ছুটি ভালো কাটুক।‘ কিন্তু দুই বাঙালি কি সত্যি সত্যি বাস্তবে শুক্রবার অফিস থেকে বেরোবার সময় “সমীর দা, বাড়ি চললাম; তোমার সপ্তাহান্তের ছুটি ভালো কাটুক” বলে?
বেশী ভালো বাংলায় বলারও বিপদ আছে। অনুবাদ হতে হবে সাধারণের বোধগম্য, প্রচলিত ভাষায়। একবার এক ডাক্তার এক প্রায় সত্তর বছরের বাঙালি নারীকে বলছেন ‘ইয়ু নীড আ নেকরেস্ট’। আমার তো নেকরেস্টের কোনও বাংলা প্রতিশব্দ তখন সেই মুহূর্তে কিছুতেই মনে আসছে না। আমি বললাম, ‘আপনার…ওই …গ্রীব…গ্রীবাবলম্বন লাগবে’। মহিলা ভুরু কুঁচকে বললেন ‘কী কইতাসেন? বুজতাসি না।‘ এদিকে আমার নিজের কোনও বক্তব্য বা মন্তব্য করা মানা; আমার শুধু মাত্র দুই পক্ষ একে অপরকে যা বলেছেন তা অনুবাদ করার অনুমতি আছে, বাড়তি নিজস্ব একটা শব্দও না। তাই আমি আবার ডাক্তার কে ‘কী কইতাসেন? বুজতাসি না’ ই অনুবাদ করে বললাম। ডাক্তার এবার ইশারার ভাষায় নেমে এলেন। হাতের ইশারা করে বোঝাতে বোঝাতে বললেন ‘নেকরেস্ট ইউ নো, নেকরেস্ট। আ সাপোর্ট ফর ইয়োর নেক’। আমিও এবার গ্রীবাবলম্বন থেকে সোজা ‘ঘাড় ঠেস দেওয়ার জিনিষ’-এ নেমে গেছি। বোঝাতে পারলেই হল। মিশন সাকসেসফুল।
পুলিশ বা কোর্টে অনুবাদ করা বেশ আলাদা রকমের কারণ পুরো কথপোকথনই রেকর্ড করা হয় এবং অনুবাদকের ওপর নির্দেশ থাকে যে যথাযথ অনুবাদ তো করতেই হবে কিন্তু সাথে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে নিজের থেকে কোনও বাড়তি কথা যোগ করা যাবে না, আর কথার টোন বজায় রাখতে হবে। কেউ নোংরা কথা বললে বা রাস্তার ভাষায় গালি দিলে সেই ভাষাই অনুবাদ করতে হবে, কথা পাল্টে দেওয়া যাবে না, ভাষা পরিষ্কার করা যাবে না। এই নিয়েও আমি দুশ্চিন্তায় পড়েছি একবার। উকিল প্রশ্ন করছেন বিচারকের সামনে, আমি দুপক্ষের সাওয়াল জবাব বাংলা ও ইংরেজিতে যথারীতি অনুবাদ করে যাচ্ছি। হঠাৎ সাক্ষী এমন কিছু বললেন যেটা আমি বুঝতে পারছি যে অপমানজনক কথা, কিন্তু শব্দটার সাথে পরিচিত না হওয়ায় ঠিক বুঝতে পারছিলাম না অনুবাদে কি লেভেলের ভালগারিটি হলে বক্তার টোনের সঠিক আঁচ পাওয়া যাবে। এদিকে সময় তো চলে যাচ্ছে। উকিল বিচারক-সহ সারা কোর্ট আমার দিকে তাকিয়ে। আমি আন্দাজমত অনুবাদ করে তো দিলাম কিন্তু তারপর আমার বুকের ভিতরের ধড়াস ধড়াস আর বন্ধ হয় না। পুরো রেকর্ডেড। যদি আমায় পরে ধরে বলে তুমি ঠিক শব্দটা বলতে পারনি তাই মামলার ক্ষতি হল? পরে জেনেছিলাম আমি ইংরেজিতে যা বলেছি কথাটার সঠিক মানে তার থেকে অনেক বেশী উগ্র ও সহিংস । সুতরাং ভাষা সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করতে হলে গালাগালির জ্ঞানও থাকা প্রয়োজন বৈকি।
নিজের ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও সেই ভাষা ব্যবহার করার অধিকার ধরে রাখতে ২১ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে কানাডায় পালিত হয় ল্যাঙ্গুয়েজ এডভোকেসি ডে। খুব বেশী পুরনো নয় এই উদ্যোগটি। ২০২১ থেকে শুরু হয়েছে এই ভাষা সচেতনতা দিবস উদযাপন। অতি সম্প্রতি, টরন্টোর মেয়র অলিভার চৌ ২২ ফেব্রুয়ারির দিনটি টরন্টোয় লাঙ্গুয়েজ এডভোকেসি ডে হিসেবে ঘোষণা করেছেন। আমি কাজের সূত্রে এই উদ্যোগটির সাথে বেশ গভীরভাবে যুক্ত। এই পর্যায়ে এই নবীন উদ্যোগটির মুখ্য উদ্দেশ্য হলো সহযোগী/সহমর্মী ব্যক্তি বা সংস্থাদের সঙ্গে একত্রিত হওয়া এবং জনকল্যাণ স্বার্থে প্রচারিত জরুরী তথ্যাদি যাতে কানাডায় বসবাসকারীদের সমস্ত জনসাধারণ, বিশেষ করে যাঁরা দুইটি সরকারি ভাষার কোনোটিই ব্যবহার করেন না, তাঁরাও যাতে সম্পূর্ণ রূপে অধিগমন করতে পারেন তা নিশ্চিত করা এবং সংখ্যালঘু গোষ্ঠিরা যাতে স্বাচ্ছন্দে তাদের নিজেদের মাতৃভাষা ব্যবহার, পরবর্তী প্রজন্মকে সেই ভাষায় শিক্ষিত করা এবং ভাষার চর্চা ও যত্ন করতে পারেন তেমন পরিস্থিতি বজায় রাখা। নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে কাজ করা এই উদ্যোগটির প্রধান একটি দায়িত্ব, যাতে ভাষা-ভিত্তিক চাহিদাগুলি বাস্তবায়িত হতে পারে।
আমাদের সংস্থা এই উদ্যোগটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত থাকার ফলে ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের বেশ একটা উৎসব মুখর দিন কাটল। সারাদিন-ব্যাপী অনুষ্ঠানে বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্যে ছিল বিভিন্ন ভাষা সংক্রান্ত প্রতিবন্ধকতা ও বৈষম্যের মধ্যে দিয়ে গেছেন এমন কয়েকজনের বক্তব্য। তার মধ্যে আমার মনে দাগ কেটে গেছে একজন বধির সম্প্রদায়ের বক্তা। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ অনুবাদকের সাহায্যে তিনি জানালেন কী ধরনের প্রতিকুলতার মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে। তাঁর “মাতৃভাষা” এ-এস-এল অর্থাৎ আমেরিকান সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ; এই ভাষা ব্যবহার করে পেশাগত শিক্ষা নেওয়া, পছন্দ মতো পেশায় কাজ করা বা সর্বসাধারণের জন্য উপলভ্য যে কোনও তথ্য এক্সেস করা তাঁর মানবাধিকার। সেই অধিকার প্রাপ্ত করতে তাঁকে এবং তাঁর মতো বধির মানুষদের কী অভিজ্ঞতা হয়েছে জানলাম। বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে ভাষার ভূমিকা ও গুরুত্বের কথা বুঝলাম। জানলাম কীভাবে আদি কানাডীয় গোষ্ঠির মধ্যে মাতৃভাষার ব্যবহার টিকিয়ে রাখা রীতিমতো একটি চ্যালেঞ্জ। এই ভাষাগুলি প্রধানত মৌখিক; এগুলি লিখিত আকারে না থাকার ফলে সংরক্ষন করা সমস্যা হয়ে পড়ে, বিশেষত যখন নবীন প্রজন্ম পেশাগত কারণে ইংরেজি বেশী ব্যবহার করে।
২০২৪ সাল থেকে আমাদের সংস্থাটি মাইক্রোগ্রান্ট বা ক্ষুদ্র অনুদান প্রকল্প শুরু করেছে, যার অংশ হিসেবে এমন উদ্যোগসমূহকে অনুদান দেওয়া হয় যারা নিজ ভাষা রক্ষা করার ক্ষেত্রে, জরুরী তথ্যাদি ইংরেজি ও ফরাসি ব্যতীত অন্য ভাষায় উপলভ্য করার ক্ষেত্রে ও ভাষা সচেতনতা বিস্তারের ক্ষেত্রে কাজ করছেন।
অন্য ভাষাকে তাচ্ছিল্য না করে বা অন্য ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেও নিজের ভাষাকে ধরে রাখা যায়, তার মধ্যে নিমজ্জিত হওয়া যায়। চাই শুধু নিজের ভাষার প্রতি ভালোবাসা আর অধিকারবোধ। মাতৃভাষা ও মাতৃসম ভাষা কি একইভাবে ভালোবাসা যায়, কদর করা যায়? নিশ্চয়ই! অনেকটা “শেষের কবিতা”র অমিত রায়ের কেতকী আর লাবণ্যকে ভালোবাসার মতো – একজনের প্রতি ভালোবাসা ঘড়ায় তোলা জলের মতো যা প্রতিদিন তুলে প্রতিদিন ব্যবহার করতে ইচ্ছে হয়, আর অন্য জনের প্রতি ভালোবাসা দীঘির মতো – যা ঘরে তুলে আনা যায় না, কিন্তু যার মধ্যে মন যায় ডুবসাঁতার দিতে। দুটোই কিন্তু ভালোবাসা।