মন্ট্রিয়াল বইমেলা: একটি ঐতিহ্য়ের উত্তরাধিকার
ক্যানাডার সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত মন্ট্রিয়াল শহরটি গড়ে উঠেছে বারো মাসে হাজারো পার্বণের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে। সেন্ট লরেন্স নদীর তীরে বেড়ে ওঠা পাঁচশো বছরের প্রাচিন এই শহরটি ফরাসি ভাষার টেলিভিশন-প্রযোজনা, বেতার, থিয়েটার, চলচ্চিত্র, মাল্টিমিডিয়া, মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পেরও তীর্থভূমি। বিশ্বখ্যাত ক্যানাডিয়ান গীতিকার, গায়ক, কবি ও ঔপন্যাসিক লিওনার্ড কোহেন (১৯৩৪-২০১৬), ক্যানাডায় ইয়েটস-এলিয়ট চর্চার অন্যতম প্রাণপুরুষ সাহিত্যিক এ জে এম স্মিথ (১৯০২-১৯৮০) ও এফ আর স্কট (১৮৯৯-১৯৮৫) — তাঁরাও তো চারু ও কারুকলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত এই মন্ট্রিয়ালেরই অহংকার। বুদ্ধিবৃত্তির এই অহংকারের ডালপালার উত্তরাধিকার মন্ট্রিয়ালকে এনে দিয়েছে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বগ্রন্থের রাজধানী (ওয়ার্ল্ড বুক ক্যাপিটাল ২০০৫) সম্মাননা। বাংলাদেশের মহান একুশে স্মরণে গ্রন্থ-রাজধানী মন্ট্রিয়ালে প্রতিবছর আয়োজিতে হয় একুশে গ্রন্থমেলা; বিষয়টি বাঙালিদের জন্যে অত্যন্ত গৌরবের। আয়োজকদের আমন্ত্রণে এমন একটি গ্রন্থ-পার্বণের অংশ হতে পেরে নিজেকে আমি একজন কপালবান মনে করছি।
ক্যানাডা বাংলাদেশ সলিডারিটি (সিবিএস) প্রতিবছরের মতো এবারও আয়োজন করে একুশে বইমেলা। ‘একুশের ধারায় একাত্তর, আ-মরি বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ’ চেতনায় ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ (শনিবার) মারি-অ্যান স্কুলে (১০০ রু সৌভ, মন্ট্রিয়াল) অনুষ্ঠিত এবারের মেলাটি ছিলো তাঁদের ত্রয়োদশ আয়োজন। বর্ণিল এই গ্রন্থ উৎসবে অংশ গ্রহণ করেন টরন্টো, মন্ট্রিয়াল, অটোয়া, নিউ ইয়র্ক, এবং বাংলাদেশ থেকে আগত আমন্ত্রিত লেখক, কবি, গল্পকার, কথাসাহিত্যিক, গবেষক ও শিল্পীবৃন্দ। টরন্টো থেকে প্রকাশিত ক্যানাডার সর্বাধিক পঠিত জনপ্রিয় বাংলা সংবাদপত্র ‘বাংলামেইল’-এর ৭জন আমন্ত্রিত লেখকদের মধ্যে আমাকেও অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। কৃতজ্ঞতা জানাই ‘বাংলামেইল’ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম মিন্টুভাইকে। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী টরন্টোর লেখকদের মধ্যে ছিলেন গবেষক সুব্রত কুমার দাস, প্রাবন্ধিক সুজিত কুসুম পাল, কবি তসলিমা হাসান, লেখক তাসমিনা খান, কথাসাহিত্যিক জাকারিয়া মুহাম্মদ ময়ীন উদ্দিন ও কবি চয়ন দাস। কর্মস্থলের জরুরি কাজে আটকে যাওয়ায় কবি শেখর ই গোমেজ যোগ দিতে পারেননি। সহযাত্রী ছিলেন তিন পাঠক নীলিমা দত্ত, মণি পাল ও মুস্তারি মিতা।

টানা চার দিনে (১৩ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি) ৭২.৪ সেমি তুষারপাতের ফলে প্রায় সমাহিত ছিলো এই মন্ট্রিয়াল শহর। ১৮৯৮ সালের পর এই শহরে এটি ছিলো রেকর্ড তুষারপাত। বইমেলার দিনও দেখে মনে হয়েছে, অসংখ্য তুষারপর্বতের পাদদেশে জেগে ওঠার পরিক্রমায় রত একটি অর্ধচেতন শহর। এমন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে বয়স ও শারীরিক সামর্থ্যকে উপেক্ষা করে ছুটে আসা মানুষের উপস্থিতিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো মন্ট্রিয়ালের বইমেলা। বিকেল তিনটে থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত কাউকে ঘরমুখো হতে দেখা যায়নি। শিশু-কিশোররা নানান নির্ঘণ্টে অংশ নেয়ার পরও মধ্যরাত পর্যন্ত অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেনি। টরন্টোতে এই ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে, বেশির ভাগ অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের একক কর্মসূচি শেষ হবার সাথে সাথেই বাড়িমুখো হন। বিভিন্ন স্টলের প্রদর্শনী, সেমিনার এবং সাংস্কৃতিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দুপুর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলেছিলো আনন্দঘন অনুষ্ঠান। সিবিএনএ-এর দৃষ্টিনন্দন স্টলটিতে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের উপস্থিতি ও তাদের উদ্দীপনা ছিলো দেখার মতে। সিবিএস সভাপতি জিয়াউল হক জিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বইমেলার সাংস্কৃতিক সন্ধ্যাটি পূর্ণতা পেয়েছিলো উদীচীর সঙ্গীত ও উপস্থিত কবিদের আবৃত্তি পরিবেশনায়। পার্বণের শেষ বাঁশিটি বাজিয়েছেন বাংলাদেশ থেকে আগত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।
মেলা কর্তৃপক্ষের বিবেচনায়, বাংলামেইল এবং এনআরবি পেয়েছে সেরা স্টলের পুরস্কার। গ্রহণ করেন এই দুই মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কাজী আলম বাবু। রাইটার্স ইউনিয়ন অব ক্যানাডা ও লিটারেরি ট্রান্সলেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব ক্যানাডা’র সদস্য এবং ক্যানাডা জার্নালের সৃজনকর্তা সুব্রত কুমার দাসকে সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্যে একুশে সম্মাননা স্মারক তুলে দেয়া হয়। উত্তরীয় পরিয়ে সম্মান জানানো হয় আমন্ত্রিত লেখক ও শিল্পীবৃন্দকে। উত্তরীয় পর্বের পর স্কুলের বারান্দায় অস্থায়ীভাবে নির্মিত শহীদ মিনারের সামনে সমবেত কণ্ঠে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ঐতিহাসিক ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ সঙ্গীতটি পরিবেশনকালে বাংলাদেশের প্রভাতফেরির আবহ ফুটে ওঠে প্রবাসের এই গ্রন্থমেলায়। জিয়াউল হক জিয়া ও আবুল হোসেন দুলালের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ছিল অনন্য। সদ্য প্রয়াত কবি হেলাল হাফিজকে উৎসর্গকৃত এই বইমেলার মঞ্চে টানা দশ ঘণ্টা ধরে নান্দনিক সঞ্চালনার যাদু দিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের মাতিয়ে রেখেছিলেন শহরের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শামসাদ রানা। বলা যায়, সেদিনের বইমেলার প্রাণ জাগানিয়া মানুষটির নাম ছিলো শামসাদ রানা। ক্যানাডা বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সির (সিবিএনএ) প্রাণপুরুষ সদেরা সুজন শংকর ও কলামিস্ট বিদ্যুৎ ভৌমিকের সার্বক্ষণিক তৎপরতা ছিলো নজরকাড়া।

মন্ট্রিয়াল বইমেলায় অংশগ্রহণকালে দুটো বিষয় আমাকে প্রাণিত করেছে; আমি মুগ্ধ হয়েছি। প্রথম বিষয়টি হচ্ছে, দর্শক-শ্রোতাদের মান (কোয়ালিটি)। দ্বিতীয়টি, আয়োজকদের নিখাদ আপ্যায়ন ব্যবস্থাপনা। প্রবাসের বইমেলায় এমন নিবেদিত তথা আন্তরিকতাপূর্ণ দর্শক-শ্রোতার দেখা আগে কখনো পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। টরন্টো কিংবা নিউইয়র্কের বইমেলায়ও এমনটি আমার চোখে পড়েনি। এখানকার তরুণ পাঠকদের শরীরী ভাষা অসাধারণভাবে পরিশুদ্ধ এবং নিমগ্নতায় পরিপূর্ণ। লেখক হিসেবে বক্তব্য প্রদানকালে বিষয়টি আমার নেত্রগোচর হয়েছে। তাঁরা মনোযোগ দিয়ে লেখকের সাথে নৈকট্য স্থাপন করেন। বক্তার বক্তব্যের বিশেষ কোনো অংশে দর্শক-শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের কাল ও ধরন কিংবা ভঙ্গিমা দেখে আঁচ করা যায়, লেখক ও পাঠক একটি আধ্যাত্মিক সরলরেখায় অবস্থান করেন। ক্রয়কৃত বই সাথে নিয়ে শ্রবণরত কিংবা বিচরণরত পাঠকদের দেখে উপলব্ধি করা যায়, ঊর্ধ্বাঙ্গ ও নিম্নাঙ্গের সংযোগস্থল হিসেবে চিহ্নিত একটি মানব-নিতম্বের গ্রন্থির মতো গ্রন্থ হয়ে ওঠে একটি বৌদ্ধিক গ্রন্থি যেখানে সংযুক্ত হন লেখক ও পাঠক।
এই প্রসঙ্গে ২০০৫ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক মন্ট্রিয়াল শহরকে ‘ওয়ার্ল্ড বুক ক্যাপিটাল’ সম্মাননা প্রদানের বিষয়টি আরেকবার এই প্রবন্ধের পাঠকের সামনে নিয়ে আসা যায়। ‘এই শহরের তরুণ সমাজের মধ্যে গ্রন্থপাঠের ক্রমবর্ধমান চর্চা এবং মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পের বিকাশধারা’কে বিবেচনায় নিয়ে ইউনেস্কো সেদিন মন্ট্রিয়াল শহরকে সম্মান জানিয়েছিলেন। ২০২৫ সালের মন্ট্রিয়াল বুকফেয়ারের অভিজ্ঞতাকে বুকে ধারণ করে বলা যায়, আজকের এই পাঠকরা সেইদিনের তথা ২০০৫ সালের সেই তারুণ্যেরই অংশ তথা উত্তরাধিকার।

দ্বিতীয় এবং শেষ বিষয়টি হচ্ছে আয়োজকদের আপ্যায়ন ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে। সিবিএস আয়োজিত এই মেলায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো, মন্ট্রিয়াল ছাড়াও, টরন্টো, অটোয়া, নিউইয়র্ক এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন লেখক ও শিল্পীদেরকে। আয়োজকরা আমন্ত্রিত অতিথিদের একই হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। ভ্রমণের ক্লান্তি থেকে অতিথিকে রেহাই দেয়ার জন্যে হোটেল কক্ষেই প্রত্যেকের জন্যে আহারের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁরা আবার, এতো ব্যস্ততার মধ্যেও, টেলিফোনে খোঁজ-খবর নিয়েছেন অতিথিরা তাঁদের সেবায় তৃপ্ত হতে পারলেন কি না এবং অনিচ্ছাকৃত কোনো বিচ্যুতি থাকলে আমরা যেনো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি দিয়েই দেখি। বড়ো চমকটি ছিলো ফেরার দিন সকালে। আগের রাতে ব্যস্ততার কারণে আমাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে সঙ্গ দিতে না পারার কারণে, ফেরার দিন সকালে বিদ্যুৎদাদা এবং জিয়া ভাই হোটেল-লবিতে এসে সবার সাথে বসে কিছুক্ষণের জন্যে আড্ডা দেন। আড্ডাশেষে, বিদ্যুৎদাদা সবাইকে লাঞ্চ করিয়ে বিদায় অভ্যর্থনা জানান। এতোকিছুর পরও, রানা আপু আমার মেসেঞ্জারে জানিয়েছেন, ‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো লেগেছে আপনাদের সাথে পরিচিত হতে পেরে। যাওয়ার সময় আর দেখা করতে পারিনি। আশা করি ভালো মতোই যেতে পেরেছিলেন। আর বই মেলায় ঠিক মত খোঁজ করতে পারিনি, সেজন্যে দুঃখিত। ভালো থাকবেন। নিশ্চয় দেখা হবে আবারও।‘ লিটারারি কর্মযজ্ঞে এমন ধরণের কুটুম্বিতার উদাহরণ বিরল।