মার্ক কার্নি নতুন ধারার রাজনীতির সফল ব্যাক্তিত্ব

নিরঞ্জন রায়

গত সপ্তাহে কানাডায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জাতীয় নির্বাচন (ফেডারেল ইলেকশন) এবং সেই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও মার্ক কার্নি চমকে লিবারেল পার্টি জয়লাভ করেছে। বিগত এক মাসে বাংলাদেশে যতজনের সাথে ফোনে কথা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের জানার বিষয় ছিলো কানাডার নির্বাচন। এখানকার নির্বাচন নিয়ে অনেকের আগ্রহের মাত্রা দেখে আমি রিতিমত অবাক হয়েছি। কারণ তাঁরা কানাডার নির্বাচন নিয়ে এতটাই আগ্রহি এবং এত বিস্তারিত খোঁজখবর রেখেছে, যা আমরা কানাডায় বসবাস করেও সেভাবে রাখতে পারিনি। কানাডার নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে আমি আগে কখনো এত উৎসাহী হতে দেখিনি।

সত্যি বলতে কি, কানাডার নির্বাচন নিয়ে বিশ্বে সেভাবে আলোচনা হয় না। এমনকি কানাডার অভ্যন্তরেও জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জনগণের মাঝে সেই মাত্রার উৎসাহ বা আগ্রহ দেখা যায় না। এখানে মানুষ কাজ, জীবনজিবিকা এবং কিছু আনন্দ-ফুর্তি নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। জি–আট বা গ্রুপ আট-ভুক্ত দেশের সদস্য হওয়া স্বত্বেও কানাডার নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সেরকম আগ্রহের সৃষ্টি হয় না, যেমনটা লক্ষ্য করা যায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি এবং এমনকি জাপানের জাতীয় নির্বাচনের সময়। তবে বিগত এক দশকে স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক উভয় পন্থায় এত বিপুল সংখ্যক মানুষ বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে কানাডা এসেছে, তাতে কানাডা নিয়ে এখন সেসব দেশে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশে তো কানাডা এক বিশাল আলোচনার যায়গা করে নিয়েছে। বাংলাদেশে “বেগম পাড়া” শব্দের প্রচলনই হয়েছে এই কানাডাকে নিয়ে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে কানাডা নিয়ে আগ্রহের মাত্রা এতই বেশি যে বিনোদন মাধ্যমেও এই বিষয়টি প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নাটকে কানাডাকে নিয়ে কোনো না কোনো সংলাপ থাকেই। ফলে বাংলাদেশের এক শ্রেণীর মানুষের মাঝে কানাডা নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ আছে। কানাডায় কখন কি হয়, সেসব ব্যাপারে তাঁদের কৌতূহলের শেষ নেই। কানাডায় তুষার ঝড় হলে, সে খবর তারাই আমাদের চেয়ে সবার আগে জানে এবং আমাদের ফোন করে তাঁদের উদ্বেগ জানায়। আবার কানাডার ওয়ালমার্টে ৮৪ সেন্ট দড়ে প্রতি পাউণ্ড আপেল বিক্রির খবরও তাঁরাই আগে জানে। এই যেখানে অবস্থা, সেখানে কানাডার জাতীয় নির্বাচনের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তাদের আগ্রহ বেশি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।

কানাডায় এবারের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যথেষ্ট উত্তেজনা এবং আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল। ভোটার উপস্থিতিও ছিল সন্তোষজনক। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ৬৭ শতাংশের বেশি ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। সব মিলিয়ে কানাডার এবারের নির্বাচন বেশ ভালই উত্তাপ ছড়াতে পেরেছে। বিশেষ করে মার্ক কার্নির নেতৃত্বে লিবারেল পার্টি ধ্বসে পড়া অবস্থা থেকে ঘুরে দাড়িয়ে নির্বাচনী দৌড়ে এগিয়ে থাকার কারনেই কানাডার ভোটারদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল। রাজনীতির বাহিরে থাকা এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে একেবারেই অপরিচিত মুখ মার্ক কার্নি লিবারেল পার্টির দায়িত্ব নিয়ে রাজনীতির মাঠে নিজেও ভাল জায়গা করে নিতে পেরেছেন এবং দলের অবস্থানও বেশ শক্ত করতে পেরেছেন। লিবারেল পার্টির সংকটকালে মার্ক কার্নি যেভাবে আবির্ভাব হয়েছেন, সেটি কানাডার রাজনীতিতে এক নতুন ধারার রাজনৈতিক প্রচলন, যা আমি আমার এক লেখায় উল্লেখ করলেও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার সুযোগ হয়নি।

যারা এরকম কিছু কানাডার রাজনীতিতে দেখতে পান না, তাঁরা যদি একটু পিছনে ফিরে যান এবং কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করেন, তাহলেই বিষয়টা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেতে পারেন। বছর দুয়েক আগে টরন্টো সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, জন টোরির জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে এবং প্রতিপক্ষের জেতার সম্ভাবনা উজ্জল হয়, তখন নিরবেনিভৃতে অবসর থাকা অলিভিয়া চাওকে মেয়র পদের জন্য সামনে নিয়ে আসা হয়। ক্লিন ইমেজের একেবারেই গোবেচারা গোছের ব্যাক্তি অলিভিয়া চাও নিজেও হয়ত কখনো ভাবেননি যে তিনি এই বয়সে এসে এমন এক গুরুদায়িত্ব পাবার প্রতিযোগিতায় নামবেন। এই অলিভিয়া চাওকে নিয়ে শুরু হয়ে যায় মিডিয়ার মাতামাতি এবং নির্বাচনে মেয়র হিসেবে জিতেও যায়। এত বড় মেগাসিটির মেয়র হিসেবে তিনি কেমন, তা টরন্টোবাসী এতদিনে বেশ ভালভাবেই বুঝতে পেরেছে। এত দুর্বল মেয়র টরন্টো সিটি আগে কখনো পেয়েছে কিনা, তা আমাদের জানা নেই।

টরন্টো সিটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বলা চলে বৃহত্তম কর্মযজ্ঞ হচ্ছে এখানকার পাবলিক ট্রানজিট, অর্থাৎ টিটিসি (টরন্টো ট্রানজিট কমিশন)। এই টিটিসির বেহার অবস্থা দেখে খুব সহজেই বোঝা যায় যে এই সিটি কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে। মাত্র আঠার কিলোমিটার রাস্তা পারি দিতে লেগে যায় প্রায় দুই ঘণ্টা। আর তিন কিলোমিটার সাবওয়ে বা মেট্রো লাইন মেরামত হচ্ছে ছয় মাস ধরে। এরকম দৃষ্টান্ত অসংখ্য আছে যা খুব সহজেই বলে দেয় মেয়র হিসেবে অলিভিয়া চাও কেমন করছেন। তবে দুটো কাজ তিনি খুব ভালভাবেই করতে পারছেন, যার একটি হচ্ছে ক্রমাগত ট্যাক্স ও পারকিং ফি বৃদ্ধি করা এবং আরেকটি হচ্ছে লিখিত বক্তব্য মিডিয়ার সামনে সাবলীলভাবে বলে যাওয়া। এর বাহিরে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু এই মেয়র টরন্টোবাসীর জন্য করতে পেরেছেন বলে মনে হয়না।

একইভাবে অন্টারিও প্রদেশ বা প্রভিন্সের প্রিমিয়ার ডগ ফোর্ডের নেতৃত্বে প্রভিন্সিয়াল কনজারভেটিভ পার্টির জনপ্রিয়তা বেশ তুঙ্গে। স্বাভাবিকভাবে তাঁর দলকে পরাজিত করার মত নেতা অন্য কোনো দলে ছিল না। অন্যান্য দলের এরকম নেতৃত্বের সংকটে টরন্টোর পার্শ্ববর্তী এক শহর, মিসিসাগার সাবেক মেয়র বনি ক্রম্বিকে একইভাবে বেছে নেয়া হলো। বনি ক্রম্বি ছিলেন একজন ক্লিন ইমেজের ব্যাক্তি। তিনি মেয়র হিসেবে তাঁর শহর বেশ সুনামের সাথেই পরিচালনা করছিলেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সেই ক্লিন ইমেজের মেয়র বনি ক্রম্বিকে প্রভিন্সিয়াল লিবারেল দলের নেতা হিসেবে সামনে নিয়ে আসা হলো। যেহেতু তিনি মেয়র হিসেবে বেশ ভাল করছিলেন, তাই তাঁকেই বেছে নেয়া হয়েছিল টরন্টোবাসীকে চমক দিয়ে ডগ ফোর্ডকে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে। সেই নতুন নেতাকে নিয়ে শুরু হয়ে গেল মিডিয়ার মাতামাতি। যেহেতু ডগ ফোর্ডের ব্যাপক জনপ্রিয়তার বিষয়টি সবারই জানা ছিল, তাই জনমত জরিপে সেই নেত্রীকে এগিয়ে রাখতে না পারলেও এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল যেন নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর দেখা গেল যে ফোর্ডের প্রভিন্সিয়াল কনজারভেটিভ পার্টির ভূমিধ্বস বিজয় হয়েছে এবং সেই নেত্রীর নেতৃত্বে অন্টারিও লিবারেল পার্টির শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে। এমনকি সেই নেত্রী নিজেও হেরেছেন।

এই যে সংকট উত্তরণের নাম করে জনগণের অগোচরে থাকা কাউকে নিয়ে এসে দায়িত্ব দেয়ার নতুন প্রচলন কানাডার রাজনীতিতে শুরু হয়েছে, তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হচ্ছেন মার্ক কার্নি। লিবারেল পার্টি যখন চরম নেতৃত্বের সংকটে এবং নির্বাচনে যখন তাদের ভরাডুবি একরকম নিশ্চিত, ঠিক সেই মুহূর্তে রাজনীতির বাহিরে থাকা পেশায় ব্যাংকার এবং পাশ্চাত্য বিশ্বের এলিট ক্লাবের সদস্য, মার্ক কার্নিকে লিবারেল পার্টির নেতৃত্বে নিয়ে আসা হয়েছে। এই কৌশল বেশ ভাল কাজও করেছে। কেননা মার্ক কার্নি লিবারেল পার্টির নেতৃত্ব নেয়ার পর অতি অল্প সময়ের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকা লিবারেল পার্টি শুধু যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তাই নয়, সেই সাথে দলের নেতাকর্মীদের দারুণভাবে উজ্জিবিত করতে পেরেছেন। ফলশ্রুতিতে এক বছরেরে অধিক সময় ধরে এগিয়ে থাকা কনজারভেটিভ পার্টিকে পরাজিত করে টানা চতুর্থ বারের মত লিবারেল পার্টিকে বিজয়ী করতে সক্ষম হয়েছেন। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও একেবারে কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। আর মাত্র তিনটা সিট বেশি পেলেই, মার্ক কার্নির লিবারেল পার্টি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এককভাবেই সরকার গঠন করতে পারতেন। তারপরও মার্ক কার্নির নেতৃত্বে লিবারেল পার্টি অতীতের দুই নির্বাচনের চেয়ে বেশ ভালই করেছে।

রাজনৈতিক অঙ্গনে আকস্মিক হাজির হয়ে জনগণকে চমক দেয়ার ক্ষেত্রে অন্টারিওবাসী বনি ক্রম্বিকে সমর্থন না করলেও, কানাডার নাগরিক মার্ক কার্নিকে ঠিকই সমর্থন করেছে। সেই দিক থেকে মার্ক কার্নি হচ্ছেন ক্যানাডার নতুন ধারার রাজনীতির একজন সফল ব্যাক্তিত্ত্ব। অবাক হবার কিছু থাকবে না যদি টানা চারবার নির্বাচনে বিজয়ী হতে ব্যর্থ কনজারভেটিভ পার্টিও আগামী নির্বাচনে জয়লাভের উদ্দেশ্যে একই কৌশল অবলম্বন করে। অর্থাৎ নিজ দলের বাহির থেকে বা রাজনীতি থেকে দূরে থাকা পরিচিতি আছে, এমন কাউকে দলের নেতৃত্বে নিয়ে এসে নির্বাচনে জয়লাভের চেষ্টা করে। এরকম নজির কনজারভেটিভ পার্টির না থাকলেও, তাদেরই সহযোগী দল অন্টারিও পিসি পার্টীর তো কিছুটা হলেও আছে। আজকের অন্টারিওর প্রিমিয়ার ডগ ফোর্ডও এভাবেই রাজনীতিতে এসেছেন এবং সফলও হয়েছেন। এখন দেখার বিষয় কনজারভেটিভ পার্টিও এই একই পথ অনুসরণ করে কিনা। যদি করে, তাহলে কানাডায় এই নতুন ধারার রাজনীতি হয়ত আপাদত গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যাবে। # 

নিরঞ্জন রায়, CPA, CMA, CAMS
সার্টিফাইড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিষ্ট ও ব্যাংকার।
টরনটো, কানাডা
Nironjankumar_roy@yahoo.com