শুধু অকারণ পুলকে

ড. দিলীপ চক্রবর্তী

সকালে উঠে মনটা একসঙ্গে ভালো এবং খারাপ হয়ে গেল। ভালো হওয়ার কারণ উঠেই দেখলাম আকাশ থেকে পেজা তুলোর মতন ঝিরঝির করে তুষার পরছে। আর মনটা খারাপ হলো এই জন্য, যে আজ সকালে আর বাইরে হাঁটতে যেতে পারবো না। ঠান্ডার কারণে না, ঠান্ডা খুব বেশি নয়, কারণ হলো তুষার  পড়ার ফলে ফুটপাত (এ দেশের ভাষায় সাইডওয়াক) পেছল হয়ে আছে, এই পথে হাঁটতে গেলে ‘পপাত ধরণীতলে’ হওয়ার খুব সম্ভাবনা। আর এই বুড়ো বয়সে (যদিও আমার স্ত্রীর প্রচন্ড আপত্তি এই আমার নিজেকে বুড়ো বলাটা) রাস্তায় পড়ে গেলে ভঙ্গুর হাড় ভেঙে যাবার সম্ভাবনা।

সেই কারণে বাইরের আকাশের গোমড়া মুখের মতন আমি ঘরে গোমড়া মুখে বসে রইলাম। এবং উল্টোপাল্টা চিন্তা মাথায় আসতে আরম্ভ করল। প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কথা ধার করে বলতে ইচ্ছা করে,

 “মাথার ভিতর কিলবিল করে আইডিয়া,

 উই পোকা বলে চল ভাই, তারে খাই গিয়া ।“

হঠাৎ মনে হল যে আমার কি ডিমেনশিয়া হচ্ছে? কারণ কিছুদিন হল আমি অনুভব করছি যে আমি মাঝে মাঝে ভুলে যাচ্ছি। আমার সবচেয়ে অস্বস্তিকর অবস্থা হয় যখন আমি কোন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করার সময় হঠাৎ কোনো জরুরি কথা ভুলে যাই। হঠাৎ বক্তৃতা দেওয়ার কথা আসলো কেন ? এখানে গোপনে বলে রাখি যে টরন্টোর আমার অনেক বন্ধুর আমার সম্বন্ধে একটা ভুল ধারণা আছে যে আমি খুব পন্ডিত মানুষ। আর আমি ইচ্ছে করে তাদের আমার সম্বন্ধে এই ভুল ধারণাটা ভাঙাই না। ফলে মাঝে মাঝে আমাকে বকবক করার জন্য (ওরা বলে ভাষণ দান) ডেকে নিয়ে যায় এবং আমিও এই আহ্বান পাওয়া মাত্র গিয়ে হাজির হই। যেতে একদম দেরি করি না, ভয় হয় যদি আমি দেরি করলে উদ্যোক্তারা আমার নাম বাতিল করে দেয়। সেই সব বক্তৃতার সময় মাঝেমাঝে আমার স্মৃতি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং আমার ঘাবড়ে যাওয়া অবস্থা দেখে শ্রোতারা বুঝে ফেলে যে আমি খেই হারিয়ে ফেলেছি।

ভাবছি কীভাবে এই মুশকিলের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। সাথে সাথে মনে পড়ল আমার এক অদ্বিতীয় মুশকিল আসান সুব্রত কুমার দাসের কথা।  সুব্রত বয়সে আমার থেকে অনেক ছোট, কিন্তু ইমেজে সুব্রত আমার থেকে অনেক বড়। ও একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠিত  সাহিত্যিক, মননশীল গবেষক, আকর্ষক বক্তা এবং অসামান্য সংগঠক।

সুব্রত আমার সমস্যা শুনে আমাকে অভয় দিয়ে বললো, “কোন ভয় নেই। আপনি যে বক্তৃতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভুলে গেছেন, এটা যেন আপনি ছাড়া আর কেউ বুঝতে না পারে। সঠিক দিনক্ষণ মনে না থাকলে আনুমানিক সময়ের উল্লেখ করবেন এবং খুব সাবলীল ভাব বজায় রাখবেন। আমারও এই সমস্যা হয়, কিন্তু চেষ্টা করি কাউকে বুঝতে না দিয়ে সামলে নিতে।“ তারপর সুব্রত একটা মজার কথা বলল। এক যাত্রা দলের মালিক ছিলেন খুব স্বার্থপর। মজার হলো যে তিনি অভিনয়ও করতেন।  যা মুনাফা হত বাকি লোকেদের সাথে আধাআধি ভাগ না করে নিজে রাখতেন “দশ আনা” অংশ এবং বাকিদের দিতেন ছয় আনা অংশ। একবার অভিনয় করার সময় উনি মঞ্চে আসল জায়গায় এসে হনুমানের নাম ভুলে গেছেন। কিন্তু একটুও না ঘাবড়ে গিয়ে নিজের থেকে তৎক্ষণাৎ সংলাপ বানিয়ে বললেন, “লঙ্কায় গেছিল বীর, তার নাম কী ?” ওর দলের লোকেরা তো মালিকের উপর অসন্তুষ্ট ছিল। তাই চেঁচিয়ে বলল, “ভাগের বেলায় দশ আনা, ছয় আনা, আমরা জানি কি ?” সঙ্গে সঙ্গে স্টেজ থেকে নায়ক রূপি মালিক বললেন, “আজ হতে সমান সমান।“ সাথে সাথে গ্রীন রুম থেকে ওনার সাথীরা চেঁচিয়ে বললেন, “লঙ্কায় গিয়েছিল বীর হনুমান।“ উনি হনুমানের নাম জেনে গেলেন অথচ শ্রোতাদের কেউ বুঝলো না যে উনি হনুমানের নামই ভুলে গিয়েছিলেন। একেই বলে “সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙলো না।”

সুব্রতর সাথে কথা বলে আমার দুশ্চিন্তা ঘুচে গেল। আমার মন প্রসন্ন হয়ে গেল – বাইরে তাকিয়ে দেখলাম যে আকাশও মেঘমুক্ত হয়ে সূর্য উজ্জ্বল হয়ে আসছে হাসছে।