সুদের-হার হ্রাস কি কানাডিয়ানদের জন্য সুখবর?
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি বিষয় নিয়ে লেখার ইচ্ছা ছিল এবং সে অনুযায়ী কিছু তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করছিলাম। এমন সময় কানাডাপ্রবাসী পরিচিত কয়েকজনের কাছ থেকে ফোন পেয়ে ভাবলাম যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিষয়টি আগামী সপ্তাহের জন্য সরিয়ে রেখে আলোচ্য বিষয় নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করি। কেননা সুদের হার বর্তমানে অনেক দেশের জন্য বেশ আলোচিত বিষয়। আমাকে যে কয়জন ফোন দিয়েছিলেন, তাদের সবার জিজ্ঞাসা “দাদা, সুখবরটা শুনেছেন নিশ্চয়ই”। আমি কিছুটা হতবাক। কেননা কানাডা এমন একটি দেশে, শুধু কানাডা কেন, উন্নত বিশ্বই এমন একটি স্থান যেখানে সুখবরও যেমন থাকে না, তেমনি খারাপ খবরও থাকে না। এখানে সব চাকুরির মর্যাদাই একরকম, তাই চাকুরি নিয়ে থাকে না কোনো সুখবর। তেমনি চাকুরির প্রমোশন, বেতনবৃদ্ধি, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, জন্ম, মৃত্যু, এসব কোনকিছু নিয়েই তেমন উত্তেজনাকর খবর থাকে না। একেবারে ছকে বাঁধা নিরুত্তাপ জীবন। সেখানে হঠাৎ করে সুখবর আসবে কোথা থেকে।
যা-হোক আমি তাদের প্র্যতেকের কাছে জানতে চাইলাম যে, কি সেই সুখবর। আমার সেই পরিচিতদের একই উত্তর, তা হচ্ছে কানাডার কেন্দ্রিয় ব্যাংক তাদের নীতি সুদ-হার মাত্র ২৫ বেসিস পয়েন্ট বা ০.২৫% হ্রাস করে ২.৫০%-এ নির্ধারণ করেছে। মাত্র ২৫ বেসিস পয়েন্ট সুদের-হার হ্রাস করায় কি এমন লাভ হবে, তা আমি কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। আমার এমন প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা যা বলেছেন, তা এখানে উল্লেখ করে লেখার কলেবর বাড়াতে চাই না। তবে তাঁদের খুশির মাত্রা দেখে জীবনধর্মী গানের জনপ্রিয় গায়ক নচিকেতা ঘোষের একটি গানের কয়েকটি লাইনের কথা মনে পড়ে গেল। সেই গানের এক স্থানে নচিকেতা উপহাস করে বলেছেন যে তিনি তাঁর এক পরিচিত ব্যাক্তিকে খুব আনন্দ-উল্লাস করতে দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলেন “তুই এত উল্লাস করছিস কেন?”। সেই ব্যাক্তির উত্তর ছিল “দাদা, আমাদের প্রতিবেশি, লালটু-দা ব্যাংকের টাকা দিয়ে তিন তালা বাড়ি বানিয়েছে”। নচিকেতার পাল্টা প্রশ্ন “লালটু-দা বাড়ি বানালে, তোর কি লাভ?”। সেই ব্যাক্তির উত্তর “দাদা, আরেক প্রতিবেশী পলটু-দা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে পাঁচ তালা বাড়ি বানিয়েছে”। এবার নচিকেতা জানতে চায় “পলটু-দা বাড়ি বানালেই বা তোর কি লাভ?” সেই ব্যাক্তির উত্তর “দাদা, পলটু-দা ব্যাংকের টাকা নেয়ার ক্ষেত্রে লালটু-দাকে হারিয়ে দিয়েছে”। তখন নিচকেতা জানতে চায় “এতে তুই কেন উল্লাস করছিস”? এই পর্যায় সেই ব্যাক্তির উত্তর “দাদা, আমি অভ্যাসে উল্লাস করছি”।
যে সকল পাঠক নচিকেতার এই গানটি শুনেছেন, তাঁরা হয়ত কথাগুলো পড়ে অবাক হবেন্, আর ভাববেন যে নচিকেতা তো এই কথাগুলো এভাবে বলেনি। আসলেও তাই। নচিকেতা গানটি গেয়েছেন ভারত উপমহাদেশের অসৎ রাজনীতিবিদদের কটাক্ষ করে। কিন্তু রাজনীতি যেহেতু আমার বিষয় নয়, তাই নচিকেতার অপ্রিয় সত্য কথাগুলো পরিবর্তন করে এভাবে উপস্থাপন করেছি। তাছাড়া আজ বিশ্বের উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে অনেকেই যেভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিত্ত-বৈভবের মালিক হচ্ছেন এবং বিলাসবহুল জীবনযাপন করেছেন, তা নিয়ে নচিকেতা যদি কোনো গান রচনা করতেন, তাহলে তিনি কথাগুলো এভাবেই বলতেন। কানাডার সুদের হার হ্রাস করার বিষয় নিয়ে লিখতে যেয়ে এত বড় ভুমিকা অবতারণার কারণ হচ্ছে উন্নত বিশ্বের অর্থনৈতিক কাঠামো এমন ভাবে গড়ে উঠেছে, যেখানে সুদের হারের সামান্য হ্রাসের কারণে সাধারণ মানুষের তেমন কোনো লাভ হয় না, উল্টো কিছুটা ক্ষতিই হয়। অথচ এতে আমরা আমজনতাই বেশি খুশি হই। পক্ষান্তরে এই সুদের হার হ্রাসের কারণে যে সকল ধনাঢ্য ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়, তারা কিন্তু নিরব থাকে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সুদের হার সামান্য হ্রাসের কারণে আসলেই কি সাধারণ মানুষ লাভবান হয় না। এই প্রশ্নের সহজসরল উত্তর দেয়া বেশ কঠিন। কেননা এখানে জটিল হিসাবনিকাশ আছে। এই হিসাবের জটিলতা এতটাই গভির, যে আমরা যারা বানরের তৈলাক্ত বাঁশে ওঠার অংক শিখে এসেছি, তাদেরই বিষয়টা বুঝতে হিমসিম খেতে হয়। সেখানে সাধারণ মানুষ বুঝবে কিভাবে। তারপরও একটি কাল্পনিক উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ধরা যাক একজন ব্যাক্তি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ৫ লাখ ডলার মুল্যের একটি বাড়ি কিনেছে। এই বাড়ির বিপরীতে ব্যাংক সেই গ্রাহককে মর্টগেজ ঋণ এবং ব্যাক্তিগত ঋণ মিলে মোট ৪ লাখ ডলার পর্যন্ত অর্থ উত্তোলনের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এখন যদি সেই ব্যাক্তির ৩ লাখ ৮০ হাজার ডলার ঋণ ইতোমধ্যে নেয়া থাকে, তাহলে সে আর মাত্র ২০ হাজার ডলার উত্তোলন করতে পারবে। সুদের হার যদি ২.৭৫% থাকে, এবং তার মাসিক কিস্তির পরিমাণ যদি ৫ হাজার ডলার হয়, যার মধ্যে, সুদের পরিমাণ ৩ হাজার পাঁচশত ডলার এবং আসল মাত্র ১ হাজার পাঁচশত ডলার। এভাবে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করলে এক বছর পর আসল পরিশোধ হবে ১৮ হাজার ডলার এবং সেক্ষেত্রে সেই ব্যাক্তির অর্থ উত্তোলনের সুযোগ থাকবে আটত্রিশ হাজার ডলার। এখন সুদের হার হ্রাস পেয়ে ২.৫০% নির্ধারণ করায়, ৫ হাজার ডলার মাসিক কিস্তিতে সুদের পরিমাণ কমে ৩ হাজার ডলার হবে এবং আসল হবে ২ হাজার ডলার। এভাবে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার ফলে এক বছর পর আসল পরিশোধ হবে ২৪ হাজার ডলার এবং সেক্ষেত্রে সেই ব্যাক্তির অর্থ উত্তোলনের সুযোগ থাকবে ৪৪ হাজার ডলার, যা আগের সুদের হারের সময় ছিল ৩৮ হাজার ডলার। সুদের হার হ্রাস পাবার কারণে এই যে অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়, সেটাই সাধারণ মানুষের জন্য একমাত্র লাভের বিষয়।
এ তো গেল সুদের হার হ্রাসের একটি মাত্র প্রভাবের দিক। আরও অনেক বিষয় আছে যেখানে সাধারণ মানুষের কোনো লাভই হয় না, উল্টো বৃহৎ ব্যাবসা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেশ লাভ হয়। যেমন, ধরা যাক ক্রেডিট কার্ডের কথা। নীতি সুদ হার হ্রাসের কারণে ক্রেডিট কার্ডের ঋণের উপর ধার্য সুদের হারে কোনরকম প্রভাব পরে না। ক্রেডিট কার্ডের ঋণের উপর সবসময়ই উচ্চ হারে সুদ ধার্য করা হয়, যা ক্ষেত্রভেধে ১৯% থেকে ২২% এর মত হয়ে থাকে। ব্যাংক অব কানাডা যে তাদের নীতি সুদ হাঁর ২৫ বেসিস পয়েন্ট হ্রাস করেছে, সে কারণে ক্রেডিট কার্ড প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সুদের হার বিন্দুমাত্র কমাবে না। ফলে যাদেরই ক্রেডিট কার্ড ঋণ আছে, তাদের আগের মতই সুদ দিতে হবে। পক্ষান্তরে ক্রেডিট কার্ড প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যে ঋণ নিয়ে এই ক্রেডিট কার্ডে বিনিয়োগ করেছে, তার উপর ২৫ বেসিস পয়েন্ট কম সুদ দিতে হবে। যেহেতু শতশত বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ এই ক্রেডিট কার্ডে, তাই সেখানে তাদের ভাল অংকের সুদ কম দিতে হবে, যা প্রকারান্তরে তাদের বাড়তি মুনাফা হবে। উল্লেখ্য উন্নত বিশ্বে, এমনকি এই কানাডায় এমন কাউকে খুজে পাওয়া মুশকিল, যার ক্রেডিট কার্ড ঋণ নেই। বরং অধিকাংশ মানুষ এই ক্রেডিট কার্ড ঋণ নিয়েই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করে এবং জীবনযাত্রার ব্যায় নির্বাহ করে থাকে।
এখানেই শেষ নয়। এই সুদের হার হ্রাস পাবার কারণে বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, উৎপাদনকারী, আমদানিকারক, রিটেইল কর্পোরেশন ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণের উপর আগের থেকে কম সুদ প্রদান করবে। ফলে তাদের পরিচালনা ব্যায় হ্রাস পাবে, কিন্তু তারা সে অনুযায়ী পণ্য বা সেবার মুল্য কমাবে না। ফলে ভোক্তাদের কোনো লাভই হবে না। তাঁরা আগেও যে মুল্যে দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করেছে, এখনও সেই মুল্যেই ক্রয় করতে হবে। শুধু তাই নয়। এই সুদের হার হ্রাসের কারণে কানাডিয়ান ডলারের বিনিময় মুল্য উন্নত হবার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। কেননা বেশি সুদ না পেলে মানুষ কানাডিয়ান ডলারে কেন অর্থ জমা রাখবে। এমনিতেই কানাডিয়ান ডলারের বিনিময় মুল্য বেশ নিচে পড়ে আছে বেশ কয়েক বছর ধরে। কানাডা যেহেতু আমদানি-নির্ভর দেশ, বিশেষ করে জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যিক জিনিসপত্রের ক্ষেত্রে তো বটেই, তাই প্রতিটা পণ্যের আমদানি মূল্য অনেক বেশি হয় শুধুমাত্র কানাডিয়ান ডলারের সর্বনিম্ন বিনিময় মুল্যের কারণে এবং জনগণকেও এই বেশি মূল্যে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে হয়। সামনে আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ফেডারেল রিজার্ভ যদি তাদের নীতি সুদ-হার হ্রাস না করে, তখন কানাডিয়ান ডলারের বিনিময় মূল্য আরও পড়ে যেতে পারে। যদি তেমনটা হয়, তাহলে কানাডিয়ানদের এই সুদের হার হ্রাসের খেসারত দিতে হবে উচ্চ মুল্যে জিনিসপত্র ক্রয় করে।
সব হিসাবনিকাশ বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে যে সুদের হার ২৫ বেসিস পয়েন্ট হ্রাসের কারণে সাধারণ কানাডিয়ানদের কিছু বাড়তি ঋণ গ্রহণের সুবিধা ছাড়া তেমন কোনো লাভের সুযোগ নেই। যা কিছু লাভ, তা মূলত বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ধনাঢ্য ব্যাক্তিদের। তারপরও সাধারণ মানুষ এই সুদের হার হ্রাসের খবরে বেশ খুশি। এটাই এই মুহূর্তের প্রাপ্তি এবং এখনকার জন্য সুখবর, যা ব্যাংক অব কানাডা সাধারণ কানাডিয়ানদের দিতে পেরেছে।
নিরঞ্জন রায়, CPA, CMA, CAMS
সার্টিফাইড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিষ্ট ও ব্যাংকার।
টরনটো, কানাডা
Nironjankumar_roy@yahoo.com