হাডসন বে দেউলিয়া এবং কানাডার কর্পোরেশন সংস্কৃতি

নিরঞ্জন রায়

গত মাসে কানাডার অন্যতম একটি বৃহৎ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, হাডসন বে আকস্মিক দেউলিয়া ঘোষণা করে এবং তাদের ব্যবসা এখন বন্ধ হতে চলেছে। সংবাদটি কানাডাবাসীর জন্য বেশ কষ্টের এবং তাঁরা এরকম একটি সংবাদ শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। যেদিন এই প্রতিষ্ঠানটি আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়, ঠিক তার আগের দিনই আমি আমার এক সহকর্মীর সাথে এই প্রতিষ্ঠানের একটি স্টোরে গিয়ছিলাম কিছু কেনাকাটার জন্য। সেই স্টোরে গ্রাহকদের ভিড় এবং বেচাকেনের ধরণ দেখে কস্মিনকালেও কল্পনার মধ্যে আসেনি যে এই প্রতিষ্ঠান দেওলিয়া হয়ে বন্ধ হতে পারে। অথচ পরের দিনই এই প্রতিষ্ঠানের চলার পথ থেমে যাওয়ার সংবাদটি স্থানিয় গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এত বড় দেশের, এত বিশাল এক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে বন্ধ হয়ে যাবার মত ঘটনা ঘটল, অথচ কেও ঘুণাক্ষরেও আগে জানতে পারেনি।  

আমেরিকার-কানাডার মত দেশ একদিকে যেমন স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং মত প্রকাশের স্বর্গরাজ্য, অন্যদিকে তেমনি কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করার উৎকৃষ্ট স্থান। এসব দেশে কিছু কার্যক্রম আছে, যা অত্যান্ত গোপনীয়তার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। যেমন, কোন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া, কাউকে চাকুরি থেকে বিদায় করার মত কাজগুলো কঠোর গোপনীয়তার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। এখানে কোম্পানি পরিচালনার স্পর্শকাতর সিদ্ধান্তগুলো যথেষ্ট গোপনীয়তার মাধ্যমে গৃহীত হয়। একটি কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত সিদ্ধান্ত রাতারাতি গৃহীত হয় না। অনেক আগে থেকেই এরকম সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, কিন্তু সেটি আনুষ্ঠানিকভাবে জনসাধারণকে না জানানো পর্যন্ত কেও জানতে পারবে না। একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে, অথচ কেও তা জানতে পারে না। একইভাবে আগের দিন বিকেলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সুন্দর সুন্দর কথা, যেমন – হ্যাভ গুড ইভিনিং, হ্যাভ ফান উইথ ফ্যামিলি, হ্যাভ গুড স্লিপ, সি ইউ টুমরো, প্রভৃতি সুন্দর সুন্দর কথা বলে কর্মকর্তাদের দিনের কাজ শেষ করা হয়। অথচ সেই কর্মকর্তাই সকালে অফিসে আসলে, তাকে চাকুরি থেকে বিদায় করে সিকিউরিটি গার্ড দিয়ে বের করে দেয়া হয়। একজনের চাকুরি চলে যাবে, অথচ সে আগ মুহূর্ত পর্যন্ত জানতে পারে না। এসবই এখানকার কর্মসংস্কৃতি।

হাডসন বে ৩৫৫ বছরেরে পুরানো একটি বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ১৬৭০ সালে ইংল্যান্ডে এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মুলত পশম ব্যবসার উদ্দেশ্যে। সেই থেকে এই কোম্পানির অগ্রযাত্রা অব্যাহত ছিল। কানাডার শুরু থেকেই এই হাডসন বে এখানে বেশ সফলতার সাথেই ব্যবসা পরিচালনা করেছে। হাডসন বে মূলত কানাডার বিখ্যাত একটি রিটেইল ষ্টোর, যেখানে হেন কোনো জিনিস নেই, যা বিক্রি হয়নি। আসবাবপত্র থেকে শুরু করে স্বর্ণঅলঙ্কার, কাপড়চোপড়, প্রসাধনী সামগ্রী, মোট কথা মানুষের জীবনধারণের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তার সবকিছুই বিক্রি হতো এই হাডসন বের স্টোরে। সাশ্রয়ী মুল্যে গুনগত মানের দিক থেকে উন্নত মানের দ্রব্যসামগ্রী পাওয়া যেত এই হাডসন বের স্টোরে। গুণগত মানের কারণেই হাডসন বে কানাডার নিজস্ব ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছিল। কানাডার একটি নিজস্ব অহংকার ছিল এই হাডসন বে কোম্পানি। অথচ কানাডিয়ান হিসেবে গর্ব করার মত এরকম একটি কোম্পানি দেওলিয়া হয়ে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিল।

আমেরিকা, কানাডাসহ পশ্চিমা বিশ্বের ধনতান্ত্রিক দেশে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেওলিয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়মিত ঘটনা। এখানে সকাল বিকাল কোম্পানি নিজেকে দেওলিয়া ঘোষণা করে এবং এক পর্যায় বন্ধ হয়ে যায়। এখানে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সরাসরি বন্ধ ঘোষণা করেনা। যখন কোনো কোম্পানি লাভজনক ভাবে পরিচালিত হতে পারে না, তখন প্রথেম নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে, যা মূলত বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ। যখন একটি কোম্পানি পরিচালনা করে ঋণ পরিশোধ করার মত অবস্থায় থাকে না, তখন সেই কোম্পানি দেউলিয়া আইনের আওতায় ঋণদাতাদের হাতে থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আবেদন করে, যা আইনের ভাষায় ক্রেডিটর প্রটেকশন বলা হয়। এই আবেদেন গৃহীত হবার পর আর কোনো ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান তাদের কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায়ের জন্য চাপ দিতে পারবে না। আবেদন গৃহীত হবার পর একটি নির্দিষ্ট সময় বেধে দেয়া হয় যাতে করে কোম্পানিটি পুনঃগঠন বা রিস্ত্রাকচার করে ঘুরে দাঁড়াতে পারে এবং ব্যবসায় টিকে থাকতে পারে।

এই পুনঃগঠন সময়ে যাতে ঋণদাতারা পাওনা আদায়ে অহেতুক চাপ সৃষ্টি করে ব্যবসায় বিঘ্ন ঘটাতে না পারে, সেকারণেই এই ক্রেডিটর প্রটেকশনের ব্যাবস্থা। আবেদন করা কোম্পানিটি যদি পুনঃগঠন করে ব্যবসায় টিকে যেতে পারে, তাহলে তো কথাই নাই। তখন সাধারণ নিয়মে ব্যবসা পরিচালনা করবে এবং স্বাভাবিকভাবেই ঋণের টাকা পরিশোধ করবে। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে কোম্পানি যদি ব্যবসায় টিকতে না পারে, তাহলে সম্পূর্ণরূপে দেউলিয়া ঘোষণা করে কোম্পানির সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে পাওয়াদারদের অগ্রাধিকার অনুযায়ী পরিশোধ করে দেয়া হয়। এসবই হচ্ছে নিয়মের কথা। বাস্তবে একবার কোনো কোম্পানি ক্রেডিটর প্রটেকশন চেয়ে আবেদন করে পুনঃগঠনের মাধ্যমে ঘুরে দাড়াতে পেরেছে এমন নজির বিরল। এই ব্যাবস্থা মূলত না ফেরার অবস্থানে চলে যাওয়া। একবার ক্রেডিটর প্রটেকশন চেয়ে আবেদন করলে সেখান থেকে আর ফেরার কোনো উপায় থাকে না। সেখানে এক পর্যায়ে দেউলিয়া ঘোষণা করা এবং চূড়ান্তভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া। হাডসন বের ক্ষেত্রেও এটাই হয়েছে।

এসব দেশে বেসরকারি খাতের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সকাল বিকাল দেউলিয়া ঘোষণা করে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নজির থাকলেও, হাডসন বের মত এত পুরনো এবং বিশাল কোম্পানি এভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। হাডসন বে মূলত এক বিলিয়ন দলার পরিমাণ ঋণের দায়ে আটকে গিয়েছিল, যা তাঁরা স্বাভাবিক নিয়মে ব্যবসা পরিচালনা করে পরিশোধ করতে পারছিল না। এই এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধের একটা ব্যবস্থা করা গেলে, এই কোম্পানিটিকে টিকিয়ে রাখা মোটেই কঠিন কোনো ব্যাপার ছিল না। কেননা এই কোম্পানির আছে ঐতিহ্য, সুখ্যাতি, বিশাল অবকাঠামো, অর্থাৎ ব্যবসায়িক স্থাপনা এবং বিশ্বব্যাপি ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক। সবচেয়ে অবাক করার মত বিষয় হচ্চে এসব দেশে একাধিক কোম্পানির মধ্যে মার্জার এবং অ্যাকুইজিশন নিয়মিত ঘটনা হলেও, কোনো কোম্পানি এগিয়ে আসেনি এই হাডসন বেকে রক্ষা করার জন্য। এমনকি কানাডার অহংকার, ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করার জন্য সরকারও এগিয়ে আসেনি। সরকার চতুর্দিকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যায় করছে। এমনকি ব্যবসাকে সমর্থন বা সাপোর্ট করার জন্য সরকার বিনিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যায় করে। তাই চাইলে সরকার এক বিলিয়ন ডলারের সহযোগিতা দিয়ে এই কোম্পানিটিকে টিকিয়ে রাখতে পারত।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করার জন্য সরকার কেন এগিয়ে আসবে এবং কেনই বা আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করবে। খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যখন জাতীয় পর্যায়ের সংস্থায় পরিণত হয় বা জাতির গর্ব হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যায়, তখন সেই প্রতিষ্ঠান রক্ষা করার জন্য সরকার এগিয়ে এলে দোষের কিছু হয় না। এটা সব দেশেই হয়ে থাকে। ২০০৮ সালে সাবপ্রাইম মর্টগেজ কেলেংকারির কারণে আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে, সিটি ব্যাংক এবং ফোর্ড এর মত গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান যখন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন আমেরিকার সরকার আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রেখেছিল। জার্মানিতে ডায়েচ ব্যাংক ডুবতে বসেছিল, কিন্তু সরকার এই প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ হতে দেয়নি। সহযোগিতা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রেখেছে। একই অবস্থা হয়েছিল ইউরপের আরেক বিখ্যাত গাড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভকস ওয়াগানের ক্ষেত্রে। সংকটে পড়ে বন্ধ হওয়ার অবস্থা থেকে সরকারি সহযোগিতা দিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রক্ষা করার দৃষ্টান্ত অসংখ্যা আছে।

আমেরিকা বা ইউরোপের অনেক দেশে সরকারি সহযোগিতা দিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা হলেও, কানাডায় তেমনটা দেখা যায় না। কানাডার এরকম গর্ব করার মত একটি কফি শপ হচ্ছে, টিম হরটন। সেই টিম হরটনও এখন আর কানাডিয়ানদের নেই। এটির মালিকানা এখন আমেরিকানদের। কেননা কানাডার গর্ব করার মত এই টিম হরটন আমেরিকার একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। আজ বিশ্বব্যাপী সেল ফোন ম্যসেজের যে জয়জয়কার অবস্থা, সেই মেসেজিং সিস্টেম আবিস্কার করেছিল কানাডার ব্ল্যাক বেরি কোম্পানি। অথচ সেই ধারণা নিয়ে স্যামসং এবং অ্যাপল বিশব্যাপি ব্যাবসা করে শতশত বিলিয়ন ডলার উপার্জন করছে, অথচ এর আবিস্কারক কোম্পানি ব্ল্যাক বেরি ডুবন্ত অবস্থায় আছে। আসলে নিজস্ব বলে কিছু বিষয় থাকে, যা সরকারি এবং বেসরকারি উভায়ই হতে পারে। মালিকানার ধরণ যেমনই হোক নে কেন, নিজস্ব বা গর্বের বিষয় রক্ষা করার চেষ্টা সব দেশের সরকারই করে থাকে। কেন জানি কানাডা এই প্র্যাকটিস থেকে দূরে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিজ উদ্যোগে আসবে, পারলে টিকে থাকবে, আর না পারলে বন্ধ হয়ে যাবে; এটাই হয়ত কানাডার কর্পোরেট সংস্কৃতি, যার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হচ্ছে হাডসন বে।

নিরঞ্জন রায়, CPA, CMA, CAMS
সার্টিফাইড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিষ্ট ও ব্যাংকার।
টরনটো, কানাডা
Nironjankumar_roy@yahoo.com