হেরিটেজ পার্ক হিস্টোরিক্যাল ভিলেজ
একদিন ক্যালগেরীর ‘হেরিটেজ পার্ক হিস্টোরিক্যাল ভিলেজ’ দেখতে গিয়েছিলাম। কানাডার বৃহত্তম এই অভিনব ‘লিভিং হিস্ট্রি মিউজিয়াম’ শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে গ্লেনমোর রিজার্ভয়ারের একটি উপদ্বীপে।
ভিলেজের সব রাইড টিকিট মূল্যের মধ্যে। ডান পাশে প্রথমেই ‘গ্যাসোলিন এ্যালী’। আকর্ষণীয় ভিনটেজ কার, বিভিন্ন পেট্রোল কোম্পানির কাছ থাকে পাওয়া চমকপ্রদ সব গাসোলিন পাম্প ও এতদ্ সম্পর্কিত অন্যান্য আর্টিফ্যাক্টসের সহস্রাধিক স্মরণীকা আইটেমের সংগ্রহ নিয়ে উত্তর আমেরিকায় বৃহত্তম অটোমোবাইল মিউজিয়াম। ‘বেঙ্গল গ্যাসোলিন’ নামে একটা পোস্টার দেখলাম।
পথের ডান পাশে ‘ফেমাস ফাইভ সেন্টার অব কানাডিয়ান উইমেন’। ১৯২৯ সালে নারী-অধিকার আন্দোলন বিজয়ী আলবার্টার পাঁচ অসমসাহসী আপোষহীন নেত্রী নেলী ম্যাকক্লাং, ইরেনা পার্লবি, ল্যুইস ম্যাককিনি, হেনরিয়েটা মূর এডওয়ার্ডস এবং এমিলি মারফি’র ছবি ও সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে প্রদর্শনীগৃহ।
সামান্য হেঁটে পেলাম রেলওয়ে স্টেশান ‘মিডনাপোর’। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জেলাশহর মেদিনীপুর স্টেশানের নামও ইংরেজিতে Midnapore। ১৯১২ সালে ফোর্ট ম্যাকলিয়ড থ্যেকে ক্যালগেরী পর্যন্ত যাত্রীবাহী ট্রেন সার্ভিস শুরু হয়। ক্যালগেরীর ঠিক দক্ষিণে মিডনাপোরে ১৯১০ সালে একটি স্টেশান তৈরি হয়। আগে স্থানটির নাম ছিল ‘ফিশ ক্রীক’। একদিন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর (Midnapore) থেকে লেখা একটি চিঠি ফিশ ক্রীকের মেইলব্যাগে মিশে গেলে পোস্টমাস্টার গ্রামের নাম পরিবর্তন করে ‘মিডনাপোর’ রাখে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কালীন জনশক্তি অভাব ও ব্যবসা হ্রাসের কারণে ১৯১৮ সালে ‘মিডনাপোর’ স্টেশান বন্ধ হয়ে যায়। কানাডা প্যাসিফিক রেলওয়ে ১৯৬৪ সালে এক ডলারে স্টেশানটি হেরিটেজ পার্ককে বিক্রি করে। এটি সেই আমলের চালু স্টেশানের মতো করে রাখা হয়েছে। প্ল্যাটফর্মের সাথে অফিসরুম, ওয়েটিংরুম এবং মালগুদাম। ওয়েটিংরুমে যাত্রীদের বাকসো-প্যাঁটরা। চক্ররেল হেরিটেজ ভিলেজকে ঘুরে আবার এখানে এসে মিলেছে। সাড়ে এগারোটায় ট্রেনে চাপলাম। ট্রেন থেকে নাইটিঙ্গেল কলোনি হাউস, র্যাঞ্চ, বার্নসাইড র্যাঞ্চহাউস দেখতে দেখতে কয়েক মিনিটের মধ্যে ১৯১০ সালে তৈরি ‘শেপার্ড’ স্টেশানে এসে নেমে পড়লাম।
স্টেশানের পিছনেই ক্যালগেরীর একমাত্র প্যাডলহুইল স্টীমারের জেটিঘাট ‘এস এস ময়ী স্টার্নহুইলার ক্রুজ’। ফার ব্যবসার আমল থেকে বৃটিশ কলাম্বিয়া এবং আলবার্টার যে সব এলাকায় তখন পর্যন্ত সড়ক বা রেলওয়ে যোগাযোগ স্থাপিত হয় নি, অনেক বড়ো বড়ো নদী এবং হ্রদ থাকায় স্টীমার ছিল যাত্রী এবং মাল পরিবহনের প্রধান বাহন। ১৮৯৮ সালে তৈরি ‘এস এস ময়ী’ গোল্ডরাশের সময় মাইনারদের কূটনী লেকে কূটনী রেল টার্মিনাল থেকে নেলসন পর্যন্ত ফেরি সার্ভিস দিত। ১৯৫৭ সালে ‘ময়ী’ ছিল উত্তর আমেরিকার প্রাচীনতম সচল স্টীমার। ১৯৬৫ সালে হেরিটেজ পার্ক এর অর্ধেক আকারের রেপ্লিকা তৈরি করে প্রায় চার বর্গ কিলোমিটার গ্লেনমোর রিজার্ভয়ারে কুড়ি মিনিটের নৌবিহারের জন্য চালু করেছে। আমরা গ্যাংওয়ে দিয়ে জাহাজে চেপে দোতলার সামনে চলে গেলাম। তারপর ফুরফুরে বাতাস গায়ে জড়িয়ে ভেসে বেড়ালাম সুনীল হ্রদে।
এর পর এলাম ভিলেজ সেন্টারে। ভিলেজে পশ্চিম কানাডার অতীতকে শুধুমাত্র সংরক্ষিত করা হয় নি, সচল ও জীবন্ত ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। হেরিটেজ ভবনগুলি হয় স্থানান্তরিত করে পুনস্থাপিত হয়েছে অথবা রেপ্লিকা হিসেবে পুনর্নির্মিত হয়েছে। ভবনের আসবাবপত্র ও সরঞ্জামাদি আদি এবং অকৃত্রিম। হেরিটেজ আবহ সৃষ্টির জন্য ভিলেজে সকল কর্মী সর্বত্র প্রাচীন পোষাকে রয়েছেন। ভিলেজের সব রাস্তা প্রাচীন কালের মতো সুড়কির। আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ঘড়ির দোকান, ক্যান্ডি শপ, আইসক্রীম শপ, স্যুভেনীর শপ, ব্যাংক, ডেন্টিস্ট, ল হাউস, কাফে, কামারশালা, অশ্বশালা, ধোপাশালা, সেলুন, স্নুকার হাউস, স্কুল, হাসপাতাল, পুলিশ ব্যারাক, গির্জা, অপেরা হাউস, রেলওয়ে স্টেশান, খবরের কাগজের প্রেস, শিশুপার্ক, পিকনিক এরিয়া, পোস্ট অফিস – সব কিছুই আছে হেরিটেজ আবহ নিয়ে। শতাধিক প্রদর্শনী বিষয়, একবারে দেখে শেষ করাই কঠিন।
প্রতিটি গৃহে গৃহবাসী বা কর্মী নিজ নিজ স্বাভাবিক কাজে ব্যাপৃত। অভিনয় বলে মনেই হয় নি। ‘ওয়ান-রুম’ স্কুলে শিক্ষিকা পড়াচ্ছেন, সামনে শ্লেট-পেন্সিল নিয়ে ছাত্র। গির্জায় পুরোহিত পিয়ানোতে প্রার্থনা সংগীত বাজাচ্ছেন, চাইনীজ লন্ড্রীতে চীনাম্যান কাপড় ইস্ত্রি করছে, কামারশালায় হাপর দিয়ে আগুন জ্বেলে ঘোড়ার নাল বানানো হচ্ছে। সেলুনে নাপিত প্রস্তুত। পোস্ট অফিসে পোস্টম্যান চিঠি সর্ট করছে। আস্তাবলে সহিস ঘোড়ার পরিচর্যা করছে। বাসগৃহে মহিলারা রান্না ঘরের কাজ করছে বা উল সেলাই করছে। খবরের কাগজের ছাপাখানায় পত্রিকা জন্য কম্পোজ ও ট্রেড্লমেশিনে ছাপার কাজ চলছে। মেয়েরা বাজার করে ফিরছে। পরিকল্পনায় অভূতপূর্ব দৃষ্টিভঙ্গির অনন্যসাধারণ প্রতিফলন দেখে বিস্মিত হতে হয়।
মেইন স্ট্রিট থেকে ডান দিকে বেরিয়ে যাওয়া ফ্রন্ট স্ট্রিটে এক ধারে পিকনিক এরিয়া, পাশ থেকে জোড়া ঘোড়ায় টানা ‘হর্স ড্রন ওয়াগন রাইড’। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই মহিলা গাইডের সাথে মজা করে ভিলেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্য ধারে পাশাপাশি ‘ওয়েনরাইট হোটেল(১৯০৮)’, ‘ক্যান্ডি স্টোর’, ‘এক্সপার্ট ওয়াচমেকার ডি ই ব্ল্যাক’ ও ‘ভালকান আইসক্রীম পার্লার(১৯১০)’। মেইন স্ট্রিটের শেষ প্রান্তে ‘কনক্লিন লেকভিউ এ্যামিউজমেন্টস’ – শিশুপার্ক।
মেইন স্ট্রিট থেকে বাম দিকে বেরিয়ে যাওয়া রেলওয়ে স্ট্রিটের এক ধারে পাশাপাশি এক সময়ের ‘ট্রেডার্স ব্যাংক অব কানাডা’(১৮৮৪-১৯১২), ‘ডেন্টিস্ট অফিস’, ‘হাই রিভার ল অফিস’ এবং ‘ক্লাব কাফে’(১৯১৪)। ব্যাংক, ডেন্টিস্ট ও ল অফিস প্রদর্শনী গৃহ। ভিতরে সবকিছু সাজানো অবস্থায় আছে, কর্মীরাও আছেন। কাফে আছে চালু অবস্থায়। বসে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। ওখান থেকে লাঞ্চের জন্য স্যান্ডউইচ কিনে নিলাম। অপর ধারে ‘টি ফ্লেট এ্যান্ড জেনারেল ব্ল্যাকস্মিথ(১৯১১)’। পাশে অশ্বশালা ‘ন্যানটন এন্টারপ্রাইজ লিভারি স্টেবল’।
মেইন স্ট্রিটে বাম ধারে পরপর ‘ক্যালগেরী টাউন হল(১৮৮৫)’, ‘আলবার্টা বেকারী(১৯১২)’, খবরের কাগজের অফিস ‘দি স্ট্র্যাথমোর এ্যান্ড বো ভ্যালী স্ট্যান্ডার্ড(১৯০৯)’, ‘ব্যারনস স্নুকার’, লন্ড্রী, ‘উইডন স্কুল(১৯১০)’, ‘কটেজ হসপিটাল(১৯০৭)’, ‘হাল ক্যারেজ হাউস’ এবং ডান ধারে ‘পোস্ট অফিস ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ(১৯০৮)’, ‘এয়ারড্রি হাউস’, ‘থর্প হাউস(১৮৮৪)’, চার্চ ‘আওয়ার লেডি অব পীস মিশন’।
প্রিন্স স্ট্রিটে প্রধান আকর্ষণ ক্যালগেরীর প্রথম লাম্বার ও হাইড্রোইলেক্ট্রিসিটি ম্যাগনেট এবং প্রিন্সেস আইল্যান্ডের স্রষ্টা পিটার এ্যান্থনী প্রিন্সের বর্ণাঢ্য আসবাব সজ্জিত ১৮৯৪ সালে নির্মিত বিলাসবহুল বাসভবন। এ ছাড়াও রয়েছে সিবল্যান্ড শহরে ১৯১৬ সালে স্থাপিত মন্টেফয়ের ইনস্টিটিউট জুইশ ‘সিনাগগ’।
মেইন স্ট্রিটের শেষ প্রান্তে ‘কেনমোর অপেরা হাউস’। ক্যালগেরী থেকে একশ কিলোমিটার পশ্চিমে রকি পর্বতের সানুদেশে কেনমোরে ১৮৯৮ সালে ‘এইচ ডাবলিউ ম্যাকনীল কোম্পানি ব্রাস ব্যান্ড’ এই কাঠের গুঁড়ির অপেরা হাউস নির্মাণ করেছিল। ১৯৬৪ সালে এটি হেরিটেজ পার্ককে দান করা হলে পার্কে একটু ছোটো আকারে লগহাউসটি পুনর্নির্মিত হয়। দুপুর দেড়টায় আলবার্টার শতবর্ষ আগের নারী অধিকার আন্দোলনের কাহিনি নিয়ে ‘রোজবাড থিয়েটার’ পরিবেশিত তিরিশ মিনিটের ফ্রি মিউজিক্যাল অপেরা “নেলী’স কনট্রোভার্সিয়াল প্রিমিয়ার” উপভোগ করলাম। ক্যালগেরীর অনতিদূরে রোজবাড শহরের পেশাদার নাট্যগোষ্ঠী ‘রোজবাড থিয়েটার’ গ্রীষ্মে দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাটক করে। এদের একটি বিখ্যাত প্রযোজনা ‘দি ডায়েরি অব এ্যানা ফ্র্যাঙ্ক’।
ঊনবিংশ শতকের বিশের দশকে আলবার্টার মহিলাদের ভোটাধিকারের দাবিতে নারী আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে পথনাটক ‘সাফ্রাজেটিস ইন দি ওয়েস্ট’ অভিনীত হচ্ছিল ভিলেজ সেন্টার জুড়ে। চারটি দৃশ্য পরিবেশিত হয় চারটি হেরিটেজ ভবনের সামনে। প্রথম দৃশ্য ‘লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইট’ প্রিন্স স্ট্রিটে ‘আইসক্রীম পার্লার’, দ্বিতীয় দৃশ্য ‘এ্যান আনএক্সপেক্টেড সারপ্রাইজ’ মেইন স্ট্রিটে ‘ব্যারনস স্নুকার পার্লার’, তৃতীয় দৃশ্য ‘দি ডিবেট’ মেইন স্ট্রিটে ‘আলবার্টা বেকারী’ এবং চতুর্থ দৃশ্য ‘ব্যাটল অব দি সেক্সেস’ প্রিন্স স্ট্রিটে ‘প্রিন্স হাউস’।
ভিলেজে বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম প্রোগ্রামের আয়োজন হয়। প্রতিদিনের প্রোগ্রাম ‘ডেইলি এস্কেপ’ পার্ক গেটে টিকিটের সাথে পাওয়া যায়।
কানাডার ঐতিহ্য খুব প্রাচীন নয়। তারপরও নূতন মহাদেশে অভিবাসনের সূচনাপর্বের জীবন ও জীবিকার ইতিহাস সংরক্ষণ ও উপস্থাপনার উদ্ভাবনামূলক প্রয়াস ভূয়সী প্রশংসাযোগ্য।
বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁয়ে ‘পানাম নগর’কে ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধার করে এরকম সচল ও জীবন্ত ভাবে উপস্থাপন করতে পারলে পর্যটন আকর্ষণ অনেক বৃদ্ধি পাবে মনে হয়েছে।